ভারতকে পাত্তা দিচ্ছে না ইরান!

0

আফগানিস্তানে ২০০১ সালে ও ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন হস্তক্ষেপ পরবর্তী সময়কালে ভারত-ইরান সম্পর্কে, প্রিন্সেস ডায়ানা যেভাবে তার বিবাহ সম্পর্কে একটি বিখ্যাত উক্তি করেছিলেন- ‘এতে আছে আমাদের তিনজন’, তৃতীয় হলো যুক্তরাষ্ট্র।

এর আগে ১৯৯০-এর দশক থেকে ভারত ও ইরানের মধ্যকার কৌশলগত ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আফগানিস্তানে অভিন্ন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের আলোকে এবং তালেবান ও এর মদতদাদা পাকিস্তানের কাছ থেকে আসা অভিন্ন হুমকির প্রেক্ষাপটে। ১৯৯৬ সালে তালেবানের কাবুল দখল করার পর তাদের সম্পর্ক ব্যাপক মাত্রা পায়, ওই সময় সমগ্র আফগানিস্তানে তালেবান নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় নর্দার্ন অ্যালায়েন্স।
২০০১ সালে ওই সময়ের ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী এ বি বাজপেয়ি তেহরান সফর করেন। তাকে স্বাগত জানান সংস্কারবাদী ও ক্রমবর্ধমান প্রভাবের অধিকারী ইরানি প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ খাতামি। এই সফরের সময় প্রকাশিত তেহরান ঘোষণায় ক্রমবর্ধমান সম্পৃক্ততা প্রতিফলিত হয়।

ইরানি প্রেসিডেন্ট ফিরতি সফরে ২০০৩ সালে ভারত যান এবং প্রজাতন্ত্র দিবসে প্রধান অতিথি ছিলেন। তবে তত দিনে যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে তালেবান পাকিস্তানে আশ্রয় পেয়েছে। মার্কিন সৈন্যরা ইতোমধ্যেই আফগানিস্তানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠি করেছে এবং এর দুই মাস পর তারা ইরাকে হামলা চালায়।
তারপর ২০০৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে ইরানের গোপন সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচির (এতে পাকিস্তানি বিজ্ঞানী এ কে খানের সম্পর্কসহ) কথা প্রকাশ পেলে ভারত-ইরান সম্পর্কে ছন্দপতন শুরু হয়। ইরানকে তার পরমাণু কর্মসূচির জন্য প্রকাশ্যে সমালোচনা করা হয়, তবে ইরান মনে করেছিল, বিস্তাররোধ চুক্তির (এনটিপি) স্বাক্ষরকারী হিসেবে তাদের কার্যক্রম অনুমোদিত। অন্যদিকে ওই চুক্তিতে সই না করেও অন্যায়ভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পরমাণু চুক্তি নিয়ে আলোচনা করছিল।

ভারত-ইরান সম্পর্ক নিয়ে আপত্তি উত্থাপন করে যুক্তরাষ্ট্র এবং তা এখনো জোরালভাবে চলছে। ২০০৩ সাল থেকে ভারত-ইরান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এর প্রভাব পড়তে শুরু করে। ইরানের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থায় (আইএইএ) ভোট দিতে, ইরানের সাথে বাণিজ্য ও তেল কেনা কমাতে ও মার্কিন অবরোধ অনুসরণ করতে ইরানকে অনুরোধ করে যুক্তরাষ্ট্র।

