‘চিকিৎসার জন্য’ বিদেশ যেতে জামিন চান খালেদা জিয়া
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা দুর্নীতির (ষড়যন্ত্রমূলক) দুটি মামলায় দণ্ডিত বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার জামিনের জন্য আবেদন করা হয়েছে। স্বাস্থ্যগত কারণ এবং উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে চেয়ে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট (ষড়যন্ত্রমূলক) মামলায় ফের জামিন চেয়ে গতকাল মঙ্গলবার আবেদন করা হয়েছে বলে জানান তার আইনজীবীরা। খালেদা জিয়ার জামিনের আবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন গতকাল বলেন, কারাবন্দি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের চরম অবনতি হয়েছে। দ্রুত তার উন্নত চিকিৎসা দরকার। এ অবস্থায় আমাদের প্রত্যাশা জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা খালেদা জিয়াকে আদালত এবার জামিন দেবে। সে আশায় তার জামিন আবেদন করা হয়েছে। জামিন পেলে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খালেদা জিয়ার এক স্বজন বলেন, আদালত খালেদা জিয়াকে জামিন দিলে পরিবারের পক্ষ থেকে তাকে বিদেশে নিয়ে যাওয়া হবে। চিকিৎসার ব্যয়ভার পরিবারই বহন করবে। তবে আইনজীবীরা জানান, এ মামলায় জামিন পেলেও জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট (ষড়যন্ত্রমূলক) মামলায়ও তাকে জামিন পেতে হবে। তারপরই সম্ভব হবে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাত্রা তবে প্যারোলে মুক্তির বিষয়ে বিএনপি নেতারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট (ষড়যন্ত্রমূলক) মামলায় বিচারিক আদালত তাকে সাত বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিল। এ সাজার বিরুদ্ধে করা আপিল হাইকোর্টে শুনানির পর্যায়ে রয়েছে। সম্প্রতি খালেদা জিয়ার কারামুক্তি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে পক্ষে-বিপক্ষে তুমুল আলোচনা চলছে। গত বছর ১২ ডিসেম্বর এ মামলায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে জামিনের আবেদন খারিজ হলে দুই মাসের কিছু বেশি সময় পর আবারও জামিনের আবেদন করলেন তিনি। বিএনপি এবং দলটির আইনজীবীদের অভিযোগ, সরকারের ইশারায় জামিনযোগ্য মামলায় তাকে জামিন দিচ্ছে না আদালত। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের বক্তব্য হলো খালেদা জিয়া জামিন পাবেন কি পাবেন না সেটি একান্তই আদালতের বিষয়।
বিএনপি চেয়ারপারসনের আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘জামিন চেয়ে এফিডেভিট (হলফনামা) করা হয়েছে। আগামীকাল (আজ) এটি সংশ্লিষ্ট আদালতে শুনানির জন্য উপস্থাপন করা হবে।’ খালেদা জিয়ার অন্য আইনজীবী ও বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, ‘এ বিষয়ে হলফনামা করা হয়েছে। আজ বুধবার এটি বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ উপস্থাপন করা হবে। আদালত এ বিষয়ে শুনানির জন্য তারিখ নির্ধারণ করবেন।’ বিএনপির চেয়ারপারসনের আইনজীবী সগির হোসেন লিয়ন বলেন, ‘এফিডেভিট আকারে জামিনের আবেদন সংশ্লিষ্ট শাখায় জমা দিয়েছি। আবেদনে স্বাস্থ্যগত কারণ দেখানো হয়েছে এবং তিনি (খালেদা জিয়া) জামিন পেলে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাবেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।’
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী খুরশিদ আলম খান বলেন, ‘আমরা তার (খালেদা জিয়া) জামিনের আবেদনের অনুলিপি হাতে পেয়েছি। আইনি লড়াইয়ের জন্য আমরা প্রস্তুত। আগে যেভাবে আইনি লড়াই করেছি, এখনো সেভাবেই করব।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন গতকাল বলেন, কারাবন্দি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের চরম অবনতি হয়েছে। দ্রুত তার উন্নত চিকিৎসা দরকার। এ অবস্থায় আমাদের প্রত্যাশা জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা খালেদা জিয়াকে আদালত এবার জামিন দেবে। সে আশায় তার জামিন আবেদন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, জামিনের আবেদনের শুনানিতে নিশ্চয়ই আবারও আদালত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের সর্বশেষ রিপোর্ট চাইবে। আশা করছি বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ প্রকৃত স্বাস্থ্য রিপোর্ট আদালতে তুলে ধরবে।
এদিকে সরকারদলীয় শীর্ষ রাজনীতিবিদরা ইতিমধ্যেই জানিয়েছেন, প্যারোলে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে তারা নমনীয়। প্যারোলে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে বিএনপির অবস্থান জানতে চাইলে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেছেন, প্যারোলে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য দেওয়া হয়নি। এমনকি কারও সঙ্গে প্যারোলে মুক্তির বিষয়ে কথা হয়নি। প্যারোলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে খালেদা জিয়ার পরিবার।
