জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম, বিদ্রোহ করব
২৫ মার্চ তারিখে পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকা শহরের বিভিন্ন জনপদে, ছাত্রাবাসে, রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে ভয়াবহ গণহত্যা চালায়। নিহত হয় অসংখ্য ছাত্র, শিক্ষক, পুলিশ, ইপিআর সৈনিক ও সাধারণ মানুষ। আমরা এই হত্যাকা- সম্পর্কে কোনো সংবাদই পাইনি। ২৬ মার্চ চট্টগ্রামে ইস্ট বেঙ্গল, জয়দেবপুরে ২য় ইস্ট বেঙ্গল, ব্রাহ্মনবাড়িয়ায় ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল, ২৮ মার্চ সৈয়দপুরে ৩য় ইস্ট বেঙ্গল গণহত্যার প্রতিবাদে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং প্রতিরোধ সংগ্রামে লিপ্ত হয়। চট্টগ্রামে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের উপ-অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমান কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। আশ্চর্যের বিষয় সীমান্ত এলাকার গন্ডগ্রামে অবস্থান করার কারণে এসব চাঞ্চল্যকর ঘটনা সম্পর্কে আমরা কিছুই জানতে পারিনি।
সাবেক মন্ত্রী, বীর মুক্তিযোদ্ধা হাফিজ উদ্দিন আহমদ বীর বিক্রম তার সদ্য প্রকাশিত ‘সৈনিক জীবন: গৌরবের একাত্তর, রক্তাক্ত পঁচাত্তর’ বইতে এসব কথা লিখেছেন। আত্মজৈবনিক বইটি প্রকাশিত হয়েছে প্রথমা থেকে। এতে হাফিজ উদ্দিন আহমদ আরো লিখেছেন, ২৯ মার্চ বেতার মারফত নির্দেশ পেলাম যশোর সেনানিবাসে ফির আসার জন্য।
৩০ মার্চ ’৭১। সকাল সাড়ে সাতটায় ১০৭ ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার আবদুর রহিম দুররানি ১ম ইস্ট বেঙ্গলে এসে সিও লে. কর্নেল জলিলকে জানালেন যে এই মুহূর্ত থেকে ব্যাটালিয়নকে নিরস্ত্র করা হলো। সৈনিকেরা কোনো অস্ত্র বহন করতে পারবে না। আদেশ জারি করেই তিনি ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে চলে গেলেন। আমার ব্যাটম্যান দৌড়ে এসে অফিসার মেসে আমাকে জানায়, ‘স্যার, আমাদের নিরস্ত্র করা হয়েছে। একটু পরই বালুচ অফিসার এসে আমাদের কোতের (অস্ত্রাগার) চাবি নিয়ে যাবে।’ হতভম্ব হয়ে গেলাম! একজন সৈনিকের অস্ত্র কেড়ে নেওয়া চরম অবমাননার শামিল। সেকেন্ড লে. আনোয়ার আমার রুমেই ছিল। তাকে এ খবর জানাতেই সে উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘স্যার, পাকিস্তান আর্মিতে আর চাকরি করব না। আমি অফিসে গিয়েই সিওর সামনে বেল্ট খুলে পদত্যাগ করব।’ ‘চলো, আগে অফিসে যাই, হারি আপ।’ শান্তভাবে বললাম। পাশের রুমে তিনজন পাঞ্জাবি অফিসার নিসার, নাজির, ইকরামকে নিরস্ত্র করার খবর জানালাম। তারাও অবাক হলো। বললাম, চলো, সবাই অফিসে যাই।
আমরা পাঁচজন ইউনিফর্ম পরে দ্রুত অফিস অভিমুখে ছুটলাম। অফিস এলাকায় প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই শুনতে পেলাম বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রের অবিশ্রান্ত গুলিবর্ষণ, ট্যা-টা, ঠা-ঠা-ঠা। দৌড়ে সিওর অফিসরুমে ঢুকলাম আমরা। তিনি উদভ্রান্তভাবে পায়চারি করছেন, দুচোখ থেকে অবিরল ধারায় অশ্রু ঝরছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘স্যার, হোয়াট হ্যাপেন্ড (কী হয়েছে)?’
