চাঁদাবাজি করে ৩০০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পত্তির মালিক কালা বাচ্চু
ছিলেন রাজধানীর ফুলবাড়িয়া বাস টার্মিনালের হকার। সেখান থেকে বাসের হেলপার। তারপর ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন বাস টার্মিনালের আতঙ্ক। যোগ দেন সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নে। একদিন প্রভাব খাটিয়ে হয়ে যান সেই সংগঠনেরই সাধারণ সম্পাদক। এরপর থেকে আর কখনো পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। নানা অপরাধের হাত ধরে হয়ে গেছেন পরিবহন শ্রমিকদের শীর্ষ নেতা। গোটা সড়ক পরিবহনখাতে যে কজন রাঘব বোয়ালের নেতৃত্বে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজি হয় ইসমাইল হোসেন বাচ্চু তাদেরই একজন। বাস টার্মিনালের হকার থেকে তিনি হয়ে উঠেছেন গোটা পরিবহনখাতের অপকর্মের মহীরূহ। বানিয়েছেন ৩০০ কোটি টাকারও বেশি অবৈধ সম্পদ। নিজের অপকর্মের বৈধতা পেতে বাগিয়ে নিয়েছেন শাসকদলের নানা পদ-পদবি। একচ্ছত্র চাঁদাবাজি কায়েম করতে গড়ে তুলেছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্যলীগ। চাঁদাবাজিকে নিরঙ্কুশ করতে জড়িয়ে পড়েছেন খুন-অপহরণ, হামলা -মামলাসহ নানা অপরাধে। শাসকদলের ছত্রছায়ায় থাকা এই বেপরোয়া চাঁদাবাজের অত্যাচার-নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন পরিবহনখাতের মালিক-শ্রমিকরা। একাধিক হত্যাকাণ্ডসহ ডজনখানেক ফৌজধারি মামলার আসামি হয়েও সারাদেশের পরিবহনখাতে সন্ত্রাস চাঁদাবাজির রামরাজত্ব চালিয়ে যাচ্ছেন ইসমাইল হোসেন বাচ্চু ওরফে কালা বাচ্চু।
পরিবহন সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, সাধারণ সম্পাদক হয়ে বেপরোয়া চাঁদাবাজি, শ্রমিক নির্যাতন, মালিকদের হামলা-মামলাসহ একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে শ্রমিক ইউনিয়নের তহবিল হাতিয়ে নেন বাচ্চু। এরপর নিজ এলাকার ইউপি চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হয়েছেন। অপকর্মের পাল্লা ভারি হওয়ায় ২০১৭ সালে শ্রমিকদের তোপের মুখে ফুলবাড়িয়া বাস টার্মিনাল থেকে বিতাড়িত হন বাচ্চু। ফলে অবৈধ আয়ের উৎস হারান তিনি। পরে তার ক্যাডার বাহিনী দিয়ে টার্মিনাল দখলের চেষ্টাও করেন। এরপর নিজেই ‘বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্যলীগ’ নামে গড়ে তোলেন আরেক সংগঠন। এই সংগঠনের সদস্য সচিব তিনি। এখন এই সংগঠনেরই নাম ব্যবহার করে পরিবহন খাতে চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ চালিয়ে যাচ্ছেন বাচ্চু। তার এসব কাজের প্রতিবাদ করায় আপন ভাতিজি জামাইকেও খুনের শিকার হতে হয়েছে। আর সেই খুনের সাক্ষী হওয়ায় বাচ্চুর হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে এক ছাত্রলীগ নেতাকেও। সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনেও সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, লুটপাট চালিয়ে ৩০০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক হওয়া ইসমাইল হোসেন বাচ্চু ওরফে কালা বাচ্চুর বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। ওইসব আবেদনে বাচ্চুর অপকর্মের খতিয়ান তুলে ধরে তার বিরুদ্ধে তদন্তের মাধ্যমে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের আরজি জানানো হয়েছে।
চাঁদাবাজি করে অবৈধ সম্পদের পাহাড়
পরিবহনখাতে চাঁদাবাজি করে ৩০০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন এক সময়ের ফুটপাতের হকার ইসমাইল হোসেন বাচ্চু ওরফে কালা বাচ্চু। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের আলকড়া ইউনিয়নের নিজ বাড়িতে একসময় টিনের ঘর ছিলো তার। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে সেই জায়গায়ই দুই কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে বিলাসবহুল ভবন। আলকড়া ইউনিয়ন পরিষদের সামনে বানানো হয়েছে বিশাল মার্কেট যার মূল্য প্রায় ২০ কোটি টাকা। ইউনিয়নের বিভিন্নস্থানে রয়েছে আরো ১০ কোটি টাকার জমি। রাজধানীর বেইলি রোডে রয়েছে ৪ কোটি টাকার বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট। ধানমন্ডির ওরিয়েন্টাল লাঠিমি কমপ্লেক্সের ১৪ তলার ফ্ল্যাটর দাম ৩ কোটি টাকা। রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে রয়েছে ৮ তলা ভবনসহ ২ কোটি টাকা মূল্যের প্লট। বংশালেও রয়েছে ৫ কোটি টাকা মূল্যের বাড়ি, দয়াগঞ্জে ১ কোটি টাকা দামের ফ্ল্যাট। রাজধানীর বঙ্গবাজারসহ বিভিন্নস্থানে অন্তত ২০ টি দোকান রয়েছে বাচ্চুর মালিকানায়। যার মূল্য প্রায় ১৫ কোটি টাকা। ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা জমা রেখে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের পরিচালক পদও দখল করেছেন পরিবহন খাতের এই মাফিয়া। রয়েছেন আদর্শ হকার্স মার্কেটের পরিচালক পদেও। নিজে ও পরিবারের সদস্যরা চলেন বিলাসবহুল দুই গাড়িতে। যার মূল্য প্রায় ১ কোটি টাকা। তুষার পরিবহনের ব্যানারে চলে কালা বাচ্চুর মালিকানাধীন ১০ টি বাস। যার দাম প্রায় ২ কোটি টাকা। এভাবে নামে বেনামে আরো অঢেল অবৈধ সম্পত্তির মালিক বাচ্চু। আমেরিকায় ছেলের নামেও পাচার করেছেন কোটি কোটি টাকা। পাচারকৃত সেই অর্থ দিয়ে সেখানে কেনা হয়েছে ১০ কোটি টাকা দামের পেট্রল পাম্প।
