প্রেসব্রিফিং—
শুক্রবার, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২০ নয়াপল্টন বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব এ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী এর সংবাদ সম্মেলন এর বক্তব্য।
সুপ্রিয় সাংবাদিক ভাই ও বোনেরা,
আসসালামু আলাইকুম। সবাইকে জানাচ্ছি আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও কৃতজ্ঞতা।
দুই বছরের বেশী সময় ধরে কারারুদ্ধ বাংলাদেশের চারবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, গণতন্ত্রের প্রতীক, বিএনপি চেয়ারপার্সন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সুচিকিৎসার অভাবে এখন প্রায় পঙ্গু হয়ে গেছেন। কেবল উন্নত চিকিৎসার জন্যই নয়, তিনি একজন মহিয়সী নারী, তাঁর বয়স, অসুস্থতাসহ সকল বিবেচনায় তিনি জামিনের যোগ্য হলেও গণভবনের সরাসরি হস্তক্ষেপে জামিন পেলেন না। তাঁকে জামিন দেয়া হয়নি। আবারো তাঁকে তাঁর মানবাধিকার, মৌলিক সাংবিধানিক ও আইনগত অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হলো। এটা গোটা বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য। মহান স্বাধীনতার ঘোষক ও ‘৭১ এর রণাঙ্গনের বীর সেক্টর কমান্ডারের সহধর্মীনি বেগম খালেদা জিয়াকে আইনী অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে শুধুমাত্র হিংসার বশবর্তী হয়ে। নিম্ন থেকে সর্বোচ্চ আদালত আজ অবরুদ্ধ মিডনাইট ভোট ডাকাতদের করতলে। দেশের জনগণ বিশ্বাস করে, আদালতের ন্যুনতম স্বাধীনতা থাকলে বেগম খালেদা জিয়া জামিন পেতেন। এই বাংলাদেশে ফাঁসির আসামিরাও জামিন পায়। শত শত কোটি টাকা লুট করা ব্যক্তিরাও জামিন পায়। অথচ একজন মাত্র ব্যক্তির ক্ষমতালিপ্সা আর প্রতিহিংসার কারণে খালেদা জিয়াকে নিজের পছন্দমতো সুচিকিৎসার সুযোগ দিতে জামিনও দেয়া হচ্ছেনা। মাত্র দুই কোটি টাকা অনিয়মের সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগ এনে দেশনেত্রীকে কারাবন্দি করে রাখা হয়েছে, অথচ সেই দুই কোটি টাকা ব্যাংকে সুদে আসলে বেড়ে এখন আট কোটি টাকার বেশী হয়েছে।
সুহৃদ বন্ধুরা,
বাংলাদেশে গণতন্ত্র এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় যিনি তাঁর পুরো রাজনৈতিক জীবন ব্যয় করেছেন, এমন একজন নেত্রী আজ ভোট লুটেরাদের প্রতিহিংসা, অনাচার আর জুলুমের শিকার। এমন জুলুম বাংলাদেশ আর কখনোই দেখেনি। নিশিরাতের সরকারের মন্ত্রীরা আদালতের দোহাই দিয়ে জামিন না দেয়ার পক্ষে নানারকম গালগল্প করছেন। অথচ দেশের জনগণ সাক্ষী এই আদালতের সিটিং প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার সাথে সরকারের ভিন্নমত হওয়ার কারণে চ্যাংদোলা করে বিদেশে তাড়িয়ে দিয়েছিলো গানপয়েন্টে। এখন যারা বিচারপতির আসনে, সাবেক প্রধান বিচারপতির পরিণতি দেখে তারা সঠিক রায় দেয়ার সাহস করছেন না। স্বৈরাচারের মন রক্ষা করে সাময়িক সুবিধা হয়তো পাওয়া যায় কিন্তু তাদের পরিণতি হয় অত্যন্ত অপমানজনক, সাবেক প্রধান বিচারপতির তার জলন্ত উদাহরণ। সুতরাং, এখনও যারা স্বৈরাচারের ইচ্ছে পূরণের হাতিয়ার হিসেবে নিজেদেরকে ব্যবহার করছেন তাদের পরিণতিও ভালো হতে পারেনা। তাদের পরিণতিও অপমানজনক হতে বাধ্য। শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র।