‘উই হ্যাভ বিন ডিসআর্মড (আমাদের নিরস্ত্র করা হয়েছে)।’ তাঁর জবাব। এ সময় দৌড়ে রুমে এলেন সুবেদার মেজর আজিম খান, ‘স্যার, গজব হো গিয়া। জওয়ানেরা কোত ভেঙে হাতিয়ার বের করে নিয়ে পার্শ্ববর্তী ইঞ্জিনিয়ার কোম্পানির (পাঞ্জাবি) ওপর গুলিবর্ষণ করছে। বাঘাওয়াত হো গিয়া (বিদ্রোহ করেছে আমাদের জওয়ানেরা)। খোদাকে লিয়ে কুছ কিজিয়ে (আল্লাহর ওয়াস্তে কিছু একটা করুন)। কান্নাভেজা কণ্ঠে মিনতি আজিম খানের। সবাই স্তম্ভিত। পাকিস্তানি বাহিনীতে বিদ্রোহ, এও কি সম্ভব? নিরস্ত্র করার খবর পেয়েই বাঙালি সৈনিকদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তারা কমবেশি ক্ষিপ্ত ছিল, নিরস্ত্র করার পেছনে পাঞ্জাবিদের দুরভিসন্ধি রয়েছে ভেবে তারা চরমভাবে উত্তেজিত হয়ে অস্ত্রাগার ভেঙে হাতিয়ার বের করে নেয়। আমাদের সৈনিকেরাই প্রথম গুলিবর্ষণ করে পাঞ্জাবি ইউনিটের ওপর। পাঞ্জাবিরা এ বিদ্রোহের জন্য প্রস্তুত ছিল। কারণ, ইতিমধ্যেই ইস্ট বেঙ্গলের চারটি ব্যাটালিয়ন পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। এ খবর অবশ্য আমাদের জানা ছিল না। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি সৈনিকেরা বিদ্রোহ দমনের প্রস্তুতি নিয়েই রেখেছিল। যশোর সেনানিবাসে আমাদের বিদ্রোহের ২০ মিনিটের মধ্যেই তারা পাল্টা গুলিবর্ষণ করে এবং তিন দিক থেকে আমাদের অফিস এরিয়ার ওপর আক্রমণ চালায়।
আমি একসময় সিওকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘স্যার, আমাদের ওপর আক্রমণ আসছে। আমরা এখন কী করব?‘ তিনি জবাব দিলেন না, শুধু বললেন, ‘ও মাই গড, এখন কী হবে?’ উপ-অধিনায়ক মেজর ইকবাল কোরেশি সাহসী পুরুষ। সিওর চার কোর্স সিনিয়র ছিলেন পিএমএতে। তিনি টেলিফোন হাতে নিলেন এবং ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে টেলিফোন করে পাঞ্জাবি ভাষায় ব্রিগেড মেজর আসলাম খানকে আমাদের ওপর আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ করলেন। ব্রিগেড মেজর জানালেন, আগে বিদ্রোহীরা আত্মসমর্পণ করুক।
পরিস্থিতি ভালোভাবে দেখার জন্য অফিস ঘর থেকে বেরিয়ে পেছনের আমবাগানে গেলাম। আমাদের অফিস এরিয়ার চারদিকে পরিখা খনন করা ছিল আগে থেকেই। আমাদের সৈনিকেরা অস্ত্র হাতে নিয়ে পরিখায় অবস্থান নিয়েছে। ২৫ বালুচ এবং ২২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের সৈনিকেরা উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ দিক থেকে আমাদের ঘিরে রেখেছে এবং আক্রমণের চেষ্টা চালাচ্ছে। আমাদের সৈনিকেরা ইতিমধ্যেই কয়েকটি আক্রমণ প্রতিহত করেছে। শত্রুর যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি সাধন করেছে।
একদল সৈনিক ও এনসিও নিয়ে এগিয়ে এলেন ‘সি’ কোম্পানির সিনিয়র জেসিও সুবেদার আবদুল মজিদ।
‘স্যার, একটু কথা বলতে চাই আপনার সঙ্গে। ধৈর্য ধরে শুনবেন?’ বললেন মজিদ।
‘অবশ্যই, বলুন।’ আমার উত্তর।
‘স্যার, ২০ বছর চাকরি করেছি এ পল্টনে, আর এক সপ্তাহ পরই আমার রিটায়ারমেন্ট। আজ এক মহাবিপদ এবং পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছি আমরা। হয় বিজয়, নয়তো ধ্বংস অনিবার্য। আমরা পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছি কিন্তু আমাদের বিদ্যাবুদ্ধি অতি সামান্য। একজন অফিসারও নেই আমাদের সঙ্গে। আপনি এখন থেকে আমাদের নেতৃত্ব দেবেন, প্লিজ।’ মজিদ মিনতি করেন।
‘আমি কেন, কমান্ডিং অফিসার আছেন। তাঁর কাছে যান।’ আমার পরামর্শ।
‘গিয়েছিলাম স্যার, ওনার বয়স হয়েছে। তাঁর পক্ষে বিদ্রোহ করা সম্ভব নয়। এখন আপনিই আমাদের একমাত্র ভরসা।’ বললেন মজিদ।
‘ঠিক আছে। আপনারা এখানেই অপেক্ষা করুন, আমি সিওর সঙ্গে কথা বলে দেখি।’ আমি বললাম।
অফিস ঘরে ফিরে এলাম। মেজর কোরেশি পাঞ্জাবি ভাষায় তখন পর্যন্ত ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে কথাবার্তা চালাচ্ছেন। শত্রু থেমে থেমে গুলিবর্ষণ করছে। কয়েকটি এসে আমাদের অফিসের দেয়ালে আঘাত করেছে। মাঝেমধ্যে মর্টারের গোলা বিকট শব্দ করে অফিসের আশপাশে ফাটছে। ভাবলাম, এই তাহলে যুদ্ধ, এত দিন যার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছি। শত শত উড়ন্ত বুলেটের একটিই একজনের জন্য যথেষ্ট।
আমাকে দেখে সিও বারান্দায় বেরিয়ে এলেন। বাংলাতে বললাম, ‘স্যার, এভাবে বসে থাকার কোনো মানে হয় না। আপনি নির্দেশ দিন আমাদের, লেট আস ফাইট ইট আউট।’ তিনি কিছু বলার উদ্যোগ নিলেন, এ সময় পাশে এসে দাঁড়াল ক্যাপ্টেন ইকরাম। কোনো জবাব পেলাম না, তিনি তাঁর ঘরে ফিরে গেলেন।
বারান্দায় একটি খামের আড়ালে দাঁড়িয়ে চিন্তা করছি, আমার করণীয় কী? এখানে অফিসরুমে ছয়জন অফিসারের সঙ্গে বসে থাকব, নাকি বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দেব? এ বিদ্রোহের পরিণতিই-বা কী হবে? দুই মিনিট চিন্তাভাবনা করেই সিদ্ধান্ত নিলাম জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। আমি বিদ্রোহ করব এবং পল্টনের সৈনিকদের নেতৃত্ব দেব।