মন্দ ঋণে ঝুঁকিতে ৮ ব্যাংক
>> ব্যাংক খাতে ঋণ বিতরণ ১০ লাখ ১১ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা
>> খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা
>> ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪২০ কোটি
>> সুবিধা দিয়ে সরকার খেলাপিদের পক্ষ নিয়েছে : ইব্রাহিম খালেদ
ঋণ নিয়ে ফেরত দিচ্ছে না। নিয়মিত বাড়ছে মন্দ ঋণের পরিমাণও। সর্বশেষ ফলাফল, চরম ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, দেশের সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মোট আটটি ব্যাংকের অবস্থা খুবই নাজুক। কারণ এসব ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের প্রায় ২০ থেকে ৯৮ শতাংশই মন্দ ঋণ বা ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ।
ওই আট ব্যাংকের মধ্যে কয়েকটির আবার বিতরণ করা ঋণের ৮০ থেকে ৯৭ শতাংশই অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। এসব ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা-সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে ব্যাংকগুলো।
মূলত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়মের কারণেই এমনটি হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনিয়ম দূর করে ব্যাংকগুলোতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে যারাই অনিয়মের সঙ্গে জড়িত বিশেষ করে প্রভাবশালী ঋণখেলাপি, তাদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে, যেন তা একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখা হয়।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের মতে, বড় বড় জালিয়াতি, অর্থ আত্মসাতের ঘটনাসহ নানা অনিয়মের মাধ্যমে বিতরণ করা ঋণ আদায় হচ্ছে না। ফলে, ঋণখেলাপির সংখ্যা বাড়ছে। অন্যদিকে, খেলাপি হলেও মিলছে নানা সুযোগ-সুবিধা। সুদ মওকুফ, পুনঃতফসিল, পুনর্গঠন, স্বল্প সুদে ঋণ, অবলোপনসহ বিভিন্ন প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, প্রভাবশালীদের চাপে অনিচ্ছা সত্ত্বেও এসব সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এত সব সুবিধা দেয়ার পরও মন্দ ঋণের বড় ঝুঁকিতে পড়েছে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক।
ব্যাংকগুলোর মধ্যে সুশাসন নিশ্চিতের দায়িত্বে থাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে ঋণ বিতরণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ১১ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা, যা ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে ছিল ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। অর্থাৎ বছর ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪২০ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ডিসেম্বর প্রান্তিকে মোট খেলাপি ঋণের ৮১ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা বা ৮৬ দশমিক ৮০ শতাংশ মন্দ বা ক্ষতিজনক ঋণ। যা এক বছর আগে ছিল ৮০ হাজার ১১৬ কোটি টাকা বা ৮৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ডিসেম্বর শেষে সরকারি-বেসরকারি আটটি ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের প্রায় ২০ থেকে ৯৮ শতাংশ মন্দ বা ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ। এর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে রয়েছে বিদেশি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান (এনবিপি)। ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের মধ্যে ৯৭ দশমকির ৭ শতাংশই মন্দ বা ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ। এরপরই রয়েছে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক।
ব্যাংকটির বিতরণ করা ৮৪৫ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ৭০১ কোটি অর্থাৎ ৮২ দশমিক ৯৭ শতাংশ ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ। মন্দ ঋণের বড় ঝুঁকিতে রয়েছে চতুর্থ প্রজন্মের পদ্মা ব্যাংক (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক)। ব্যাংকটির বিতরণ করা পাঁচ হাজার ৫১৯ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে প্রায় তিন হাজার ৬০০ কোটি অর্থাৎ ৬৫ দশমিক ২৩ শতাংশ মন্দ ঋণ।
ঋণ ঝুঁকির শীর্ষে থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে অন্যতম বেসিক ব্যাংক। ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটি ১৪ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। এর মধ্যে সাত হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা অর্থাৎ ৫০ দশমিক ৫৯ শতাংশ ঋণই মন্দ। এছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা-সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে বেসিক ব্যাংক। ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা।