ভারত বলে আসছিল যে তারা কেবল জাতিসঙ্ঘ অবরোধ অনুসরণ করবে, মার্কিন আইন নয়। ইরান পশ্চিম দিকে মনোযোগ দেয় এবং ধৈর্য ও বিচক্ষণতার সাথে প্রক্সিদের মাধ্যমে ইরাকের সাম্প্রদায়িক ও সন্ত্রাসবাদে জর্জরিত যুদ্ধে মার্কিন সামরিক বাহিনীকে ফাঁদে ফেলে। আবু মুসাব আল-জারকাবির অধীনে প্রথম আল-কায়েদার ক্লোন এবং তারপর আবু বকর আল-বাগদাদির মাধ্যমে আইএসআইএস হাইব্রিডের মাধ্যমে তারা যুক্তরাষ্ট্রকে সমস্যায় ফেলে দেয়।
প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ পাল্টা আঘাত হেনে ইরাককে স্থিতিশীল করে জাতীয় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারলেও তার উত্তরসূরি প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রথমে দ্বিধায় ভুগলেও পরে এই অঞ্চলের ব্যাপারে মার্কিন নীতি পুরোপুরি বদলে ফেলেন।

তিনি হিসাব করেন যে হঠাৎ করে আত্মপ্রকাশ করা আইএসআইএসকে (তারা উত্তর ইরাক ও সিরিয়ায় বিশাল এলাকায় আক্ষরিক অর্থেই ইসলামি খিলাফত প্রতিষ্ঠা করে ফেলে) নিয়ন্ত্রণ করতে হবে তৃতীয় মার্কিন যুদ্ধের মাধ্যমে (যার জন্য যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তুত নয়) কিংবা ইরানের সাথে সহযোগিতা করতে হবে।
তিনি দ্বিতীয়টিই বেছে নেন এবং এর জের ধরে তিনি ইরানের সাথে পি-৫ ও জার্মানিকে নিয়ে পরমাণু চুক্তিতে সই করেন।

পাশ্চাত্যের দেশগুলোর সাথে এই মিত্রতার মাধ্যমে ইরান ধীরে ধীরে তার প্রভাব জাহির করতে থাকে এবং প্রক্সিদের মাধ্যমে ইরাক, সিরিয়া, এবং লেবানন থেকে ভূমধ্যসাগরীলয় এলাকা পর্যন্ত পুরো পশ্চিম এশিয়ার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। ভারত-ইরান সম্পর্ক কিছুটা স্বাভাবিক হলেও উভয় দেশই ভিন্ন ভিন্ন কৌশলগত অগ্রাধিকারের ওপর গুরুত্বারোপ করলে আগের উষ্ণতা হারিয়ে যায়। পরলোকগত মেজর জেনারেল কাসেম সোলায়মানির নেতৃত্বে ইরানের কুদস বাহিনী সিরিয়ার অবরুদ্ধ বাশার আল আসাদের সমর্থনে এগিয়ে আসে। রাশিয়ার বিমান সহায়তায় হিজবুল্লাহ ও কুদস বাহিনী স্থলবাহিনীর সাথে যোগ দেয়।

অন্যদিকে নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনে ব্যক্তিগত উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এমনকি এই দুটি দেশ ইয়েমেনে প্রকাশ্যে এবং সিরিয়ায় অনুসারীদের মাধ্যমে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেও ভারত-ইরান সম্পর্কে এর আঁচ লাগেনি। এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আগমনের ফলে। তিনি ওবামার ইরান নীতি বদলে ফেলে সৌদি-আমিরাত জোটের সাথে যোগ দেন, ইরানের সাথে করা পরমাণু চুক্তি বাতিল করেন, ইরানের ওপর আক্ষরিকভাবেই অবরোধ আরোপ করেন।

তিনি তার পছন্দের প্রার্থীদের বিজয়ী করার জন্য অতীতের সব রীতিনীতির অবসান ঘটিয়ে প্রকাশ্যে নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করতে থাকেন। তিনি তেল আবিব থেকে মার্কিন দূতাবাস সরিয়ে নেন জেরুসালেমে, ইরানি বিপ্লবী রক্ষী বাহিনীকে সন্ত্রাসী সংস্থা হিসেবে ঘোষণা করেন। কাজটি তিনি করেন কোণঠাসা প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে নির্বাচনে জয়ী করতে সহায়তা করতে।
তিনি প্রকাশ্য ব্রিটিশদেরকে বেক্সিটে যেতে আহ্বান জানান, এমনকি বরিস জনসন যাতে প্র্রধানমন্ত্রী হতে পারেন, সেজন্য তার দল রক্ষণশীল দলের ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। ভারতে তিনি, নিজের টুইটেই দাবি করেছেন, পুলওয়ামা-বালাকোট প্রায় ভারত-পাকিস্তান সঙ্ঘাতে দ্রুত সাড়া দেন এবং নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দারুণ সাফল্য পেতে এটিকে ব্যবহার করেন।

