কেজরিওয়ালের উত্থান : কী করবেন মোদি-শাহ
দিল্লি বিধান সভার নির্বাচনে বিপর্যয়ের পর একটি আলোচনা ভারতের রাজনীতির পর্যবেক্ষকদের সামনে বিশেষভাবে আসছে। সেটি হলো দিল্লির এই নির্বাচনী পরীক্ষার পর বিজেপির মূল নীতি-নির্দেশক মোদি-শাহ কি তাদের নীতি-কৌশল পাল্টাবেন? কেউ কেউ মনে করেছিলেন, বিজেপি নেতৃত্ব তার হিন্দুত্ববাদী নীতি পরিত্যাগ না করলেও তাতে কিছুটা হলেও নমনীয়তা নিয়ে আসতে পারেন।
আরএসএস নির্দেশিত বিজেপির এই নীতি-কৌশল যে পরিত্যাজ্য নয়, তা জানার জন্য দিল্লিতে ‘কেজরি ঝড়’ বয়ে যাওয়ার পর সপ্তাহকালও অপেক্ষা করতে হয়নি। মুসলিমবিদ্বেষী নাগরিকত্ব আইন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, তার সরকার কোনো চাপের মুখে পিছু হটবে না। নাগরিকত্ব আইন বাস্তবায়ন করা হবেই। উত্তরপ্রদেশের বারানসিতে এক অনুষ্ঠানে এমন হুঁশিয়ারি দেন তিনি। এ বক্তব্য ঠিক সেদিন তিনি দিলেন যে দিনটি ছিল দিল্লিতে রাজ্যের নবনির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের। এতে মোদিকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়। তিনি সেই ‘কুরুক্ষেত্র’ এড়িয়ে এ দিন নিজের নির্বাচনী আসন বারানিস সফরে যান।
সেখানে এক জনসভায় মোদি বলেন, ‘বহু বছর ধরে দেশ সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ প্রত্যাহার এবং সিএএর মতো আইন চালু করার অপেক্ষায় ছিল। রাষ্ট্রের স্বার্থেই এমন সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন ছিল। যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে তাতে আমরা অটল। কোনো চাপের মুখেই তা থেকে পিছিয়ে আসব না।’
দিল্লির নির্বাচনের পর ভারতীয় বিশ্লেষক প্রভু চাওলা লিখেছেন, ‘পরাজয় দুর্দান্তভাবে সমতলে নিয়ে আসে, তবে মৃত্যুর মতো নয়, এটি হলো ভালো এক শিক্ষাদাতা। ব্যালট বাক্সের চেয়ে বড় কোনো পৌরাণিক কাহিনীকার নেই, যা সব দৃশ্যমান নির্বাচনে কৌশল সংশোধন এবং তীব্র অন্তঃকরণের তাগিদ দেয়। বিজয় যেমন অহংকে স্ফীত করে, তেমনি পরাজয় ব্যক্তিগত গৌরবকে তুচ্ছ করে। দিল্লিতে বিজেপির অবমাননাকর হারকে কেবলই একটি ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করা যায় না, তবে দল হিসেবে এটি এখনঅবধি বিজেপির জন্য অপরিবর্তিত গ্রহণযোগ্যতার ক্ষয়।’
সদ্যসমাপ্ত দিল্লি নির্বাচনে, আম আদমি পার্টি (এএপি) ৭০টি আসনের মধ্যে ৬২ এবং মোট প্রদত্ত ভোটের ৫৩.৫৭ শতাংশ পেয়ে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসে। ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ২০১৫ সালের চেয়ে অপেক্ষাকৃত ভালো করেছে। ৩৮.৫১ শতাংশ ভোট পেয়ে আটটি আসনে জয় পেয়েছে দলটি। কংগ্রেস রাজধানীর একটিও আসন জিততে পারেনি।
২০১৪ সালের দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের তুলনায় এবার বিজেপি ৬ শতাংশ ভোট বেশি পেয়েছে। দলের মোদি-শাহ অনুগতরা বলছেন, এটি হিন্দুত্ববাদী নীতির কারণেই অর্জন সম্ভব হয়েছে। কিন্তু গত মে মাসের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি দিল্লির সাত আসনের সব কটিই পেয়েছিল। এ সময় বিজেপি যে ভোট পেয়েছে তার তুলনায় এবার ১৫ শতাংশ ভোট কমে গেছে বিজেপির। প্রশ্ন হলো আট মাসের ব্যবধানে কী এমন হলো যার জন্য খোদ রাজধানীর ভোটাররা বিজেপি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো।
২০১৪ সালে জাতীয় পর্যায়ে নরেন্দ্র মোদির সাথে লড়াইয়ে, দিল্লির ভোটাররা বিজেপিকে সমর্থন করেছিলেন। মোদি ও কেজরিওয়ালের মধ্যে ব্যক্তিত্বের লড়াই এড়ানোর জন্য এএপি সচেতন কৌশল অবলম্বন করেছিল আর আদর্শিক ভিত্তিতে বিজেপিকে আক্রমণ করা থেকে বিরত ছিল। এএপি ইচ্ছাকৃতভাবে বিদ্যুৎ ব্যয় হ্রাস, বিনামূল্যে পানি এবং মহিলাদের জন্য বিনামূল্যে বাস রাইড পরিষেবা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং কল্যাণমূলক স্কিমগুলোতে তার সাফল্যগুলো প্রচার করে।
