হজ্জ পালনে কেন প্রতি বছর খরচ বাড়ছে?
আবারো বেড়েছে হজ্জের খরচ। সারাবছর জেদ্দা ও মদিনা রুটে সর্বনিম্ন প্লেন ভাড়া ৫০ হাজার থেকে ৫৫ হাজার (রিটার্ন) টাকা নেয় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। অথচ হজ্জ এলেই নানা অজুহাতে ভাড়া বাড়িয়ে দেয় রাষ্ট্রায়ত্ত এ এয়ারলাইন্স। এবারও হজ্জ ফ্লাইটের ভাড়া এক লাখ ৩৮ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
সূত্রে জানা যায়, চলতি বছর হজ্জ যাত্রী পরিবহনের জন্য এক লাখ ৪০ হাজার টাকা নির্ধারণ করেছিল বিমান। পরে অবশ্য দুই হাজার টাকা কমিয়ে এক লাখ ৩৮ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়। অথচ এ বছর বিমানের ভাড়া কমানো উচিত ছিল বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
২০০৬ সালে হজ্জের সর্বনিম্ন খরচ ছিল মাত্র ৯০ হাজার টাকা। তার পর থেকে সরকার বিভিন্ন অযুহাতে নিয়মিত বাড়িয়ে চলছে হজ্জের খরচ। সারা বছর কম খরচ থাকলেও হজ্জের সময় কেন এই খরচ বাড়ানোর প্রতিযোগিতা? অনেকেই আবার প্রশ্ন তুলেছেন ধর্ম পালনে নেতিবাচক মনোভাব তৈরীতে কি বাড়ানো হচ্ছে খরচ?
দেখা গেছে, এর আগে আপত্তিকর মন্তব্য করে সমালোচনায় এসেছিলেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। পবিত্র হজ্জ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এই সদস্য বলেন, আমি কিন্তু হজ্জে আর তাবলিগ জামাতের ঘোরতর বিরোধী। এ হজ্জে যে কত ম্যানপাওয়ার (জনশক্তি) নষ্ট হয়। হজ্জের জন্য ২০ লাখ লোক আজ সৌদি আরবে গিয়েছে। এদের কোনো কাম নাই। এদের কোনো প্রডাকশন নাই। শুধু ডিডাকশন দিচ্ছে। শুধু খাচ্ছে আর দেশের টাকা বিদেশে দিয়ে আসছে। তিনি হজ্জ কীভাবে এসেছে বলতে গিয়ে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কেও আপত্তিকর মন্তব্যও করেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে কোনো এয়ারলাইন্সের বিমান ভাড়া বাড়ানোর প্রধান কারণ হয় জেট ফুয়েলের (জ্বালানি) মূল্যবৃদ্ধি। তবে গত এক বছরে জেট ফুয়েলের দাম তো বাড়েইনি, বরং কমেছে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের হজ্জের সময় প্রতি লিটার জেট ফুয়েলের মূল্য ছিল দশমিক ৭১ মার্কিন ডলার। এ বছর তা কমে দাঁড়ায় দশমিক ৬৯ ডলার। তবে পদ্মা অয়েলের সঙ্গে বিশেষ চুক্তির কারণে আন্তর্জাতিক রুটে বিমান জেট ফুয়েল পাচ্ছে প্রতি লিটার দশমিক ৫৮ ডলারে।
আন্তর্জাতিক রুটে বিমান ভাড়ার বৃদ্ধির অন্যতম আরেকটি কারণ হতে পারে ট্যাক্স বা চার্জ বৃদ্ধি। কিন্তু এ বছর বাংলাদেশ সরকার বা সৌদি সরকার হজ্জযাত্রীদের বিমান ভাড়ার ওপর নতুন কোনো ট্যাক্স বা চার্জ আরোপ করেনি।
দুটি দিকই বিবেচনায় বিমানের ভাড়া এমনভাবে বাড়ানোর যৌক্তিকতা নেই বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা যৌক্তিকতা না দেখলেও বরাবরের মতো এবারও বিমানের অজুহাত, এক পথে ফাঁকা (যাত্রী ছাড়া) ফ্লাইট চালাতে হয় বলে তাদের ভাড়া বাড়াতে হয়েছে। তবে যাচাই-বাছাই করে দেখা যায়, বিমানের ওমরাহর যাত্রীদের রিটার্ন ভাড়া সর্বোচ্চ ৫৫ হাজার টাকা। বিমানের ফ্লাইট খালি আসা-যাওয়া করলেও ভাড়া এক লাখ ১০ হাজার টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। এছাড়া এই ভাড়ার মধ্যে একজন যাত্রীকে নয় হাজার ৮৪৩ টাকা ট্যাক্স ও ফি দিতে হচ্ছে। যাত্রী বহন না করলে বিমানকে এই ট্যাক্সও দিতে হয় না।