এতে এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র-সৌদি-আমিরাতি জোটের বিরুদ্ধে দেশগুলো ভারতকে দলানুগত হিসেবে বিবেচনা করবে, এমনটাই স্বাভাবিক। এই বিপদ খোদ মোদি সরকারই বাড়িয়ে তোলে। ২০১৯ সালে ক্ষমতায় ফিরে তারা আদর্শগত ও সাম্প্রদায়িক এজেন্ডাকে সামনে রেখে। ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল ও তিন তালাক এবং তারপর নাগরিকত্ব সংশোধনী আআনির মাধ্যমে ওইসব এজেন্ডাকেই বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
তবে তা করতে গিয়ে ভারত বিদেশে এবং বিশেষ করে ইসলামি দেশগুলোর সাথে তার সম্পর্ক নষ্ট করে ফেলে।

তুরস্ক, মালয়েশিয়া ও এমনকি ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশের সাথে মৌখিক মতবিরোধের পর ইরানও কঠোরভাবে ভারতকে তার সাংবিধানিক কর্তৃব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ভারত যদিও ইরানি রাষ্ট্রদূতকে তলব করা সত্ত্বেও ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আলী খামেনি ভারতে চরমপন্থী হিন্দু ও তাদের দলগুলোকে দমন করতে এবং মুসলিমদের গণহত্যা থামাতে ভারতের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, তা না হলে ইসলামি বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে ভারত।
ইরান সম্ভবত লাভ-ক্ষতি হিসাব করে কঠিন পরিস্থিতি সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। ভারত মোটামুটিভাবে মার্কিন অবরোধের কাছে নতি স্বীকার করেছে, যা ২০০৩ সালে দেশটি প্রতিরোধ করেছিল কেবল জাতিসঙ্ঘ নিষেধাজ্ঞা মানবে বলে জানিয়ে। বাণিজ্য ও বিনিয়োগের আকারে ভারতের কাছ থেকে কিছু স্বস্তি পাচ্ছিল তারা।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সৌদি আরব ও আবু ধাবির ক্রাউন প্রিন্সদের সাথে দহরম মোহরম ও এখন মোতেরা স্টেডিয়ামে ট্রাম্পের সাথে গলা মেলানোর বিষয়টি ইরানবিরোধীদের সাথে ভারতের প্রকাশ্যে অবস্থান গ্রহণ করা বলে বিবেচিত হচ্ছে। ইরান হিসাব করে দেখেছে যে তালেবান-যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি হয়ে যাওয়ার ফলে আফগানিস্তানে যেতে হলে পাকিস্তান ছাড়া এই দেশগুলোর মাধ্যমেই তা করা সম্ভব।

ভারতের উচিত হবে এই বিপদে যাওয়ার আগে বিষয়টি নিয়ে দুবার চিন্তা করা। এই বিপদ কিন্তু মালয়েশিয়া থেকে পাম তেল আমদানি বন্ধ করার মতো নয়। ফলে নানা বিভেদরেখায় ছিন্নভিন্ন ও বৈরিতাপূর্ণ একটি অঞ্চলে সব পক্ষের সাথে ভারতের খেলার সক্ষমতা নস্যাৎ হয়ে গেছে।
বিজেপি কি তার ঘরোয়া এজেন্ডা প্রত্যাখ্যান করবে না তাতেই লেগে থাকবে? সময়ই তা বলে দেবে।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com