শ্রমিকদের ৪০ কোটি টাকা আত্মসাত
পরিবহন শ্রমিকদের ৪০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগও রয়েছে বাচ্চুর বিরুদ্ধে। ঢাকা জেলা সড়ক পরিবহন যানবাহন শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক থাকাকালে শ্রমিকদের ৪০ কোটি টাকার তহবিল লুট করেছেন এই তথাকথিত পরিবহন শ্রমিক নেতা।
হত্যাকাণ্ডসহ ডজনখানেক মামলার আসামি বাচ্চু
একাধিক হত্যাসহ ডজনখানেক ফৌজধারি মামলা রয়েছে পরিবহনখাতের এই মাফিয়া ডন কালা বাচ্চুর বিরুদ্ধে। গ্রেফতারের পর জেলও খেটেছেন কয়েকটি মামলায়। কিন্তু নানা তদবিরে শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে আসছেন আইনের ফাঁক গলিয়ে। ২০১১ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত চৌদ্দগ্রাম থানার আলকড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন বাচ্চু। এ সুবাদে এলাকায়ও তার ছিলো একচ্ছত্র আধিপত্য। সেখানে তার অপকর্মের প্রতিবাদ করলেই সন্ত্রাসী বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে হামলা চালানো হতো। এলাকার বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানসহ অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করেন তিনি। তার এমন চাঁদাবাজি থেকে রেহাই পায়নি আওয়ামী লীগ, যুবলীগ এমনকি আপন ভাতিজি জামাইও। ২০১৫ সালে শেষের দিকে বাচ্চু তার বড় ভাইয়ের মেয়ের জামাই ও আলকড়া ইউনিয়নের যুবলীগের সভাপতি ও বাস মালিক জামাল উদ্দিন ওরফে বাক্কা’র পাওয়া একটি উন্নয়ন কাজ থেকে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। চাঁদা না দেওয়ায় বিজয় করা স্কুল অ্যান্ড কলেজের মেরামত কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ বিষয়ে বাক্কা বাদী হয়ে ওই বছরের ৩০ নভেম্বর কুমিল্লার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বাচ্চুর বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন। এতে ক্ষিপ্ত হন বাচ্চু। পরে বেশ কয়েকবার হামলাও করা হয় বাক্কার ওপর। এর একমাস পর ২০১৬ সালের ৮ জানুয়ারি রাতে প্রকাশ্যে গুলি করে বাক্কাকে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনায় ইসমাইল হোসেন বাচ্চুকে প্রধান আসামি করে বাক্কার বড় বোন ও বাচ্চুর ভাতিজি জোহরা আক্তার বাদী হয়ে ১০ জানুয়ারি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। পরে ওই মামলায় তাকে গ্রেফতারও করা হয়েছিলো। বাক্কার কাছে চাঁদা চাওয়ার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় সাক্ষী হওয়ায় স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা সাজ্জাদ হোসেন শাকিলকেও (১৮) সন্ত্রাসী বাহিনী লাগিয়ে খুন করার অভিযোগ রয়েছে বাচ্চুর বিরুদ্ধে। শাকিল ছিলেন ওই মামলার ৯ নম্বর সাক্ষী। তিনি খুন হন ২০১৮ সালের ৮ অক্টোবর চৌদ্দগ্রাম থানার কচুয়া রাস্তার মাথায়। এই মামলায় বাচ্চু এক নম্বর আসামি হলেও পরবর্তীতে প্রভাবশালী একজন মন্ত্রীর তদবিরে তাকে মামলার চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়া হয় বলে অভিযোগ করেছেন বাক্কা হত্যা মামলার বাদী জোহরা আক্তার। এসব অপরাধের দায়ে বাচ্চুকে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি থেকেও বহিষ্কার করা হয়। এছাড়াও রাজধানীর হাজারীবাগ, শাহ আলী, যাত্রাবাড়ী, পল্টন মডেল থানায়ও একাধিক মামলা রয়েছে বাচ্চুর বিরুদ্ধে।
চোরাচালান, ক্যাসিনো, মাদক ব্যবসার অভিযোগ
ইসমাইল হোসেন বাচ্চু ওরফে কালা বাচ্চুর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ যেমন রয়েছে তেমনি চোরাকারবার, ক্যাসিনো ও মাদক ব্যবসা, টেন্ডারবাজির অভিযোগও রয়েছে। চৌদ্দগ্রামের আলকড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান থাকাকালে বিভিন্ন লোকের নাম ভাঙ্গিয়ে সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি, চোরাচালান করে অনেক অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন। ইউনিয়নটি ভারত সীমান্তে হওয়ায় কালা বাচ্চু দীর্ঘদিন ধরে অস্ত্র, মাদক ও চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত বলে দুদকে অভিযোগ করা হয়েছে।