এছাড়া ফাঁকা ফ্লাইটগুলোতে যাত্রীদের ক্যাটারিংয়ের খরচ নেই, ব্যাগেজ হ্যান্ডলিং নেই, ইনফ্লাইট সার্ভিস- কোনোটিরই প্রয়োজন হয় না। যাত্রী কম হলে জ্বালানি খরচ কম হয়। অথচ এসব চার্জ ধরেই বিমান ভাড়া নির্ধারণ করেছে বলে জানাচ্ছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।
ট্রাভেল এজেন্সিগুলো বলছে, বিমান বারবার খালি যাওয়ার অজুহাত দেখিয়ে ভাড়া বাড়ায়। অথচ খালি ফ্লাইটে এন্টারটেইনমেন্ট, খাওয়া কিংবা অন্যান্য খরচ লাগে না। যাত্রী না থাকলে তেলও কম খরচ হয়। কিন্তু তারা সারাবছরের লোকসান হজ্জের ফ্লাইট দিয়ে পুষিয়ে দিতে চায়। হজযাত্রীরা আল্লাহর মেহমান। তাদের বহনে বিমানের এত ভাড়া নেয়া অন্যায়-বেমানান। বিমানের দেখাদেখি এখন অতিরিক্ত ভাড়া নিচ্ছে সৌদি এয়ারলাইন্সও।
এদিকে নিয়ম করে প্রতি বছর হজ্জের খরচ বাড়ার প্রেক্ষিতে হজ্জ গমনেচ্ছু অনেকেই সরকারের সমালোচনা করছেন। তারা বলছেন, বিমান ভাড়া বেশি নেওয়ার কারণে হজ্জের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। অথচ সাধারণ যাত্রীরা সৌদি এয়ারলাইন্সে গেলে ৪০ থেকে ৪৮ হাজার টাকায় সৌদি আরব যেতে পারেন। ওমরায় যাতায়াত ভাড়া নেওয়া হয় ৬০ হাজার টাকা। আর হজ্জে এক লাখ ২০-৩০ হাজার টাকা নেওয়া হয়। এটা কোন যুক্তিতে নেওয়া হয় তা অজানা।
তারা বলেন, আমরা মনে করি, বিমানভাড়া কম হলে হজ্জের খরচ অনেকটাই কমে যেত। বিমান সারা বছর লোকসানে থাকে। তারা হজ্জ দিয়ে সারা বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়। এ কারণে হজ্জের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এখন কথা হলো, হজ্জের মতো এবটি ইবাদতকে কেন্দ্র ব্যবহার করে মুনাফা বৃদ্ধির চিন্তা করা হবে। এর কি কোনো বিকল্প ভাবা যায় না?
বিশ্লেষকরা বলছেন, ধর্ম পালনে নেতিবাচক মনোভাব তৈরী করতেই হজ্জের ব্যয় বাড়িয়ে দিচ্ছে সরকার। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী হজ্জ বিরূপ মন্তব্য এটাই প্রমাণ করে। এছাড়া বিভিন্ন সময় ক্ষমতাসীনদের ওপর মহল নেতাদের ধর্ম বিদ্বেষ ফুটে উঠেছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীও মেয়েদের হিজাব নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও পাকিস্তানে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম টাকায় হজ্জ করেন সেখানকার নাগরিকেরা। ভারতে এক লাখ ৬০ থেকে ৮০ হাজার টাকায় হজ্জ করা যায়। ওই দেশের সরকার সংখ্যালঘু মুসলমানদের পবিত্র হজ্জ পালনে ভর্তুকি দেয় সরকার। আমাদের দেশে ধর্ম পালনে অনুপ্রেরণা নয় বরং নেতিবাচক মনোভাব তৈরী করতে খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে সরকার।