সিএএ, দিল্লির দাঙ্গা নিয়ে ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক চাপে ভারত
মুসলিম-বিদ্বেষী সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট (সিএএ) এবং পরে দিল্লিতে যে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড নিয়ে নরেন্দ্র মোদি সরকার যদি বিভিন্ন দেশ ও জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের (ইউএনএইচআরসি) মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর উদ্বেগের বিষয়টি একইভাবে নাকচ করে যেতে থাকে তাহলে এগুলোর ব্যাপারে ভারত সরকারের উপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়তেই থাকবে। অস্বাভাবিকভাবে এগিয়ে গিয়ে এবার আইনি পদক্ষেপ নিয়েছে ইউএনএইচআরসি।
বিদেশের উদ্বেগের বিষয়গুলোকে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপ হিসেবে উল্লেখ করে সেগুলোকে বাতিল করে আসছে নয়াদিল্লি। কিন্তু এ ধরনের নাকচ করে দেয়ার প্রবণতা শুধু অহংকারের বহিঃপ্রকাশই নয়, বরং যে দেশটি নিজেকে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্বশীল সদস্য হিসেবে দাবি করে, তার জন্য এটা খুবই বেমানান।
এটা সত্য যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক ভারত সফরের সময় তার স্বীকৃতি পেয়েছেন মোদি। কিন্তু জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার মিশেল ব্যাচলেট এই ইস্যুতে ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন, যেটা মোদি সরকারকে বিপদে ফেলে দিয়েছে।
মঙ্গলবার ব্যাচলেট ভারতের সর্বোচ্চ আদালতে দায়ের করা সিএএ বিষয়ক একটি মামলায় ‘ইন্টারভেনশান আবেদন’ করেছেন। ওই মামলাটি দায়ের করেন ভারতের অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিক দেব মুখার্জি। ভারত যেভাবে নাগরিকত্ব ইস্যু নিয়ে কাজ করছে এবং এর কারণে যে সহিংসতা ঘটছে, সেটা নিয়ে নিন্দা জানিয়েছে মালয়েশিয়া, ইরান, ইন্দোনেশিয়া, ও পাকিস্তানের মতো মুসলিম সংখ্যাগুরু দেশগুলো, এবং অর্গানাইজেশান অব ইসলামিক কোঅপারেশান (ওআইসি)।
বাংলাদেশে ভারত-পন্থী হাসিনা সরকার বলেছে যে, সিএএ এবং সহিংসতা ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। কিন্তু ১৭ মার্চ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে মোদিকে যে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, সেটার বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ করছে বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও নাগরিক গ্রুপ।
ইউএনএইচআরসি’র আইনি তৎপরতার বিস্তারিত
ভারতের আইন বিষয়ক ওয়েবসাইট www.livelaw.in তে বলা হয়েছে যে, মিশেল ব্যাচলেট যে ইন্টারভেনশান আবেদন করেছেন, সেখানে বলা হয়েছে যে, জাতিসংঘের এই সংস্থা এ বিষয়ে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে যুক্ত হতে চায়, যেহেতু সকল মানবাধিকারকে সুরক্ষা করা এবং সেগুলোকে এগিয়ে নেয়ার জন্য তাদের অনুমোদন রয়েছে। তাই জাতিসংঘের জেনারেল অ্যাসেম্বলি প্রস্তাবনা ৪৮/১৪১ অনুসারে তারা এ ব্যপারে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতে চায়।
আবেদনে বলা হয়েছে যে, অফিস অব দ্য হাই কমিশনার অব হিউম্যান রাইটস (ওএইচসিএইচআর) বলেছে যে, ২০১৯ সালের সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের ব্যাপারে এবং অভিবাসী, বিশেষ করে শরণার্থীদের বিষয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সৃষ্টি করেছে।
ইন্টারন্যাশনাল কোভেন্যান্ট অন সিভিল অ্যাণ্ড পলিটিক্যাল রাইটস (আইসিসিপিআর), ইন্টারন্যাশনাল কোভন্যান্ট অন ইকোনমিক অ্যাণ্ড সোশাল রাইটস (আইসিইএসআর) এর প্রতি ইঙ্গিত করে আবেদনকারী বলেছেন: “আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের অধীনে, রাষ্ট্র অবশ্যই তাদের সীমানা বা কর্তৃত্বাধীন এলাকার মধ্যে অভিবাসীদেরকে শ্রদ্ধা করবে এবং এটা নিশ্চিত করবে যাতে তাদের সাথে কোন বৈষম্যমূলক আচরণ করা না হয়, তা তাদের আইনি মর্যাদা যা-ই হোক না কেন বা তাদের কাছে যা-ই কাগজপত্র থাক না কেন”।