তিনি বলেন, খালেদা জিয়াকে মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে কারাগারে আটক রাখা হয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী মামলাটি জামিনযোগ্য। তিনি জামিন পেতে পারেন। কিন্তু সরকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে তাকে জামিন না দিয়ে আটক করে রেখেছে। আমরা গত দুই বছর ধরে তার মুক্তির দাবি করে আসছি। আমরা আশা করি জনগণের দাবি খালেদা জিয়ার মুক্তি, সে দাবি অনুযায়ী সরকার তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষের কাছে খালেদা জিয়ার ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার লিখিত আবেদন করেছেন। তাতে খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করতে বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষের গঠিত মেডিকেল বোর্ড যাতে বিদেশে পাঠানোর সুপারিশ করে তার আবেদন জানানো হয়েছে। এখন আমরা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি আদালতের দিকে তাকিয়ে রয়েছি তারা কী সিদ্ধান্ত দেন তা দেখার জন্য।
খালেদা জিয়ার এক স্বজন বলেন, দেশে খালেদা জিয়ার যথাযথ চিকিৎসা হবে না। দীর্ঘদিন বিএসএমএমইউতে থাকার পরও তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় আমাদের কাছে এমনটা মনে হয়েছে। তাই খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ড যাতে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে সুপারিশ করে সেজন্য গত ১১ ফেব্রুয়ারি বিএসএমএমইউ উপাচার্যের কাছে আবেদন করা হয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ খালেদা জিয়ার সর্বশেষ শারীরিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ পাঠানোর বিষয়ে সুপারিশ করবে।
তিনি বলেন, আদালত খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর নির্দেশ দিলে পরিবারের পক্ষ থেকে তাকে বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা দেওয়া হবে। চিকিৎসার যাবতীয় ব্যয়ভার পরিবারের পক্ষ থেকে বহন করা হবে।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় ১০ বছর ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় সাত বছরের কারাদ-প্রাপ্ত খালেদা জিয়া কারা কর্তৃপক্ষের অধীনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। গত ১২ ডিসেম্বর সর্বোচ্চ আদালত যে আদেশ দিয়েছিল তাতে বিএসএমএমইউতে চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়া উন্নত চিকিৎসা (অ্যাডভান্স ট্রিটমেন্ট) চাইলে ওই হাসপাতালের মেডিকেল বোর্ডের পরামর্শ অনুযায়ী দ্রুত তা দেওয়ার পদক্ষেপ নিতে বলে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত আপিল বিভাগ।
২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট (ষড়যন্ত্রমূলক) মামলায় বিচারিক আদালতের খালেদা জিয়াকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেয়। সাজা বাতিল চেয়ে একই বছরের ১৮ নভেম্বর হাইকোর্টে আপিল করেন খালেদা জিয়া। গত বছর ৩০ এপ্রিল হাইকোর্ট ওই আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করে খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে বিচারিক আদালতের দেওয়া অর্থদ-ের আদেশ স্থগিত করে। এরপর ২০ জুন মামলার বিচারিক আদালতের নথি হাইকোর্টে আসার পর খালেদা জিয়ার জামিনের আর্জি জানান তার আইনজীবীরা। পরে ৩১ জুলাই জামিন আবেদন খারিজ করে দেয় হাইকোর্ট। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট (ষড়যন্ত্রমূলক) মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বিএনপির চেয়ারপারসনকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয় বিচারিক আদালত। এরপর সাজার বিরুদ্ধে আপিল করলে হাইকোর্ট তার সাজা বাড়িয়ে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয়। হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে করা আপিল শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
আইনজীবীরা জানান, কারামুক্তি পেতে খালেদা জিয়ার সামনে আইনি পন্থাসহ তিনটি পথ খোলা রয়েছে। এর মধ্যে একটি পন্থা হলো দুই মামলায় (জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়ার চ্যারিটেবল ট্রাস্ট) তাকে উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিতে হবে। এছাড়া বিকল্প পন্থা হিসেবে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ (১) ধারা যেটিতে দণ্ডপ্রাপ্ত কোনো আসামির সাজা স্থগিত করে সরকার যদি কারামুক্তির সুযোগ দেয় এবং প্যারোল (শর্ত সাপেক্ষে বিশেষ ব্যবস্থায় কারামুক্তি)। এ ক্ষেত্রে আদালত থেকে জামিন না পেলে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ (১) এবং প্যারোলে কারামুক্তির সুযোগ থাকবে বিএনপির চেয়ারপারসনের সামনে। তবে প্যারোল নিয়ে বিএনপির অভ্যন্তরে নানা মত রয়েছে। সরকারের তরফেও বলা হয়েছে এ বিষয়ে তারা কোনো আবেদন পাননি। ফৌজদারি আইনের ওই বিধি অনুযায়ী কারা মুক্তির জন্য তাকে পরিবারের কোনো সদস্যের মাধ্যমে সরকারের কাছে আবেদন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকার বিষয়টি বিবেচনা করে সংশ্লিষ্ট আদালতের মতামত সহযোগে নির্বাহী আদেশে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে বলেও জানিয়েছেন আইনজীবীরা। তবে দুদক আইনজীবী খুরশিদ আলম খান বলেন, ‘এখন যেহেতু তিনি জামিনের দরখাস্ত করেছেন তাই বিষয়টি এখন আইনি পর্যায়ে রয়েছে। এখন তার কারামুক্তির প্রশ্নে অন্য কোনো পন্থার বিষয়ে এই মুহূর্তে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। আইনি বিষয় আইনিভাবেই মোকাবিলা করব।’