বাণিজ্যের আড়ালে লাখ কোটি টাকা পাচার
আমদানির সময় পণ্যমূল্য বাড়িয়ে এবং রপ্তানির সময় কম দেখিয়ে বাংলাদেশ থেকে বছরে পাচার হচ্ছে ১১ বিলিয়ন ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ৯৮ হাজার কোটি টাকা। দেশের মানুষের কাছ থেকে সরকার চলতি অর্থবছর জুড়ে যে পরিমাণ মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আদায়ের পরিকল্পনা করেছে, পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ তার চেয়ে ১২ হাজার কোটি টাকা বেশি।
ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) গতকাল এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলেছে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ বহির্বিশ্বের সঙ্গে করা আমদানি-রপ্তানি পণ্যের প্রকৃত মূল্যের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের দেখানো মূল্যের ব্যবধান ১১৫১ কোটি ডলার বা ৯৮ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ আমদানি-রপ্তানির আড়ালে এ পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা।
২০০৮ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১৩৫টি উন্নয়নশীল দেশ ও ৩৬টি উন্নত দেশ থেকে আমদানি-রপ্তানির আড়ালে কী পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে, তা নিয়ে ‘১৩৫ উন্নয়নশীল দেশের বাণিজ্য সংক্রান্ত অর্থপাচার : ২০০৮-২০১৭’ শিরোনামে করা প্রতিবেদনে সংস্থাটি বলেছে, বাংলাদেশ বিশ্বের ১৭০টি দেশের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি করছে। এসব দেশ থেকে বাংলাদেশের আমদানি করা পণ্যমূল্য ও এসব দেশে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি করা পণ্যমূল্য এবং ওইসব পণ্যের প্রকৃত মূল্যের ফারাক বের করে এ তথ্য জানিয়েছে। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের আমদানি-রপ্তানির ২২ হাজার ৯৫০টি তথ্য যাচাই-বাছাই করে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে সংস্থাটি। জিএফআইয়ের তথ্য অনুযায়ী ২০১৫ সালে বাংলাদেশ যে পরিমাণ আমদানি-রপ্তানি করেছে, তার সঙ্গে বিশ্ববাজারে ওইসব পণ্যমূল্যের ব্যবধান ২০১৫ সালে ছিল ১৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ। আর ১০ বছরের গড় হিসাবে এর হার ১৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ।
গত ২০১৮-১৯ অর্থবছর বাংলাদেশ ৪০ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, আমদানি করেছে ৪৪ দশমিক ০২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। অর্থাৎ গত অর্থবছর ৮৪ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক বাণিজ্য করেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ১৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ মূল্য গোপন করে পাচার হলে তার পরিমাণ দাঁড়ায় ১৫ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় এটি প্রায় ১ লাখ ২৯ হাজার কোটি টাকা।
২০০৮ থেকে ২০১৭ সময় পর্যন্ত ১০ বছরের তথ্য ধরে প্রতিবেদনটি করা হলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ২০১৪, ২০১৬ ও ২০১৭ সালের কোনো তথ্য পায়নি জিএফআই। তবে বাকি সাত বছরে গড়ে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি পণ্যমূল্যের সঙ্গে প্রকৃত মূল্যের ব্যবধান ৭৫৩ কোটি ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকা। বছরভিত্তিক তথ্য অনুযায়ী, আমদানি-রপ্তানির নামে ২০১৩ সালে এটি ছিল ৮৮২ কোটি ডলার, ২০১২ সালে ৭১২ কোটি ডলার, ২০১১ সালে ৮০০ কোটি ডলার, ২০১০ সালে ৭০৮ কোটি ডলার, ২০০৯ সালে ৪৮৯ কোটি ডলার ও ২০০৮ সালে ৫২৮ কোটি ডলার পাচার হয়েছে।
রপ্তানির আড়ালে অর্থপাচার সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় বাংলাদেশ ব্যাংক ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যেও। এর মধ্যে রপ্তানির পর তার মূল্য বাবদ যে অর্থ বাংলাদেশে আসে, তার হিসাব রাখে বাংলাদেশ ব্যাংক। অন্যদিকে কোন সময় কোন পণ্য কী মূল্যে রপ্তানি হচ্ছে, সে হিসাব রাখে ইপিবি। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছর বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয়েছে ৪০ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, গত অর্থবছর পণ্য রপ্তানিমূল্য বাবদ দেশে এসেছে ৩৫ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার। সরকারের দুই সংস্থার হিসাবের ব্যবধান ৫ বিলিয়ন ডলার, যার পরিমাণ প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮৫ শতাংশই আয় করে তৈরি পোশাক থেকে। জিএফআই বলছে, বিভিন্ন ধরনের তৈরি পোশাকের বাণিজ্যে মূল্য হেরফের করে পাচার হয় ১৮ থেকে ২০ শতাংশ মূল্য। এর মধ্যে অ্যাপারেলে ১৯ শতাংশ, নিটওয়্যারে ১৯ দশমিক ৩ শতাংশ অর্থপাচার হয়। আর বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি ও মেশিনারি আমদানির সময় পাচার হয় ১৮ দশমিক ৮ শতাংশ।
ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশ অর্থপাচার রোধে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বেশ কিছু নীতিতে স্বাক্ষর করেছে, দেশেও অর্থপাচার প্রতিরোধ আইন কঠোর করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তাদের দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। এখন বাণিজ্যের নামে অর্থপাচার প্রতিরোধে এসব সক্ষমতা প্রয়োগের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। আর এ সংস্থা দুটির কর্মকর্তাদের মধ্যেই যদি সুশাসনের ঘাটতি দেখা যায়, সেক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশন কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে।
আমদানি-রপ্তানির নামে অর্থপাচার বন্ধে বাজেটে বিভিন্ন পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারদর নিয়ে একটি তথ্যভা-ার গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। তবে এখনো এ ধরনের কোনো তথ্যভা-ার গড়ে তুলতে পারেনি এনবিআর। তবে সমুদ্রবন্দর ও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে স্ক্যানিং বসানো হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি-রপ্তানি কমবে বলে আশা করেছেন অর্থমন্ত্রী। এর আগে আমদানির নামে অর্থপাচার বন্ধে পিএসআই (প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশন) কোম্পানি নিয়োগ দিয়েছিল এনবিআর। তাদের কাজ ছিল বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা বিদেশ থেকে কোনো পণ্য আমদানির সময় ওই দেশে গিয়ে পণ্য ও পণ্যমূল্যের সঠিকতা যাচাই করে সনদ দেবে। তবে তাতেও অর্থপাচার বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। এ প্রসঙ্গে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, পিএসআই কোম্পানি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সমস্যা থাকায় তা সফল হয়নি।
জিএফআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ১০ বছরে পণ্যমূল্য হেরফের করে বিশ্বজুড়ে অবৈধভাবে পাচার হয়েছে ৮ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন ডলার। শুধু ২০১৭ সালেই এর পরিমাণ ৮১৭ বিলিয়ন ডলার। দেশের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সহ-সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ২০১৫ সালে ৯৮ হাজার কোটি টাকা পাচারের তথ্য ভয়াবহ। তবে জিএফআই কোন উৎস থেকে এই তথ্য সংগ্রহ করেছে, তার ওপর এর সত্যতা নির্ভর করে। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বাংলাদেশের তফসিলি ব্যাংকগুলো থেকে তথ্য নিয়ে এ হিসাব করে থাকলে তা বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ ব্যাপার। আর অন্য কোনো উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করলে তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে আমাদের মধ্যে সংশয় রয়েছে।
প্রতিবেদনটিতে জিএফআইয়ের প্রেসিডেন্ট ও সিইও টম কার্ডামুন বলেছেন, উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের বৈদেশিক বাণিজ্যে লেনদেনের তাৎপর্যপূর্ণ একটি অংশ হারাচ্ছে। ২০১৭ সালে বিশ্বজুড়ে মিসইনভয়েসিং বা প্রকৃত মূল্যের ১৮ শতাংশ গোপন করেছেন ব্যবসায়ীরা। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা সম্ভব না হলে ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন (এসডিজি) সম্ভব হবে না।
টাকার অঙ্কে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে গত ১০ বছরে সবচেয়ে বেশি পাচার হয় চীন থেকে, যার পরিমাণ ৩২৩ বিলিয়ন ডলার। পরের অবস্থানে রয়েছে মেক্সিকো, রাশিয়া, পোল্যান্ড ও মালয়েশিয়া। আর শতকরা হিসাবে সবচেয়ে বেশি পাচার হয় আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া থেকে, যার পরিমাণ ৩৭ দশমিক ৩ শতাংশ। পরের তালিকায় রয়েছে টোগো, মালদ্বীপ, মালাউ ও বাহামা দ্বীপপুঞ্জ।