জমি দখলকারী সেই গোলাম দস্তগীর পাচ্ছে ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’!
প্রতিবারের ন্যায়ে জাতীয় পর্যায়ে ‘গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ’ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে এবারও স্বাধীনতা পুরস্কার ২০২০-এর জন্য চূড়ান্তভাবে মনোনীত করেছে ক্ষমতাসীনরা। আগামী ২৫ মার্চ সকাল ১০টায় রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কর্তৃক আয়োজিত অনুষ্ঠানে মনোনীত বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানকে এ পুরস্কার তুলে দেবেন।
ইতিমধ্যে পুরস্কার যারা পাচ্ছেন তাদের নামের তালিকাও প্রকাশও করা হয়েছে। দেখা গেছে, তালিকার প্রথমেই যার নাম রয়েছে তিনি হলেন নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জের এমপি এবং পাট ও বস্ত্র মন্ত্রী গাজী গোলাম দস্তগীর। এছাড়া রয়েছে কমান্ডার (অব.) আবদুর রউফ (মরণোত্তর), মুহাম্মদ আনোয়ার পাশা (মরণোত্তর) ও আজিজুর রহমান।
এদিকে স্বাধীনতা পুরুস্কার প্রাপ্তদের তালিকা গাজী গোলাম দস্তগীরের নাম দেখে অনেকেই ক্ষুব্দ হয়েছেন। সবার প্রশ্ন একটাই-কে এই গোলাম দস্তগীর? কি তার পরিচয়? শেখ হাসিনা তাকে কোন বিবেচনায় এই পুরুস্কার দিতে যাচ্ছেন?
কে এই গোলাম দস্তগীর গাজী?
নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের এমপি গোলাম দস্তগীর গাজী নিজ এলাকায় সাধারণ মানুষের কাছে মহা আতঙ্কের এক মূর্তপ্রতীক। তিনি সাধারণ মানুষের জমি দখলকারী হিসেবে পরিচিত। অপরাধ কর্মকাণ্ডের জন্য এই গোলাম দস্তগীর গাজী একাধিকবার গণমাধ্যমের প্রধান শিরোনাম হয়েছেন। এছাড়া এক চমকে জায়গা করে নেয় মন্ত্রিসভায়ও।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিনা ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর গোলাম দস্তগীর গাজী তার নির্বাচনী এলাকায় শত শত বিঘা জমির মালিক হন। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, বেশ কয়েকটি গ্রামে এখন গাজীর মালিকানাধীন জমি ছাড়া আর কারও জমি নেই। এসব গ্রামের পুরনো বাসিন্দাদেরকে তিনি জোর করে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। জমি দখল নিয়ে মামলাও হয়েছে। দখলের শিকার ভুক্তভোগীরা বিচার দাবি করে সংবাদ সম্মেলন করেও রেহাই পায়নি। জেলা প্রশাসকের কাছে দিয়েছেন স্মারকলিপি। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। তাই রূপগঞ্জের বাসিন্দারা ধরেই নিয়েছেন, গাজী জমি চাইলে ছেড়ে দিতে হবে।
এলাকা ঘুরে দেখা যায়, রূপসী খাদুন এলাকায় বিশাল জায়গার নাম দেয়া হয়েছে ‘গাজী নগর’। এই এলাকায় কেউ জমি কিনতে পারবেন না বলে অলিখিত ঘোষণাও দেয়া আছে। কথিত গাজী নগরের সীমানা দেয়ালে পুরো এলাকার নকশা আঁকা। যেখানে বিভিন্ন চিহ্ন দিয়ে স্থানের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন- গাজী সাহেবের পুকুর, গাজী স্টাফ কোয়ার্টার, গাজী অফিসার্স কোয়ার্টার ইত্যাদি। বিভিন্ন চিহ্ন দিয়ে ওই জায়গায় থাকা বিল ও জলাশয়ের অবস্থানও গাজীর সম্পত্তি বলে দেখানো হয়েছে। উপজেলার খাদুন, রূপসী ও বরপা এলাকায় কয়েকশ বিঘা জমি এমপির দখলে। অভিযোগ, এসব জমির অর্ধেকই জবরদখল করা।
এমপি গোলাম দস্তগীর গাজী শুধু মানুষের জমি দখলই করে না। এই এলাকায় কেউ গাজীর সম্মতি ছাড়া জমি কেনাবেচা করতে পারেন না। জমি রেজিস্ট্রেশন করতে হলে আগ্রীম সব বর্ণনা গাজীর নিয়োগকৃত লোকজনকে জানাতে হয়। যে কারণে রূপগঞ্জ সাব রেজিস্ট্রার অফিসের কর্তাব্যক্তিরা এমন বে আইনি কর্মকাণ্ডকে নিয়মে পরিণত করেছেন। তাই বেআইনি হলেও নতুন নিয়ম অনুযায়ী স্থানীয় কেউ জমি কিনতে চাইলে জমির বিস্তারিত আগেই এমপির লোকজনকে জানাতে হয়। তা না হলে জমি রেজিস্ট্রেশন হয় না। কোনো দলিল লেখকও জমির দলিল লিখতে রাজি হন না। জমি রেজিস্ট্রার অফিসে এমন জিম্মিদশা অনেকটাই ওপেন সিক্রেট।
