ভদ্রতাকে যেসব কারণে নবুয়তি গুণের সঙ্গে তুলনা করলেন বিশ্বনবি
ভদ্রতা বা শিষ্টাচার মানব জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এটিকে নবুয়তের ২৫ ভাগের ১ ভাগ বলেও ঘোষণা দিয়েছেন বিশ্বনবি। জীবনের প্রতিটি কাজের ক্ষেত্রে ভদ্রতা বজায় রাখার নসিহত পেশ করেছেন অসংখ্য হাদিসে। যে কোনো কাজে শুরু থেকে শেষ এবং মর্যাদায় উঁচু থেকে নিচু পর্যন্ত সবক্ষেত্রে শিষ্টাচার বজায় রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন তিনি। হাদিসে এসেছে-
‘নিশ্চয়ই উত্তম চরিত্র, ভালো ব্যবহার ও পরিমিত ব্যয় বা মধ্যপন্থা অবলম্বন করা নবুয়তের ২৫ ভাগের এক ভাগ।’ (আবু দাউদ)
ভদ্রতা নবুয়তি গুণের সমতুল্য হওয়ার কারণ
শিষ্টাচার বা ভদ্রতা নবুয়তের ২৫ ভাগের ১ ভাগ হওয়ার কারণ হলো- ভদ্রতা, শিষ্টাচার বা আদব হলো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনের অন্যতম গুণ। এ গুণ সম্পর্কে তিনি বলেন-
– ‘তোমাদের মধ্যে তারাই উত্তম, যাদের চরিত্র উত্তম।’ (বুখারি)
– ‘তোমাদের মধ্যে আমার কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয় ওই ব্যক্তি, যার চরিত্র উত্তম।’ (ছহিহা)
– ‘তোমাদের যে ব্যক্তির চরিত্র ও আচরণ সর্বোত্তম, তোমাদের মধ্যে সে-ই আমার কাছে সর্বাধিক প্রিয় এবং কেয়ামতের দিনও সে আমার খুব কাছে থাকবে।’ (তিরমিজি)
– ‘তুমি আদব বা শিষ্টচার তালাশ কর। কারণ আদব বা শিষ্টাচার হলো বুদ্ধির পরিপূরক, ব্যক্তিত্বের প্রমাণ, নিঃসঙ্গতায় ঘনিষ্ঠ সহচর, প্রবাস জীবনের সঙ্গী এবং অভাবের সময়ের মূল্যবান সম্পদ।’
ভদ্রতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বিশ্বনবি
ঘোর অন্ধকার যুগে মূর্খতা থেকে বিশ্ব মানবতাকে মুক্তি দিতে বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সত্য দ্বীনসহ দুনিয়ায় এসেছেন। তিনি বলেন-
– ‘আমি উত্তম চরিত্রের পূর্ণতা প্রদানের জন্য প্রেরিত হয়েছি।’ (মিশকাত)
– হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বিশ্বনবির উত্তম চরিত্র তথা ভদ্রতা সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন ‘তার চরিত্র হলো কুরআন।’ (আদাবুল মুফরাদ)
– হজরত আনাস ইবনে মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো কাউকে গালি দিতেন না, অশ্লীল ভাষা প্রয়োগ করতেন না এবং কাউকে অভিশাপ দিতেন না। কাউকে তিরস্কার করার প্রয়োজন হলে শুধু এটুকু বলতেন, তার কী হয়েছে! তার কপাল ধুলায় ধূসরিত হোক! (বুখারি ও মিশকাত)
– তিনি আরও বলেন, ‘আমি দীর্ঘ ১০ বছর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সেবায় নিয়োজিত ছিলাম। তিনি আমার ব্যাপারে কখনো উহ শব্দটিও উচ্চারণ করেননি। তিনি কখনো বলেননি, তুমি কেন এটি করেছ কিংবা এটা কেন করোনি।’ (বুখারি, মুসলিম, মিশকাত)
মানুষের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে ভদ্রতা বজায় রাখতে বলেছেন বিশ্বনবি। হাদিসের বর্ণনায় বিশ্বনবি তা তুলে ধরেছেন-
– সালাম বিনিময়ে ভদ্রতা
ইসলাম প্রথমে এবং পরিচিতি-অপরিচিত সবাইকে সালামের নির্দেশ দেয়। ভদ্রতার প্রথম বহিঃপ্রকাশ ঘটে এ সালামের মাধ্যমে। হাদিসে এসেছে- ‘যে ব্যক্তি প্রথমে সালাম দেয়, আল্লাহর কাছে লোকদের মধ্যে সেই উত্তম।’ (আবু দাউদ, মিশকাত)
– হাদিয়া প্রদানে ভদ্রতা
