ছাত্রী নিপীড়নে অভিযুক্ত জাবি শিক্ষককে শিক্ষা কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি
ছাত্রীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) শিক্ষক সানোয়ার সিরাজকে অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়নবিরোধী সেলের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে রোববার উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম তাকে অব্যাহতি দেন।
দুপুর ১২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়নবিরোধী সেলের তদন্ত দল সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সানোয়ার সিরাজকে অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখার সুপারিশ করে। পরিপ্রেক্ষিতে উপাচার্য ফারজানা ইসলাম তাকে অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেন।
সহকারী অধ্যাপক সানোয়ার সিরাজের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ করেন তারই বিভাগের এক ছাত্রী। এই হয়রানির বিচার চেয়ে বিভাগীয় সভাপতি বরাবর লিখিত অভিযোগও করেন তিনি। লিখিত এ অভিযোগ ‘ধামাচাপা’ দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, এমন অভিযোগ তুলে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন ভুক্তভোগী ছাত্রী। পরে তার সহপাঠীরা তাকে রক্ষা করেন।
নিপীড়নের ঘটনার বিচার না পেয়ে এবং শিক্ষকের হুমকিতে মানসিকভাবে প্রচণ্ড ভেঙে পড়েন বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী ছাত্রী। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছাত্রী ২৩ সেপ্টেম্বর রাতে ২৬টি ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। গুরুতর অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে সাভারের একটি বেসরকারি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে ভর্তি করানো হয়।
জানা গেছে, হয়রানির ঘটনা উল্লেখ করে সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক নাসরিন সুলতানা বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগী ছাত্রী। ১৯ সেপ্টেম্বর ওই অভিযোগ করেন তিনি। পরে ২৫ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়নবিরোধী সেলে অভিযোগটি পাঠান বিভাগীয় সভাপতি।
বিভাগীয় সভাপতি বরাবর দেয়া অভিযোগপত্রে ভুক্তভোগী ছাত্রী উল্লেখ করেন, ‘ভালো পরীক্ষা দেয়া সত্ত্বেও তৃতীয় বর্ষে সানোয়ার সিরাজের কোর্সে কম নম্বর পাই। ফলে আমি ওই কোর্স মানোন্নয়ন পরীক্ষা দিতে চাই। আর এ জন্যই আমি সানোয়ার সিরাজের শরণাপন্ন হই। এ সময় তিনি আমার মুঠোফোন নম্বর নিয়ে রাখেন। তিনি আমাকে বলে রাখেন, যেকোনো কারণে যেন যোগাযোগ করি।’
অভিযোগে ভুক্তভোগী ওই ছাত্রী আরও উল্লেখ করেন, পরীক্ষার দিন (গত বছরের ১২ মার্চ) সানোয়ার সিরাজ ফোন করেন। পরীক্ষা কেমন হলো জানতে চান। এর পর ওই রাতেই তিনি আবারও ফেসবুক মেসেঞ্জারে যোগাযোগ করেন এবং আমার সঙ্গে ঘোরাফেরা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। হঠাৎ করে তার এ ধরনের আচরণে আমি বিস্মিত হই। পরে আমি বিভাগে গিয়ে তার কাছে জানার চেষ্টা করি যে, তার ফেসবুক আইডি হ্যাক হয়েছিল কিনা। কিন্তু তিনি নিশ্চিত করেন যে আইডি হ্যাক নয় বরং তিনিই এই মেসেজ দেন। এ সময় তিনি আরও বলেন যে, আমার প্রতি তীব্র শারীরিক আকর্ষণ বোধ করেন, আমার সঙ্গে সময় কাটাতে চান, ঘুরতে চান। আমি ধারাবাহিকভাবে সানোয়ার সিরাজের এমন আচরণে খুবই বিব্রত ছিলাম। ফলে বারবার ফেসবুক আইডি ডিঅ্যাক্টিভ করছিলাম। কিন্তু তিনি রেগুলার আমাকে উত্ত্যক্ত করে যাচ্ছিলেন।’
