এক অঙ্কের সুদহার বাস্তবায়নে দিশেহারা ব্যাংকাররা
এক অঙ্কের সুদহার আগামী ১ এপ্রিল থেকে বাস্তবায়ন হবে; কিন্তু নতুন এ হার বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছে ব্যাংক খাত। বেশি সুদে আমানত নিয়ে বিনিয়োগ করা হয়েছে। এখন বিদ্যমান ঋণের সুদহার কমে গেলে বছর শেষে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার আয় থেকে বঞ্চিত হবে ব্যাংক খাত। আয়ের এ ঘাটতি কিভাবে সমন্বয় করা হবে তা নিয়েও কোনো কূলকিনারা পাচ্ছেন না ব্যাংকাররা।
সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় পড়েছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতে (এসএমই) বেশি ঋণ প্রদানকারী ব্যাংকগুলো। এখন এসব ব্যাংকের ঋণকার্যক্রমই বন্ধ হয়ে যাবে বলে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন। তাদের কেউ ব্যয় সঙ্কোচন নীতি গ্রহণ করেও আয়-ব্যয়ের হিসাব মিলাতে পারছেন না।
জানা গেছে, ব্যাংকিং খাতে এখন প্রায় ১০ লাখ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে। বেশির ভাগ ব্যাংকের ঋণের গড় সুদহার ১২ শতাংশের ওপরে রয়েছে। ক্ষুদ ঋণ বেশি বিতরণ করা হয় এমন ব্যাংকগুলোর গড় সুদহার আরো বেশি। এখন ১ এপ্রিল থেকে গড় সুদহার ৯ শতাংশ হলে (১২-৯=৩) সরাসরি গড় সুদহার ৩ শতাংশ কমে যাবে। এতে ১০ লাখ কোটি টাকার ঋণ থাকলে ৩ শতাংশ হিসাবে ৩০ হাজার কোটি টাকার মুনাফা থেকে সরাসরি বঞ্চিত হবে ব্যাংক খাত। আয়ের এ ঘাটতি সমন্বয় করারও কোনো উপায় বের করতে পারছে না ব্যাংকগুলো।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে (এসএমই) বেশি ঋণ প্রদান করে এমন একটি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী গতকাল জানিয়েছেন, জোর করে এক অঙ্কের সুদহার বাস্তবায়ন সামগ্রিক অর্থনীতিতে মোটেও সুফল বয়ে আনবে না, বরং বেকায়দায় ফেলে দেবে।
তার মতে, ২০১৫ সালে কেনিয়ায় এ নীতি গ্রহণ করে কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। তার আগে পাকিস্তানেও এ নীতি গ্রহণ করে ফল ভালো হয়নি। আবার তারা আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে। আমাদের অর্থনীতিতে এখানেও এর নেতিবাচক প্রভাবই বেশি দেখা দেবে।
অপর একটি ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপক জানান, ব্যাংকগুলোর প্রধান আয় মূলত সুদহার দিয়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেয়া সার্ভিস চার্জের বেশি চার্জ আদায় করা যায় না। এখন রাতারাতি সুদহার কমে গেলে সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় পড়ে যাবে ক্ষুদ্র ঋণ প্রদান করে এমন ব্যাংকগুলো।
কারণ, এনজিও ঋণে সুদহার ২৪ শতাংশ বেঁধে দেয়া আছে। এনজিও ঋণের পরেই ক্ষুদ্র ঋণের ব্যয় বেশি হয়। কারণ এখানে পরিচালন ব্যয় হয় স্বাভাবিক ঋণের চেয়ে অনেক বেশি। এখন এসএমই ঋণেও এক অঙ্কে সুদহার বাস্তবায়ন করলে পরিচালন মুনাফা অর্ধেকে নেমে আসবে। বাধ্য হয়ে এসএমই ঋণ প্রদান বন্ধ করে দিতে হবে। এতে শুধু ব্যাংকই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ তারা এসএমই ঋণ তুলনামূলক কম সুদে পেতেন।
এখন ব্যাংক এসএমই ঋণ বন্ধ করে দিলে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ব্যবসা চালু রাখতে হলে এনজিওদের কাছ থেকে অথবা গ্রাম্য মহাজনদের কাছ থেকে বেশি সুদে ঋণ নিতে হবে। এতে উদ্যোক্তার ব্যবসা ব্যয় বেড়ে যাবে। পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। মূল্যের প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে লোকসান গুনতে হবে। এভাবে একসময় কারখানা বন্ধ করে দিতে হবে।
অপর একটি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী জানিয়েছেন, আসলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনেকটা রসিকতা করা হচ্ছে। তারা বলছে, আমরা আমানতের সুদহার বেঁধে দিইনি, বেঁধে দেয়া হয়েছে ঋণের সুদহার। এর অর্থ হলো- বেশি সুদে আমানত নিয়ে কম সুদে ঋণ বিতরণ করো। এ ধরনের রসিকতা দুনিয়ার কোথাও নেই। ওই কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বলা হয়েছে সরকারি আমানত ৬ শতাংশ করার।
তাদের কাছে যে পরিমাণ সরকারি আমানত রয়েছে, তা ৬ শতাংশ করা মাত্রই ওই আমানত প্রত্যাহার করছে সংশ্লিষ্ট সংস্থা। এতে এক দিকে আমরা বেসরকারি ব্যাংকগুলো সরকারি আমানত হাতছাড়া করছি, অপর দিকে বেসরকারি আমানত ৬ শতাংশ করা যাচ্ছে না। বাজারে তারল্যসঙ্কট থাকায় বেশি সুদে অনেক ব্যাংক আমানত নিচ্ছে। এতে গড় আমানতের সুদহার বেড়ে যাচ্ছে। অপর দিকে ঋণের সুদহার বেঁধে দেয়া হয়েছে ৯ শতাংশ। আবার বেসরকারি খাতে ঋণ প্রদানে ঝুঁকি রয়েছে।
ভালো গ্রাহক দেখে ঋণ প্রদান করলেও ব্যবসায় মন্দার কারণে অনেকেই ঋণ পরিশোধ করতে পারেন না। এমনি পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলোর হয় ঋণকার্যক্রম বন্ধ করে দিতে হবে, অথবা বেসরকারি বিনিয়োগ না দিয়ে শুধু সরকারকে ঋণ প্রদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। কেননা এখনো সরকারকে ঋণ দিলে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশের ওপরে মুনাফা পাওয়া যায়। ওই কর্মকর্তা বলেন, অভিন্ন সুদহারে ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতা বেড়ে গেছে। কেউ ব্যয় সঙ্কোচনের নীতি গ্রহণ করেও বছর শেষে আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে পারছেন না। সব কিছু এখন পরিচালনা পর্ষদের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
অপর একটি ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানের জন্য তার ব্যাংকের সাড়ে চার শ’ ইউনিট রয়েছে। এতে লোকবল রয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার। অভিন্ন ঋণ বাস্তবায়ন করতে হলে ক্ষুদ্র ঋণের ইউনিটগুলো বন্ধ করা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না। এতে বেকার হয়ে যাবে প্রায় পাঁচ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী। তিনি জানান, ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে দেশব্যাপী অর্থনীতিতে বড় ধরনের অবদান রেখে আসছে তার ব্যাংক। এখন বন্ধ না করলে বছর শেষে লোকসান সমন্বয় করা যাবে না।