ছাত্রলীগ নেতা নাঈম গ্রুপের দখলে দুটি কলেজ, রয়েছে টর্চার সেল
রাজশাহী কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাইমুল হাসান নাঈম ও তার অনুসারীদের কাছে জিম্মি হয়ে রয়েছে রাজশাহী কলেজ। শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে অর্থ আদায়, বেপরোয়া চাঁদাবাজি, হোস্টেলে সিট বাণিজ্য, মাদক ব্যবসা ও অসামাজিক কাজে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। তবে ক্যাম্পাসে মূর্তিমান আতঙ্ক নাঈম গ্রুপের আতঙ্কে কেউ এতদিন মুখ খোলেননি। চাঁদাবাজির মামলায় গত বুধবার গ্রেফতার হয়ে জেলহাজতে রয়েছেন নাঈম ও তার এক অনুসারী।
নাঈমের বাড়ি নগরীর সিটি কলেজ সংলগ্ন রাজারহাতা এলাকায়। রাজশাহী কলেজ ছাড়াও সিটি কলেজ কেন্দ্রীক অপরাধ রাজ্যের বিস্তার ঘটিয়েছেন তিনি। আশপাশের একাধিক কোচিং সেন্টার থেকে নিয়মিত চাাঁদাও তোলেন নাঈম ও তার অনুসারীরা। সেখানকার একটি কোচিং সেন্টারে চাঁদাবাজির মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন নাঈম। এ ঘটনার পর তার বিরুদ্ধে মুখ খুলছেন ভুক্তভোগীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহী কলেজের পাশে বাড়ি হওয়ায় বরাবরই বেপরোয়া নাঈম। তার নির্দেশে সব অপকর্ম সম্পাদন করে তারই সেকেন্ড ইন কমান্ড রাজশাহী কলেজ ছাত্রলীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক রাসিক দত্ত। তার সব অপকর্মের সহযোগী প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক রোজেল, সাংগঠনিক সম্পাদক মানিক মাহাবুব রতনও। রয়েছে নাঈমের নেতৃত্বে ২০ জনের একটি ক্যাডার বাহিনী। এরা ছাত্র হলেও বই-কলমের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই।
অভিযোগ রয়েছে, নাঈম, রাসিক, রতন, রোজেলসহ এ বাহিনীর অনেকেই আছেন- যারা কেউই নিজেরা পরীক্ষায় বসেন না। কখনও জোরপূর্বক, কখনও বা ব্লাকমেইল করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের তাদের হয়ে পরীক্ষায় বসতে বাধ্য করেন।
সম্প্রতি রাজশাহী মহিলা কলেজ কেন্দ্রে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনার্স তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের দায়ে কলেজ ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নাঈমের ক্যাডার রতন মাহাবুব মানিককে বহিষ্কার করা হয়েছে। বহিষ্কারের বিষয়টি নিশ্চিত করে মহিলা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ প্রফেসর সাবরীনা শাহনাজ চৌধুরী।
অভিযোগ রয়েছে, রাজশাহী মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ হাসান রাজিবের চাচাত ভাই নাঈম। এ কারণে নাঈম এবং তার বাহিনী লাগামহীন অপকর্মের পরও সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয় না নগর ছাত্রলীগ। এছাড়া রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের এক তরুণ নেতার আশীর্বাদও রয়েছে নাঈমের প্রতি। ফলে নাঈম এবং তার বাহিনীর নির্যাতন এবং চাঁদাবাজিতে সবাই অতিষ্ট হয়ে উঠলও দেখার কেউ নেই।
এদিকে, সিটি কলেজের ছাত্রাবাসের দ্বিতীয় তলায় রয়েছে নাঈমের টর্চার সেল। ২০১৮ সালের ১১ জানুয়ারি আমজাদ হোসেন নামে এক যুবককে এ টর্চার সেলে ধরে নিয়ে যায় নাঈমের অনুসারীরা। এরপর তাকে বেধড়ক মারধর করা হয়। বাড়িতে ফোন দিয়ে দাবি করা হয় চাঁদা। আমজাদ জেলার মোহনপুর উপজেলার গোছাবাজার গ্রামের তৈয়ব আলীর ছেলে। রাজশাহী মহানগরীতে তিনি নেটওয়ার্ক মার্কেটিংয়ের ব্যবসা করেন।
আমজাদ গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, ওই সময় নাঈমের টর্চার সেলে আমাকে লাঠি ও লোহার পাইপ দিয়ে বেধড়ক পেটানো হয়। পরে আমার পরিবারের সদস্যদের ফোন দিয়ে দেড় লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন নাঈম। প্রথমে বিকাশের মাধ্যমে ৩০ হাজার এবং পরে আমাকে ছেড়ে দেয়ার সময় বাকি টাকা দেয়া হয়।
এদিকে এ ঘটনার পর আমজাদের স্ত্রী জেসমিন খাতুন পুলিশে অভিযোগ করেন। এরপর আমজাদের মোবাইল ফোন নম্বর ট্রেস করে তার অবস্থান নিশ্চিত হয় পুলিশ। বিষয়টি বুঝতে পেরে নাঈম আমজাদকে মালোপাড়া পুলিশ ফাঁড়ির সামনে ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। এ সময় সোহাগ নামে এক ছাত্রলীগ কর্মীকে আটক করে পুলিশ। তবে ঘটনার মূল নায়ক নাঈম হলেও সে থেকে যায় ধরাছোয়ার বাইরে। অভিযোগ রয়েছে, নাঈমের টর্চার সেলে এখনও নির্যাতনের ঘটনা অব্যাহত রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজশাহী কলেজ হোস্টেলের শিক্ষার্থীরা জানান, কলেজে মোট তিনটি হোস্টেলের সাতটি ব্লকে প্রতিবছর আসন ফাঁকা হয়। এ ফাঁকা আসনগুলোয় শিক্ষার্থী উঠানোর জন্য কলেজ ছাত্রলীগের সুপারিশ নিতে হয়। সেই সুযোগে ছাত্রলীগ প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ৫ থেকে ক্ষেত্র বিশেষে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করে থাকে। এ চাঁদা আদায়ের নেতৃত্বে রয়েছেন নাঈম।