‘আমি এ ঘটনার জন্য সানোয়ারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার ইচ্ছা পোষণ করি। কিন্তু আসন্ন স্নাতকোত্তর পরীক্ষার কারণে এ মুহূর্তে অভিযোগ না দেয়ার জন্য অনেকে আমাকে পরামর্শ দেন। এ অবস্থায় আমি সানোয়ারের আচরণে হতাশ হয়ে পড়ি। পরে তিনি আমাকে আবার কল করে ড্রেস গিফট করা, ঢাকা ও সাভারের রেস্টুরেন্টে খাওয়া, রাতে একসঙ্গে ঘুরতে যাওয়া এবং স্ত্রীর অনুপস্থিতিতে তার বাসায় রাতযাপন করার প্রস্তাব দেন। এ সময় তিনি আরও কিছু অশালীন কথাবার্তা ও কুপ্রস্তাব দেন। আমি তার ধারাবাহিক অত্যাচারে মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি এবং একাধিক ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হই।’
অভিযোগে ওই ছাত্রী আরও উল্লেখ করেন, ‘পরে সানোয়ার সিরাজের যৌন নিপীড়নমূলক কথাবার্তা, ফোনকল রেকর্ড ও মেসেঞ্জারের চ্যাটের প্রমাণ বিভাগের তৎকালীন সভাপতি সামসুন্নাহার খানমের কাছে হস্তান্তর করি। কিন্তু এর কারণে পরে একটি অনুষ্ঠানের বক্তব্য কেন্দ্র করে আমার ওপরে চড়াও হন খন্দকার সামসুন্নাহার এবং তিনি আমার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দেন।’
এ বিষয়ে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী বলেন, ‘মহিলা পরিষদের একটি অনুষ্ঠানে আমি আমার হয়রানির কথা জানাই। কিন্তু এসব শুনে বিভাগের সাবেক সভাপতি সামসুন্নাহার খানম আমাকে বিভিন্নভাবে হুমকি দেন, যাতে বিভাগে লিখিত অভিযোগ না নিয়ে যাই। আমি পরে তাকে কিছু বিষয় শেয়ার করি। তিনি আমাকে সহানুভূতি জানিয়ে এসব ভুলে গিয়ে ক্যারিয়ারের দিকে নজর দিতে বলেন। বিভাগীয় সভাপতি হিসেবে তিনি এসব গোপন রাখার কথা ছিল। কিন্তু এসব শিক্ষকের মধ্যে ভাইরাল করে দেন। এর মধ্যে আমার পরীক্ষা। আমি আসলে আর লড়াই করতে পারছিলাম না।’
অভিযোগের বিষয়ে বিভাগের সদ্য সাবেক সভাপতি অধ্যাপক সামসুন্নাহার খানম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমাকে কোনো ধরনের লিখিত অভিযোগ দেয়নি। আমার বিরুদ্ধে যা বলছে তা বানিয়ে বলছে। এসব মিথ্যা ও বানোয়াট।’
এদিকে সানোয়ার সিরাজের ফেসবুক আইডি থেকে ভুক্তভোগী ছাত্রীর মেসেঞ্জারে পাঠানো আপত্তির খুদেবার্তার স্ক্রিনশটও ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
অভিযুক্ত সানোয়ার সিরাজের বিরুদ্ধে এর আগেও তার স্ত্রী একাধিক ছাত্রীর সঙ্গে ‘অনৈতিক’ সম্পর্কের অভিযোগ এনেছিল।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত শিক্ষক সানোয়ার সিরাজ বলেন, ওই ছাত্রী কী অভিযোগ করেছেন তা আমি জানি না। আদৌ আমার নাম উল্লেখ করেছেন কিনা সেটিও আমি জানি না। তাই এ বিষয়ে আমার বক্তব্য দেয়া ঠিক হবে না।