সরকারি মালিকানাধীন বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল) ডিসেম্বর পর্যন্ত ঋণ বিতরণ করেছে এক হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা, যার ৪৭ দশমিক ২১ শতাংশ মন্দ ঋণে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ কর্মাস ব্যাংকের দুই হাজার ২০৫ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ৪৪ দশমিক ৯২ শতাংশ অর্থাৎ ৯৯০ কোটি টাকা ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ। এছাড়া প্রয়োজনীয় ৫৩৮ কোটি টাকা প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি।
মন্দ ঋণের বড় ঝুঁকিতে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত আরও দুটি ব্যাংক, সোনালী ও জনতা। এর মধ্যে ডিসেম্বর পর্যন্ত জনতা ব্যাংক ঋণ বিতরণ করেছে ৪৯ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা। ব্যাংকটির মন্দ ঋণের পরিমাণ ১৩ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা অর্থাৎ মোট ঋণের ২৭ দশমিক ১ শতাংশই ঝুঁকিপূর্ণ।
অপরদিকে, ডিসেম্বর শেষে সোনালী ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ১৫৬ কোটি টাকা। আলোচিত সময়ে সোনালী ব্যাংক মোট ৪৮ হাজার ৮৬২ কোটি ৯৬ লাখ টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। এর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ নয় হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। যা মোট বিতরণ ঋণের ১৯ দশমিক ৩২ শতাংশ।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংকগুলো যাচাই-বাছাই না করেই ঋণ দিয়েছে। নানা সুবিধা দিয়ে নিয়মিত করা ঋণগুলো ঠিক মতো আদায়ও করতে পারছে না। ফলে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। যার বেশির ভাগই ঝুঁকিপূর্ণ। নিয়ম অনুযায়ী, খেলাপি ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে প্রভিশন রাখতে হয়। এটি রাখতে ব্যর্থ হলে ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে পড়ে।
তিনি বলেন, ঋণের ঝুঁকি কমাতে হলে আদায় বাড়াতে হবে। সঠিক নিয়মে খেলাপি কমাতে হবে। সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। যারা অনিয়ম করবে তাদের দৃশ্যমান শাস্তির আওতায় আনতে হবে। বিশেষ করে প্রভাবশালী খেলাপিদের। কারণ তাদের শাস্তির আওতায় আনলে ছোট খেলাপিরাও সতর্ক হয়ে যাবে। ঋণ পরিশোধ করবে।
‘সরকারি ব্যাংকে অনিয়ম বেশি হয়’ উল্লেখ করে সাবেক এ গভর্নর আরও বলেন, ‘সরকারি ব্যাংকগুলোর অনিয়মের মূল কারণ হলো, তাদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা কম। তাই এসব ব্যাংককে অতিরিক্ত সার্পোট (সমর্থন) না দিয়ে ঋণ আদায়ের ওপর চাপ দেয়া জরুরি। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারিতা বাড়ানো উচিত বলে মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ।
অর্থনীতির বিশ্লেষকদের সমালোচনা সত্ত্বেও সরকারের চাপে বিশেষ সুবিধার সুযোগ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অর্থমন্ত্রীর সুপারিশে গত বছরের ১৬ মে ঋণ পুনঃতফসিল ও এককালীন এক্সিট-সংক্রান্ত বিশেষ নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে মন্দমানে খেলাপি ঋণ মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টের বিপরীতে ১০ বছরের জন্য পুনঃতফসিলের সুবিধা দেয়া হয়। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সুদহারের সীমা ঠিক করে দেয়া হয় ৯ শতাংশ। পুনঃতফসিলের আগে গ্রাহককে সুদ মওকুফের সুবিধাও দেয়া হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ডিসেম্বর পর্যন্ত এ সুবিধার আওতায় বিভিন্ন ব্যাংকে আবেদন করেছেন ১৩ হাজার ৩৬৮ ঋণখেলাপি গ্রাহক। এর মধ্যে সুবিধা নিয়েছেন ছয় হাজার ৬৩২ জন। যার পুনঃতফসিল ও এককালীন এক্সিট সুবিধাপ্রাপ্ত ঋণের পরিমাণ ১৪ হাজার ১৪৪ কোটি টাকা। এ ঋণের সুবিধা দিয়ে ডাউন পেমেন্ট আদায় হয়েছে ৪৪০ কোটি টাকা। আর সুদ মওকুফ হয়েছে সাত হাজার ৯৮ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ঋণখেলাপিদের ধরা সহজ নয়। কারণ তারা সমাজ ও রাষ্ট্রে শক্ত অবস্থান করে নিয়েছে। বিশেষ সুবিধা দিয়ে সরকার ঋণখেলাপিদের পক্ষ নিয়েছে। এসব সুযোগ-সুবিধা দিয়ে আগেও কোনো লাভ হয়নি, আগামীতেও লাভ হবে না বরং খারাপ হবে।
তিনি বলেন, খেলাপি কমাতে হলে আসল জায়গায় হাত দিতে হবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঠিক নিয়মে কাজ করতে হবে। খেলাপিদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে এ ধরনের সুযোগ ভবিষ্যতে ভয়াবহ পরিস্থিতি ডেকে আনবে।