অন্যদিকে, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) নিয়ে জাতীয় রাজধানীতে ব্যাপক বিক্ষোভের মধ্যে দিল্লির একটি জয় বিজেপির আগ্রাসী, হাইপার-জাতীয়তাবাদী রাজনীতির অনুমোদনের জন্য বিশেষ প্রয়োজন। এ জন্য বিজেপি তার অনেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যকে কেজরিওয়ালের বিরুদ্ধে প্রচারের জন্য নিযুক্ত করে। প্রচারণার নেতৃত্বে ছিলেন অমিত শাহ নিজেই, যিনি দিল্লির ভোটারদের মন জয়ের জন্য অসংখ্য জনসভা ও রোড শোতে বক্তব্য রেখেছিলেন। বিজেপি তার প্রচার কৌশলে জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মীয় মেরুকরণকে ব্যবহার করেছে। দলের প্রবীণ নেতারা কেজরিওয়ালকে ‘সন্ত্রাসী’ এবং ‘নৈরাজ্যবাদী’ বলে চিহ্নিত করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই কৌশলে ফল আসেনি।
দিল্লিতে বিজেপির পরাজয় গত দুই বছরে রাজ্যপর্যায়ে দলের জন্য ষষ্ঠ পরাজয়। জাতীয় নেতাদের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা এবং বিশ্বাসযোগ্য স্থানীয় নেতার অভাব বিজেপির দুর্বলতা হিসেবে কাজ করেছে। আর মোদী-শাহ জুটিকে দিয়ে বিরোধী দলের শক্তিশালী আঞ্চলিক নেতাদের পরাস্ত করার চেষ্টা করে। এ প্রচেষ্টায়ও সেভাবে ফল আসেনি। যাই হোক, দিল্লি নির্বাচনের এই ফলাফল বিজেপির কোনো সিদ্ধান্তমূলক জাতীয় অ্যাজেন্ডাকে প্রভাবিত করার সম্ভাবনা কম। মোদি সেই কথাটিই স্পষ্ট করলেন তার বক্তব্যে। অধিকন্তু সিএএ-র উপর মনোনিবেশের ফলে দিল্লি নির্বাচনে তার ভোট ৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে উল্লেখ করার মধ্য দিয়ে দলটি তার মূল অ্যাজেন্ডাকে আরো আগ্রাসীভাবে অনুসরণ করবে বলেই মনে হয়।
২০২০ সালের শেষ দিকে বিহার এবং ২০২১ সালের প্রথমদিকে কেরালা, তামিলনাড়ু, আসাম ও পশ্চিম বাংলায় বিধানসভা নির্বাচন হবে। ২০২২ সালের মার্চে হবে উত্তর প্রদেশ ও উত্তরাখণ্ডের নির্বাচন। এই রাজ্যগুলোতে সংখ্যালঘু জনসংখ্যা উল্লেখযোগ্য হওয়ায় বিজেপি সম্ভবত মেরুকরণে উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে ভোটার আকর্ষণের জন্য বেশি ব্যবহারের চেষ্টা করবে; যদিও জনপ্রিয়তার ভাটা প্রবণতা বিজেপির উদ্বেগের এটা কারণ।
লোকসভা থেকে দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে সময়ের হিসাবে ব্যবধান আট মাস হলেও বিজেপি সরকার এ সময়ে এমন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে যা ভারত রাষ্ট্রের কাঠামোকেই নাড়িয়ে দিয়েছে। এ সময়ে ভারতের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসন ও বিশেষ মর্যাদা সংবলিত সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল এবং রাজ্যটিকে দুই ভাগে ভাগ করে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করা হয়েছে। অন্যদিকে অনুপ্রবেশের অজুহাত তুলে গোটা ভারতে নাগরিকপঞ্জি তৈরি করে ভারতের অধিবাসীদের নাগরিক-অনাগরিক দুই ভাগে ভাগ করার উদ্যোগ শুরু করা হয়েছে। এর মাধ্যমে একদিকে বৈধ অধিবাসীদের বিভিন্ন ডকুমেন্টের দোহাই দিয়ে অনাগরিক করে তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বাজেয়াপ্ত এবং ডিটেনশন ক্যাম্পে অন্তরীণ করে রাখার ঝুঁকি তৈরি করা হয়েছে। এটি এর মধ্যে আসামে বাস্তবায়নও করা হয়েছে। অন্যদিকে আশপাশের দেশ বিশেষত বাংলাদেশ পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের অসুমলিম সংখ্যালঘুদের ভারতের নাগরিকত্ব প্রদানের জন্য ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন’ পাস করে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ভারতব্যাপী জনসংখ্যার তালিকা তৈরির কাজ শুরু করা হয়েছে, যে উদ্যোগ এনআরসির জন্য কাজে লাগানো সম্ভব হবে বলে মনে করছেন বিজেপি নেতৃত্ব।
গত আট মাস সময়ে নেয়া এসব উদ্যোগ রাষ্ট্রের পরিচয় ও প্রকৃতিকে নতুন করে বিন্যস্ত করার প্রচেষ্টায় স্তম্ভ তৈরির মতো কাজ করেছে। এই স্তম্ভের ওপর ভিত্তি করে বিজেপির যে নতুন ভারতের সৌধ গড়ে উঠবে তার প্রধান পরিচয় হবে ‘হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র’। ভারত ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠা লাভের পর থেকে সব সময় হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ছিল। কিন্তু গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষ নীতির পাশাপাশি যে ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে কার্যকরভাবে রাষ্ট্রের মূলনীতি করা হয়েছিল তাতে হিন্দু মুসলিম শিখ খ্রিষ্টান বৌদ্ধ নির্বিশেষে সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সব অধিকার ও আচরণ পাওয়ার উপযুক্ত ছিলেন। ভারতের অন্য এক মূলনীতি, সমাজতন্ত্র বেশ কয়েক দশক আগে থেকেই এর কার্যকারিতা হারিয়েছে। তবে পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর প্রতি অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার করার ব্যাপারে এই রাষ্ট্রীয় মূলনীতির উপযোগিতা এখনো তুলে ধরা হয়।
বিজেপি যে ‘নতুন ভারত’ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে তার অন্তর্নিহিত মূলনীতি হবে তিনটি। প্রথমত, হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদ। এ মূলনীতির বিষয় আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত একাধিকবার তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, ‘হিন্দু হবে ভারতীয়দের পরিচয়। এখানকার মানুষ যে যে ধর্মে বিশ্বাস করুক না কেন, হিন্দুত্বের যে সংস্কৃতি ও চেতনা রয়েছে তাকে ধারণ করতে হবে সবাইকে। এরপর যার যার ধর্মের আচার বা বিশ্বাস অনুসারে তারা কাজ করবে।’
এর মাধ্যমে মূলত কট্টর ইহুদিরা ইসরাইলকে সেভাবে ইহুদি রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে তার অনুকরণে ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে চায় আরএসএস। এতে হিন্দুরা এমন কিছু বাড়তি অধিকার ভোগ করবে যার ফলে নাগরিক মর্যাদার ক্ষেত্রে তারা হবে রাষ্ট্রের প্রথম শ্রেণীর নাগরিক। আর অন্যরা হবে কার্যত দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে এই বিভাজন রেখা টানা হয়েছে। আর গো রক্ষা আন্দোলন, ঘর ওয়াপসি কর্মসূচি, ধর্মান্তর নিয়ন্ত্রণ- এসবের মাধ্যমে প্রায়োগিক ক্ষেত্রে এর সামাজিক ভিত্তি তৈরির প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে।
বিজেপির দর্শনগত দ্বিতীয় মূলনীতিটি হলো, ভারতীয় শ্রেষ্ঠত্ববাদ। ভারতের অতীত ইতিহাসের হাজার বছরের মতো মুসলিম ও খ্রিষ্টান শাসকদের দ্বারা শাসিত হওয়ার পটভূমি থেকে আরএসএস লক্ষ্য হিসেবে ভারতীয় শ্রেষ্ঠত্ববাদী ধারণাটিকে লালন করে আসছে। বাল্মিকী করতে বর্ণিত রাম জমানাকে এ জন্য আদর্শ সময় বলে মনে করা হয়। বিজেপি লেখা সরকার এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হওয়ার চেষ্টা করেছে। পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ চুক্তিতে স্বাক্ষর ছাড়াই পরমাণু প্রযুক্তি রফতানিকারক দেশের অন্তর্ভুক্ত হতে চেয়েছে দেশটি। সে সাথে ভারত সামরিকভাবে অন্যতম প্রধান বিশ্বশক্তি হওয়ার জন্য প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়িয়ে চলেছে। এ লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে পাকিস্তানকে প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করতে চাইলেও মোদি সরকারের মূল প্রতিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে চীনকে।