পরস্পরের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন জোরদার করতে একে অপরকে হাদিয়া, উপহার বা উপঢৌকন দেয়া ভদ্রতা বা শিষ্টাচার। বিশ্বনবি বলেন- ‘তোমরা একে অপরকে উপহার দাও এবং বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হও।’ (আদাবুল মুফরাদ)
– হাঁচি কিংবা হাই তোলায় ভদ্রতা
হাঁচি দেয়া, হাই তোলার বিষয়টি বিশ্বনবির চিন্তা-চেতনা থেকে বাদ যায়নি। তাই তিনি হাঁচি দেয়ার সময় তার মুখকে নিজের হাত বা কাপড় দ্বারা আবৃত করেতেন এবং এর মাধ্যমে তার স্বর বন্ধ করতেন। (আবু দাউদ, তিরমিজি)
– হাসি-ঠাট্টায় ভদ্রতা
অনেক বড় আওয়াজে অট্ট হাসি কিংবা চিৎকার চেঁচামেচি করা ভদ্রতা নয়। বরং মুচকি হাসি ও নিরবতাই হলো ভদ্রতার পরিচায়ক। হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন-
‘আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অট্টহাসি দিতে দেখিনি, যাতে তাঁর তালু দেখা যায়। বরং তিনি মৃদু হাসতেন।’ (বুখারি, মিশকাত)
– পরিপাটি থাকায় ভদ্রতা
সুবিন্যস্ত চুল, দাঁড়ি এবং পরিপাটিও ভদ্রতা। বিশ্বনবি সব সময় পরিপাটি থাকতেন। হাদিসে এসেছে-
‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে অবস্থানকালে একটি লোক মাথা ও দাড়ির কেশ অবিন্যস্ত অবস্থায় সেখানে প্রবেশ করল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাত দ্বারা তার দিকে ইশারা করলেন, যাতে সে তার মাথার চুল ও দাঁড়ি পরিপাটি করে। সে ব্যক্তি তা করে ফিরে আসে। অতপর বিশ্বনবি বলেন- ‘শয়তানের মতো তোমাদের কোনো ব্যক্তির উসকু-খুসকু চুলে আসার চেয়ে এটা কি উত্তম নয়?’ (মুয়াত্তা মালেক)
হাসি মুখে কথা বলা ভদ্রতা
পরসপর হাসি মুখে কথা বলাও ভদ্রতা। হাসি কথা বলায় রয়েছে সাদকার সাওয়াব। হাদিসে এসেছে- রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সব সময় মানুষের সঙ্গে হাসি মুখে কথা বলতেন।’ (বুখারি, মুসলিম, তিরমিজি)
রাগ পরিহার করা ভদ্রতা
কারো সঙ্গে রাগ না করাও ভদ্রতা। তাই কারো ভুলে তার প্রতি গোস্বা না হয়ে তা পরিহার করা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাগ না করতে নসিহত করেছেন-
‘এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আরজ করলেন, ‘আমাকে উপদেশ দিন। তিনি বললেন, তুমি রাগ করো না। লোকটি একাধিকবার কথাটা পুনরাবৃত্তি করলেও তিনি প্রত্যেকবারই বললেন, রাগ করো না।’ (বুখারি, তিরমিজি, মিশকাত)
– প্রতিবেশীর সাথে ভালো আচরণ ভদ্রতা
ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ ও রাষ্ট্রে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় এবং সুসম্পর্ক তৈরিতে প্রতিবেশির সঙ্গে সুন্দর আচরণ ও কথা বলা অপরিহার্য। হাদিসে এসেছে-
– ‘যে ব্যক্তি এটা পসন্দ করে যে, আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুল তাকে ভালোবাসুক, সে যেন কথা বললে সত্য বলে, আমানত রাখা হলে তা পূর্ণ করে এবং স্বীয় প্রতিবেশীর সাথে ভাল ব্যবহার করে।’ (বায়হাকি, মিশকাত)
– তিনি আরও বলেন, ‘জিবরিল আলাইহিস সালাম আমাকে প্রতিবেশীর সাথে ভাল ব্যবহার করার জন্য এত বেশি উপদেশ দিতে থাকেন যে, আমি ভেবেছিলাম হয়তো প্রতিবেশীকে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী করে দেয়া হবে।’ (বুখারি, মুসলিম, মিশকাত)