মানুষের আশা ভরসার শেষ জায়গা যদি এমন হয় তাহলে মানুষের শেষ আশ্রয় কোথায় ? বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা শোচনীয় পর্যায়ে। খালেদা জিয়া যেভাবে সরকারের তত্ত্বাবধানে আদালতের অবিচারের শিকার হচ্ছেন, এমন পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়ার যদি আরো বড় কোনো ক্ষতি হয়ে যায়, তাহলে জনগণ কাউকেই ক্ষমা করবেনা। গণতান্ত্রিক শাসন আর ন্যায়বিচারের সকল পথ রুদ্ধ হয়ে গেলে জনগণ তখন আইন হাতে তুলে নিতে বাধ্য হয়। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
নিশিরাতের সরকার আসলে কি চায় এটাই এখন জনগণের সামনে বড় প্রশ্ন। আপনাদের মনে আছে, স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশেও বর্তমান সময়ের মতো ঠিক একই রকমের পরিস্থিতি বিরাজ করছিলো। সেই সময়ও মানুষের বাক-ব্যক্তি স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রে স্বীকৃত বিরোধী দলগুলোর অস্তিত্ব ছিল বাদের খাতায়। ক্ষমতাসীনদের কথায়-ই ছিল আইন। এমন পরিস্থিতিতে সেই সময়কার বিরোধী দল জাসদ গণবাহিনী গঠন করে তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অস্ত্রহাতে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল।
বিএনপি কোনো সশস্ত্র রাজনৈতিক দল নয়। বিএনপি একটি নিয়মতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। তাই আমাদের দলের নেতাকর্মীরা শত নির্যাতন নিপীড়ন সহ্য করেও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পথ থেকে বিচ্যুৎ হয়নি। আমরা আশা করি, নিশিরাতের সরকার দেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেবেনা। আমরা আশা করি সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। বেগম খালেদা জিয়াকে সসম্মানে নিঃশর্ত মুক্তি দেবে।
সাংবাদিক ভাই-বোনেরা,
আপনারা জানেন, সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস দশার কথা বিবেচনা না করে সম্পূর্ণ গণবিরোধী এই নিশিরাতের সরকার বিদ্যুৎ ও ওয়াসার পানির দাম আবারো বাড়িয়ে দিয়েছে। ‘যখন ইচ্ছা বিদ্যুতের দাম বাড়াতে পারবে সরকার’ এই স্বেচ্ছাচারী আইন মন্ত্রীসভায় অনুমোদন করিয়ে জনগণের ওপর ভয়াবহ জুলুম চালাচ্ছে এই লুটেরা শাসকরা। গণমানুষ, ভোক্তা অধিকার কিংবা ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর যুক্তি-অনুরোধ কোন কিছুরই তোয়াক্কা না করে যখন মন চাচ্ছে গ্যাস বিদ্যুৎ পানির দাম বাড়িয়ে জনগণের পকেট কাটছে। জনগণকে শোষণ করে আওয়ামী সিন্ডিকেটের মুনাফার জন্য সরকার বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করেছে। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বানিজ্য মন্দা এবং বিশ^বাজারে জ্বালানি তেলের দর পতনের মধ্যেই দেশে সব পর্যায়ে বিদ্যুতের পাইকারি ও খুচরা মূল্য বাড়নোর একমাত্র কারন হলো লুটপাট। দামবৃদ্ধির মাধ্যমে গ্রাহকদের পকেট থেকে বছরে দুই হাজার কোটি টাকা লুটে নিবে আওয়ামী সিন্ডিকেট।
লুটপাটের বড় অনুসঙ্গ কুইক রেন্টাল করে এখন বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভাড়া গুনতে হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। গতবার কুইক রেন্টালগুলো উৎপাদন না করলেও ভাড়া দিতে হয়েছে ১৫ হাজার কোটি টাকা। এবছর দিতে হবে ২০ হাজার কোটি টাকা। এই টাকা ক্ষমতাসীন দলের ব্যবসায়ীরা পাচার করে দিচ্ছে বিদেশে।