চাঁদা দিতে বাধ্য হওয়া এক শিক্ষার্থী জানান, নাঈমকে পাঁচ হাজার টাকা চাঁদা দিয়ে হোস্টেলে উঠেছি। আবার মাঝে মধ্যেই নাঈমের নাম করে দু-একজন এসে চাঁদা নিয়ে যায়।
রাজশাহী কলেজের একাধিক শিক্ষার্থী বলছেন, ছাত্রলীগ নেতা নাঈমের কথা মতো কাজ না করলেই ধরে ধরে পেটানো হয়। চাঁদা না দিলে বা মিটিং-মিছিলে অংশ না নিলে বা শিবির আখ্যা দিয়ে নির্যাতন করা হয়।
২০১৬ সালের ১৭ মার্চ রাতে কলেজের মুসলিম হোস্টেলের নিউ ব্লকে ঢুকে নাঈমের সঙ্গে করমর্দন না করার কারণে তিন শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে আহত করেন নাঈম ও তার বাহিনী। এর মধ্যে মামুন নামের একজন সাধারণ শিক্ষার্থী পঙ্গু হয়ে যায়। এছাড়া ছাত্রলীগের মিছিলে স্লোগান দিতে দেরি হওয়ায় ফিরোজ নামের এক ছাত্রলীগ কর্মীকে ধরে পেটান নাঈম।
রাজশাহী কলেজের প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রাজশাহী কলেজের ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে কোনো ঝামেলা নেই। কিন্তু মাঝেমধ্যেই নানা সমস্যার সৃষ্টি করে চলেছেন ছাত্রলীগের নাঈম। তার দাপটে যেন সবাই অস্থির। ছাত্রলীগের নাম ভাঙিয়ে সে যা ইচ্ছে তাই করছে। অথচ দেখার কেউ নেই।
অপরদিকে ২০১৭ সালের ১১ ডিসেম্বর রাজশাহী কলেজ রিপোর্টার্স ইউনিটির কার্যালয়ে হামলা ও ভাঙচুর করে নাঈম বাহিনীর সদস্য রাসিক দত্ত ও রতনসহ অন্তত ১০ ছাত্রলীগ নেতাকর্মী। এ হামলায় আহত হন রাজশাহী কলেজ রিপোর্টার্স ইউনিটির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ওবাইদুল্লাহ মিম, পদ্মা নিউজের সাব এডিটর বাবর মাহমুদ এবং বরেন্দ্র এক্সপ্রেস ডট কমের প্রতিবেদক মোফাজ্জ্বল বিদ্যুৎ।
এছাড়া রাজশাহী কলেজ প্রশাসন ধূমপানমুক্ত ক্যাম্পাস ঘোষণা করলেও ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশ্যে ধূমপান করতে দেখা যায় নাঈম এবং রাসিকসহ তার বাহিনীর সদস্যদের।
ছাত্রলীগের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, রাজশাহী মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হাসান মাহমুদ রাজিবের চাচাতো ভাই নাঈম। এ কারণে সংগঠনের নাম ভাঙিয়ে নানা অপকর্ম করলেও তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলার সাহস পান না। রাজিবের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় সে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এছাড়া নাঈমের গুরু হিসেবে সব ধরনের আশ্রয় দিয়ে যাচ্ছেন মহানগর আওয়ামী লীগের এক নেতা। তিনি মহানগর আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতার ভাগ্নে।
তবে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ২০১৮ সালের ৩ এপ্রিল রাজশাহী কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে নাঈমকে বহিষ্কার করা হয়। এর কিছুদিন পরই তার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার হয়। কিন্তু এরপরও থামেনি দলের নামে নাঈমের অপকর্ম। নাঈম এবং তার বাহিনীর সদস্যদের অপকর্মের ব্যাপারে রাজশাহী কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি নূর মোহাম্মদ সিয়ামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, রাজশাহী কলেজ মহানগর ছাত্রলীগের আওতাভুক্ত ইউনিট। নাঈমসহ ছাত্রলীগের যেসব নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ততার যে অভিযোগ উঠেছে ওই ব্যাপারে মহানগর ছাত্রলীগ নেতারা সিদ্ধান্ত নেবেন।
নাঈমকে সমর্থন দেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে রাজশাহী মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ হাসান রাজিব বলেন, নাঈম আমার আপন চাচাত ভাই হলেও তাকে সব সময় শাসন করার চেষ্টা করেছি। নাঈম হয়ত দুই একটা অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে। সেটা ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। নিজের যোগ্যতাতেই নাঈম রাজশাহী কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন। সামনে মহানগর ছাত্রলীগের সম্মেলন। এ সম্মেলনে নাঈমও পদপ্রতাশী। এ কারণে একটি মহল নাঈমের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছেন বলে দাবি করেন এ ছাত্রলীগ নেতা।
তবে রাজশাহী মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি রকি কুমার ঘোষ বলেন, আমি সাংগঠনিক কাজে ঢাকায় অবস্থান করছি। নাঈমকে গ্রেফতারের কথা শুনেছি। চাঁদাবাজি ও ভাঙচুরের ঘটনায় তদন্তের জন্য কমিটি গঠন করা হবে। তদন্তে সত্যতা পাওয়া গেলে ফের তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।