– ভুল সংশোধন করাও ভদ্রতা
কারো মধ্যে কোনো ভুল-ত্রুটি দেখা গেলে তা থেকে নিজেকে সংশোধন করাও ভদ্রতা। আবার কারো মধ্যে কোনো দোষ-ত্রুটি দেখলে তাকে ব্যক্তিগতভাবে বলে দেয়াও ভদ্রতা ও দায়িত্ব। হাদিসে এসেছে-
‘এক মুমিন অপর মুমিনের জন্য আয়না স্বরূপ। এক মুমিন অপর মুমিনের ভাই। তারা একে অপরকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করে এবং তার অনুপস্থিতিতে তাকে রক্ষা করে।’ (আবু দাউদ, মিশকাত)
– খারাপ ধারনা না করা ভদ্রতা
কারো প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ না করা। অযথা কু-ধারণা করা ভদ্রতা নয় বরং গোনাহের কাজ। হাদিসে এসেছে-
‘তোমরা অনুমান করা থেকে সাবধান হও। কেননা অনুমান অবশ্যই সর্বাপেক্ষা বড় মিথ্যা। আর তোমরা অন্যের দোষ অন্বেষণ করো না, গুপ্তচরবৃত্তি করো না, পরস্পরের সাথে ঝগড়া-বিবাদ করো না এবং পরস্পরের সাথে হিংসা করো না। পরস্পরের ক্ষতি করার জন্য পেছনে লেগে থেকো না। আর তোমরা সকলে মিলে আল্লাহর বান্দা হিসাবে ভাই ভাই হয়ে যাও।’ (বুখারি, মুসলিম, মিশকাত)
– অন্যের কল্যাণ কামনা করা ভদ্রতা
এক মুমিন অন্য মুমিনের কল্যাণ কামনা করা। পরস্পরকে নসিহত করা। মানুষের কল্যাণ কামনায় উপদেশ দেয়াও ভদ্রতা। হাদিসে এসেছে-
‘সদুপদেশ দেয়াই হচ্ছে দ্বীন। আমরা (সাহাবায়ে কেরাম) আরজ করলাম, কার জন্য উপদেশ? তিনি বললেন, আল্লাহ ও তাঁর কিতাবের, তাঁর রাসুলের, মুসলিম শাসক এবং মুসলিম জনগণের।’ (বুখারি, মুসলিম, মিশকাত)
– অধীনস্তদের সঙ্গে ভালো আচরণ
বাসা-বাড়ি কিংবা অফিস-আদালতে কর্মরত অধীনস্তদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা। ছোট-খাটো অন্যায় বা সমস্যা তাদের প্রতি রুক্ষ্ম না হওয়া। তাদের হুমকি-ধমকি না দেয়া। তাদের সঙ্গে প্রাণ খুলে হাসি-খুশি মনে কথা বলা ও কুশলাদি বিনিময় করাও ভদ্রতা এবং কল্যাণের কাজ।
এ সবই হচ্ছে মুমিন মুসলমানের জীবনাচার বা চারিত্রিক বৈশিষ্ট। যারা এ বৈশিষ্ট্যে নিজেদের জীবনকে সাজাতে পারবে তারাই সফলকাম। আর এসব কারণেই বিশ্বনবি ভদ্রতা তথা শিষ্টাচারকে নবুয়তি গুণের সঙ্গে তুলনা করেছেন। কেননা আল্লাহ তাআলা বিশ্বনবিকে এ মর্মে সার্টিফিকেট দিয়ে ঘোষণা করেন যে, ‘হে রাসুল! নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী।’ (সুরা ক্বালাম : আয়াত ৪)
আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগে বিশ্বনবির এ গুণেই মুগ্ধ হয়েছিলেন অন্ধকার যুগের মানুষগুলো। যারা এ গুণে মুগ্ধ হয়ে নিজেদেরকে এ গুণেই গুণাম্বিত করেছেনে। তারাই হয়েছেন সর্বকালে সর্বযুগের সেরা মানুষ।
মুসলিম উম্মাহর উচিত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে শিষ্টাচার বা ভদ্রতা বজায় রেখে ইসলামের বিধি-নিষেধগুলো মেনে চলে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিশ্বনবির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে নিজেদের মধ্যে এ গুণের বাস্তবায়ন ঘটানো।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে বিশ্বনবির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অনুসরণ ও অনুকরণের মাধ্যমে সর্বোত্তম শিষ্টাচার বা ভদ্রতা প্রকাশ করার তাওফিক দান করুন। সুন্নাতি জীবন যাপন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।