“এই সব আইনের অধিকারের বিষয়টি শুধু রাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে সীমিত নয়, বরং প্রতিটি ব্যক্তি – তা সেই ব্যক্তি অন্য রাষ্ট্রের হোক বা রাষ্ট্রহীন হোক, আশ্রয়প্রার্থী হোক, শরণার্থী, অভিবাসী শ্রমিক বা অন্য কোন পরিচয়ের হোক – তাদের সবারই এই অধিকার রয়েছে”।
তাছাড়া, “রাষ্ট্রকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যাতে নাগরিকত্বের ব্যাপারে তার আইন, নীতি, এবং কর্মকৌশল আইসিসিপিআরের ২৬ অনুচ্ছেদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। এখানে অভিবাসীদেরকে সমান সুরক্ষা দিতে হবে এবং ধর্মীয় পরিচয়সহ সকল বৈষম্য থেকে রক্ষা করতে হবে”।
এই বিষয়ে আবেদনে বলা হয়েছে যে, কিছু সম্প্রদায়ের লোককে ফেরত পাঠানোর ঝুঁকি কমিয়ে আনার মাধ্যমে সিএএ সমানভাবে অন্যান্য সম্প্রদায়কে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিয়েছে।
ওএইচসিএইচআর বলেছে, “সিএএতে যে সীমিত সুযোগ রাখা হয়েছে, যেখানে শুধুমাত্র ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে, এবং যে সুযোগ সুনির্দিষ্ট জাতিগত-ধর্মীয় গোষ্ঠির জন্য সীমিত রাখা হয়েছে, সেটা যথেষ্ট বস্তুনিষ্ঠ ও যুক্তিগ্রাহ্য নয়, বিশেষ করে যেখানে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে বড় পরিসরে অভিবাসীদের ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে”।
এই পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘের এই সংস্থাটি বলেছে যে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের অধীনে ভারতের যে দায়িত্ব রয়েছে, সেগুলোর আলোকে সিএএ ভারতের সংবিধানের সাথে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ, সেটা নির্ধারণের ব্যাপারে আদালতকে সাহায্য করতে চায় সংস্থাটি। তারা বলেছে যে, সংস্থাটি আদালতের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে যাতে আদালত জাতিসংঘ এবং তাদের মানবাধিকার মেকানিজমের সমন্বিত অভিজ্ঞতাকে মূল্যায়ন করে”।
ডিসেম্বরে সিএএ পাস হওয়ার পরপরই ইউএনএইচআরসি এক বিবৃতি প্রকাশ করে বলেছিল: “ভারতের নতুন সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট ২০১৯ প্রকৃতিগতভাবেই বৈষম্যমূলক হওয়ায় আমরা এটা নিয়ে উদ্বেগ জানাচ্ছি”।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে পার্লামেন্ট সিএএ পাস করে। এই আইনে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে আসা অমুসলিম অভিবাসীদেরকে ভারতের নাগরিকত্ব দেয়ার বিধান রাখা হয়েছে।
বিভিন্ন দেশের প্রতিবাদ
২৭ ফেব্রুয়ারি অর্গানাইজেশান অব ইসলামিক কোঅপারেশান (ওআইসি) ভারতের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যাতে সহিংস ঘটনার সাথে জড়িত ও এর উসকানিদাতাদেরকে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা হয়। একই সাথে সংস্থাটি সকল মুসলিম নাগরিকের নিরাপত্তা এবং দেশের বিভিন্ন জায়গায় অবস্থিত ইসলামের পবিত্র স্থানগুলোর সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য কর্তৃপক্ষের প্রতি জোর দাবি জানিয়েছে। মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ সহিংসতার নিন্দা করেছেন। এক টুইটে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ ভারতীয় মুসলিমদের বিরুদ্ধে ‘সঙ্ঘবদ্ধ সহিংসতার’ নিন্দা করেন।
তিনি টুইটে লিখেছেন, “ভারতের মুসলিমদের বিরুদ্ধে যে সঙ্ঘবদ্ধ সহিংসতার প্রবণতা চলছে, ইরান সেটার নিন্দা জানাচ্ছে”। জারিফ বলেছেন, “বহু শতাব্দি ধরে ইরান ভারতের বন্ধু ছিল। আমরা ভারতের কর্তৃপক্ষের প্রতি জোর দাবি জানাচ্ছি যাতে তারা সকল ভারতীয়ের কল্যাণ নিশ্চিত করেন এবং কাণ্ডজ্ঞানহীন গুন্ডামি টিকতে না দেন। শান্তিপূর্ণ সংলাপ এবং আইনের শাসনের মধ্য দিয়েই আগামীর পথ প্রশস্ত হবে”।
পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া ও তুরস্কও দিল্লির দাঙ্গার নিন্দা করেছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেছেন যে, ভারত তাদের ২০০ মিলিয়ন মুসলিমকে টার্গেট করেছে। জরুরি ভিত্তিতে এখানে হস্তক্ষেপ করার জন্য তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান।