শেখ হাসিনাকে যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে হবে- এমন চেষ্টা থেকেই গণঅভ্যুত্থানের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল। সেই সময় সংঘটিত সব অপরাধের ‘নিউক্লিয়াস’ ছিলেন শেখ হাসিনা নিজে। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন সব অপরাধীরও ‘প্রাণভোমরা’।
রোববার (১ জুন) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দাখিল করার সময় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনা মানবতাবিরোধী অপরাধের সুনির্দিষ্ট বিবরণ তুলে ধরে এসব কথা বলেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।
গণঅভ্যুত্থানের প্রায় ১০ মাস পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এই প্রথম কোনো মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল করা হলো।
চিফ প্রসিকিউটর শুনানিতে বলেন, শেখ হাসিনার অধীনে থাকা অন্য অপরাধীরা বিশ্বাস করতেন, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় টিকে থাকলে তারাও টিকে থাকবেন এবং শত অপরাধ করা সত্ত্বেও তারা নিরাপদে থাকবেন। আনুগত্যের জন্য পুরস্কৃতও হবেন। এই অপরাধীদের প্রাণভোমরা তিনি।
আনুষ্ঠানিক অভিযোগে শেখ হাসিনার পাশাপাশি আসামি করা হয়েছে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও পুলিশের তৎকালীন মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে।
শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মোট পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে। আনুষ্ঠানিক অভিযোগ মোট ৮ হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠার। এর মধ্যে তথ্যসূত্র ২ হাজার ১৮ পৃষ্ঠার, জব্দতালিকা ও দালিলিক প্রমাণাদি ৪ হাজার ৫ পৃষ্ঠার এবং শহীদদের তালিকার বিবরণ ২ হাজার ৭২৪ পৃষ্ঠার। আনুষ্ঠানিক অভিযোগে সাক্ষী হিসেবে রাখা হয়েছে ৮১ জনকে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ এনে প্রথমে মিস কেস বা বিবিধ মামলা করা হয়। রোববার (১ জুন) আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করার পর এটি ট্রাইব্যুনালের মামলা হিসেবে নথিভুক্ত হলো।
এ মামলায় শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে ‘জয়েন্ট ক্রিমিনাল এন্টারপ্রাইজ এবং কমান্ড রেসপনসিবিলিটির’ অভিযোগ আনা হয়েছে।
মামলার তিন আসামির মধ্যে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন গ্রেফতারের পর এখন কারাবন্দী। শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল পলাতক থাকায় তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন ট্রাইব্যুনাল।
ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল এই আদেশ দেন। ট্রাইব্যুনালের দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারপতি মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
আদালতে এ মামলার শুনানি শেষে ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, তিন আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। তাদের বিরুদ্ধে নতুন করে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। ১৬ জুন আসামিদের হাজির করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। ওইদিন যদি আসামিরা উপস্থিত হন, তাহলে সেদিন থেকে বিচারের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু হবে। যদি আসামিদের কেউ অনুপস্থিত থাকেন, আইন অনুযায়ী তাদের অনুপস্থিত ঘোষণা করার একটা ব্যাপার থাকবে।
ট্রাইব্যুনালের শুনানিতে চিফ প্রসিকিউটরের পাশাপাশি আনুষ্ঠানিক অভিযোগের উল্লেখযোগ্য অংশ উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম ও মো. আব্দুস সোবহান তরফদার।
ট্রাইব্যুনালের বিচার কার্যক্রমের পুরোটাই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
শুনানিতে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, শেখ হাসিনা ছিলেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তথা নির্বাহী বিভাগের প্রধান, আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং ১৪ দলীয় জোটের প্রধান। তিনি ছিলেন সব ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের কেন্দ্রবিন্দু। একজন ‘ফ্যাসিস্ট শাসক’ হিসেবে সব সিদ্ধান্ত তিনি এককভাবে নিতেন। তার সব রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন এবং সমর্থনের মাধ্যমে অধীনরা তাকে সন্তুষ্ট করে তার কৃপাদৃষ্টি লাভ করার জন্য সর্বদা সচেষ্ট থাকতেন।
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, জুলাই বিপ্লব চলাকালে আন্দোলন দমনে শেখ হাসিনার নেওয়া সব পদক্ষেপ বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হতো তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের নেতৃত্বাধীন ‘কোর কমিটির’ বৈঠকে। আসাদুজ্জামানের ধানমন্ডির বাসায় এসব বৈঠক হতো। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রক ছিলেন তিনি। চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন পুলিশ প্রধান হিসেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অন্যতম নিয়ন্ত্রক এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সহযোগী ছিলেন।