বিজেপির তৃতীয় দর্শনগত মূলনীতি হলো অখণ্ড ভারত প্রতিষ্ঠা করা। ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা পুরো ভারতবর্ষকে ভারত রাষ্ট্রের ভূখণ্ড হিসেবে কল্পনা করে থাকে। এ ভূখণ্ডের মধ্যে ভারত ছাড়াও পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, ভুটান ও মিয়ানমার রয়েছে। উপমহাদেশে সিকিম, হায়দরাবাদ ও জুনাগড় নামে তিনটি স্বাধীন দেশ এক সময় ছিল। ১৯৪৭ সালের পর বিভিন্ন পর্যায়ে এ দেশগুলোকে ভারতের অংশ করে নেয়া হয়েছে। বিতর্কিত কাশ্মিরকে ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করে পুরোপুরি ভারতীয়করণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ভাবনাগতভাবে ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা দক্ষিণ এশিয়ার যেসব দেশকে অখণ্ড ভারতের অংশ করে নিতে চায়, সে লক্ষ্য অর্জন সহজসাধ্য নয়। এ কারণে ভৌগোলিকভাবে এসব দেশকে পদানত করা সম্ভব না হলেও তাদের প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তাগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ভারতনির্ভর করা সম্ভব হলে ভাবনাগত লক্ষ্যের প্রাথমিক বিষয় অর্জিত হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
বিজেপি এবং এর পৃষ্ঠপোষক আরএসএসের এই দর্শন ও কৌশলগত লক্ষ্যকে ভারতীয়রা ব্যাপকভাবে সমর্থন করে, বিষয়টি সে রকম নয়। বিজেপি গত নির্বাচনে ৩২ শতাংশ ভোট পেয়ে কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করেছে। বিজেপিবিরোধী ভোটগুলো নানা দলে বিভক্ত হওয়ার কারণে দ্বিতীয়বার বিজেপি সরকার গঠনে সফল হয়েছে। চিন্তাগতভাবে ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সেকুলার। সংখ্যালঘু মুসলিম খ্রিষ্টান বৌদ্ধ শিখদের সাথে নিম্নবর্ণের হরিজনদের যুক্ত করা হলে বর্ণগতভাবেও ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বিজেপির দর্শনকে সমর্থন করে না। আর ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বিপুলসংখ্যক ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ অন্তর্ভুক্তিমূলক ভারতীয় সমাজ ও রাষ্ট্র প্রত্যাশা করে। ফলে এনআরসি ও নাগরিকত্ব আইন, এমনকি কাশ্মিরের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলবিরোধী আন্দোলনে বিপুলসংখ্যক হিন্দু ভারতীয়কে সামনের কাতারে দেখা যায়। দিল্লির শাহীনবাগ অথবা জামেয়া মিল্লিয়াতে অথবা পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা, তামিলনাড়– এমনকি মহারাষ্ট্র-গুজরাটের এনআরসি-বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বে হিন্দু রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতারা রয়েছেন।
এবারে দিল্লি এবং এর আগে যে ছয়টি রাজ্য বিজেপির হাতছাড়া হয়েছে সেটি ঘটেছে অন্তর্ভুক্তিমূলক ভারতীয় সমাজ গঠনের জয় হিসেবে। দিল্লি বিধান সভায় অরবিন্দ কেজরিওয়ালের নেতৃত্বাধীন আম আদমি পার্টি, অর্থাৎ আপের বিজয়ে উন্নয়নও একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছে। এই উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের কথা বলে বিজেপি ক্ষমতায় এলেও প্রথম পাঁচ বছরে সে ক্ষেত্রে কোনো সাফল্য দেখাতে পারেনি। ফলে গত নির্বাচনে উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ জাগিয়ে তুলে সাফল্য পেতে চেয়েছে দলটি। গত লোকসভা নির্বাচনে সে সাফল্য তারা পেয়েছে। কিন্তু এ ধারা ভারতীয় রাজনীতিকে ভবিষ্যতে শাসন করতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। দিল্লির সর্বসাম্প্রতিক বার্তা সম্ভবত এটি।
এর আগে পশ্চিমবঙ্গসহ বেশ কটি রাজ্যের উপনির্বাচনেও একই বার্তা পাওয়া গেছে। বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও উত্তর প্রদেশের আগামী বিধানসভা নির্বাচনের বার্তা কী হবে সেটি হতে পারে এক গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়ক। এরপর সর্বভারতীয় ক্ষমতায় উগ্রচিন্তাবাদীরা থাকবেন, নাকি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রবাদীরা থাকবে- সেটি নিরূপিত হবে।