এই আওয়ামী দু:শাসকদের আমলে এই নিয়ে নয়বার বাড়ানো হলো বিদ্যুতের দাম। বারবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ফলে দেয়ালে পিঠ ঠেকেছে সাধারণ মানুষের। শিল্প মালিকদেরও ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ দশা। দেশীয় শিল্পকারখানা ধ্বংস করে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান বন্ধের মাধ্যমে দেশকে বড় ধরনের বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেয়ার চক্রান্ত চলছে। বিদ্যুৎ গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কারনে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার সক্ষমতা হারাচ্ছে শত শত প্রতিষ্ঠান। গ্যাসের দাম বাড়ানোর মাত্র ৮ মাসের মাথায় আবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি দেশের শিল্পের শক্তি ধ্বংস করে দিবে। ক্ষুদ্র শিল্পোদ্যক্তা ও ব্যবসায়ীদের জন্য অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে। সেচ বিদ্যুতের দাম বাড়ায় কৃষিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য মূল্য সহ জীবনযাত্রার সকল খরচ বেড়ে যাবে। মানুষের দুর্ভোগ চরম আকার ধারন করবে। তাই এই গণবিরোধী সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করার আহবান জানাচ্ছি। অন্যথায় বিদ্যূৎ, ওয়াসার পানির দামবৃদ্ধিসহ গণবিরোধী সব সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে।
সুহৃদ সাংবাদিকবৃন্দ,
গত ২১ ফেব্রুয়ারী মহান শহীদ দিবস ও মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ অর্পণের জন্য যাত্রাপথে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের চারজন নেতাকর্মী এক মর্মান্তিক সড়ক দূর্ঘটনায় নিহত হয়। নিহতদের কবর জিয়ারত ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সমবেদনা জানানোর উদ্দেশ্যে গত ২৫ ফেব্রুয়ারী ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ সংগঠনের নেতাকর্মীরা হালুয়াঘাটে যাবার পথে কবরস্থান থেকে দুই কিলোমিটার দুরত্বে পুলিশ তাদের গাড়ীবহরে বাধা প্রদান করে। প্রায় দুই ঘন্টা যাবত পুলিশ প্রশাসনের সাথে স্থানীয় বিএনপি নেতাদের আলোচনান্তে অল্প কিছু সংখ্যক ছাত্রদল নেতাদেরকে কবর জিয়ারতের অনুমতি চাওয়া হলেও অনুমতি দেয়নি পুলিশ প্রশাসন। শুধু তাই নয়, স্থানীয় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) পরবর্তীতে নিহত চারজন ছাত্রদল নেতাদের পরিবারের সদস্যদেরকে এই বলে হুমকি দিয়ে আসে যে, নিহতদের পরিবার যেন বলে নিহত ছাত্রদল নেতৃবৃন্দ ও তাদের পরিবার বিএনপি রাজনীতির সাথে জড়িত নয়, বরং তারা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। আমি পুলিশের এই অমানবিক ও ন্যাক্কারজনক আচরণের তীব্র ধিক্কার, নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।
কর্মসূচি —
বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন খারিজের প্রতিবাদে আগামীকাল ২৯ ফেব্রুয়ারী ২০২০, শনিবার ঢাকা মহানগরসহ দেশব্যাপী মহানগর ও জেলা সদরে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হবে। ঢাকায় ২৯ ফেব্রুয়ারী ২০২০, শনিবার বেলা ২-০০টায় নয়াপল্টন্থ বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সকল পর্যায়ের নেতাকর্মীকে বিক্ষোভ কর্মসূচি সফল করার জন্য আহবান জানানো হলো।
ধন্যবাদ সবাইকে। আল্লাহ হাফেজ।