এছাড়া, রাজধানীর পূর্বাচল আবাসিক এলাকায় মার্কেটের নামে স্টেডিয়ামের হাজার কোটি টাকা মূল্যের জমি দখল করে নিয়েছেন গাজী গোলাম দস্তগীর। মার্কেটের নাম ‘নীলা মার্কেট’। প্রকাশ্যে মার্কেটের সর্বেসর্বা রূপগঞ্জ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ফেরদৌসী আলম নীলা।
এলাকাবাসী বলছে, প্রকৃত নিয়ন্ত্রক মানে আসল দখলদার হলেন এমপি। এ জাতীয় দখলের পরও নীরব রাজউক ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। এই সুযোগে গোটা এলাকা এখন এমপি এবং তাঁর সমর্থক দখলবাজদের নিয়ন্ত্রণে। তাঁর বেআইনি কর্মকাণ্ডের ফলে সরকারের সিদ্ধান্ত অকার্যকর এবং নিজ দলীয় নেতাকর্মীরাও কোণঠাসা।
এলাকাবাসীর কাছে নীলা মার্কেট ‘গাজীর লোকদের সাম্রাজ্য’ নামে পরিচিত। এ সাম্রাজ্যে রয়েছে গাড়ি পার্কিং পয়েন্ট, কয়েক শ দোকানপাট, রেন্ট-এ-কারের টার্মিনাল, হোটেল-রেস্তোরাঁ, মাছবাজার, মিষ্টির কারখানা, স্থায়ী-অস্থায়ী বাজারসহ বিভিন্ন অবকাঠামো। সরকারি সিদ্ধান্তে পূর্বাচল আবাসিক এলাকায় সরকারের মন্ত্রী, এমপি, আমলা, বিচারপতিসহ বিভিন্ন মহলের অনেকে প্লট পেয়েছেন। অনাগত প্রজন্মের জন্য সেই প্রকল্পে বিশাল জায়গা বরাদ্দ রাখা হয় স্টেডিয়ামের জন্য। কিন্তু রূপগঞ্জের জায়গাজমি দখলের রেকর্ড স্থাপনকারী এমপির নজর থেকে সেই স্টেডিয়ামের জায়গাটিও রক্ষা পায়নি। অনেক মন্ত্রী ও ক্ষমতাধর ব্যক্তি বিষয়টি জানলেও এমপি গাজীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব অপরাধ কর্মকাণ্ড চালানোর জন্য বিশাল এক সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তুলেছেন গোলাম দস্তগীর। প্রকাশ্যে মাদক বেচাকেনা ও সেবনসহ এমন কোনো অপকর্ম নেই যা তারা করে না। গাজীর এসব কার্মকাণ্ডে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও ক্ষুব্ধ। যার কারণে একাদশ সংসদ নির্বাচনে স্থানীয় আওয়ামী লীগসহ সাধারণ মানুষ এবার গাজীর পক্ষে ছিলেন না।
গাজী তার মনোনয়ন নিশ্চিত করার জন্য রাজধানীর বাড্ডা, ভাটারা, সাতারকুল ও বেরাইদ থেকে লোক নিয়ে মানববন্ধন করেছেন। রূপগঞ্জ থেকে মানববন্ধন করে এসে আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেছিলেন, স্থানীয়রা গাজীর পক্ষে নেই। জমিদখল ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য মানুষ তার ওপর প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ। শেখ হাসিনাকে জনমর্থন দেখানোর জন্য ভাড়া করে আমাদের নিয়ে মানববন্ধন করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো-এমন একজন জমিদখলকারী ও গডফাদার পাচ্ছে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মাননা স্বাধীনতা পুরুস্কার।
সচেতন মহল বলছেন, বাংলাদেশে জাতীয় পর্যায়ে ‘গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ’ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে যে পুরুস্কার বা সম্মাননা দেয়া হয় সেটা হল স্বাধীনতা পুরুস্কার। এক সময় এ পুরুস্কার পেতেন দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। যারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন। কিন্তু এখন আর বিশিষ্ট ও সম্মানিত ব্যক্তিদের ভাগ্যে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মাননা এই স্বাধীনতা পুরস্কার জুটে না। এখন রাষ্ট্রের এই সর্বোচ্চ সম্মাননাকেও করা হয়েছে দলীয় করণ। দলীয় নেতাকর্মী, তেলবাজ ও চামচাদেরকে দেয়া হয় এই পুরস্কার। এমনকি চোর-ডাকাত, গডফাদার ও মানুষের জমিদখলকারীরাও বর্তমানে এই পুরুস্কার পাচ্ছে।