নামাজ বাধ্যতামূলক নিয়ে সরকারের এতো আপত্তি কেন?
সম্প্রতি গাজীপুরে অবস্থিত মাল্টিফ্যাবস লিমিটেড নামের একটি ফ্যাক্টরিতে নামাজ বাধ্যতা মূলক করেছে কর্তৃপক্ষ। কারখানার নোটিশে বলা হয়েছে অফিস চলাকালীন সময়ে প্রতিদিন মসজিদে গিয়ে যোহর, আসর ও মাগরিবের নামাজ পড়তে হবে এবং এই তিন ওয়াক্ত নামাজ পড়তে যাওয়ার সময় পাঞ্চ মেশিনে পাঞ্চ করতে হবে।
কর্তৃপক্ষ বলছে, কর্মীদের মধ্যে মতভেদ-দূরত্ব কমানোর একটি উপায় হিসাবে কারখানায় নামাজ বাধ্যতামূলক করার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা।
ফ্যাক্টরিটির অপারেশন্স বিষয়ক পরিচালক মেসবাহ ফারুকী বলছেন, “আমাদের এখানে বিভিন্ন মতভেদের লোক আছে। এখানে একটা টিম হিসেবে কাজ করতে হয়। এখানে ফেব্রিক ডিপার্টমেন্টের সাথে নিটিং সেক্টরের হয়ত একটা সমস্যা থাকে। একেকজন একেকজনের উপর দোষারোপ সারাদিন চলতেই থাকে। তো আমি এটার সমাধান হিসেবে চিন্তা করলাম তাদের যদি একসাথে বসানো যায়, একসাথে কিছু সময় যদি তারা কাটায়, তাদের মধ্যে দূরত্বটা কমবে।”
অন্যদিকে এ ধরণের নির্দেশনাকে বাংলাদেশের সংবিধান বিরোধী বলে মন্তব্য করেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। খতিয়ে দেখা হবে বলে হুঁশিয়ারিও দেন এই ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী।
আইনমন্ত্রীর এমন মন্তব্যে সাধারণ মানুষ ও শ্রমিকরা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও প্রতিবাদ জানিয়েছেন অনেকেই। আবার অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে নামাজ বাধ্যতামূলক নিয়ে সরকারের এতো আপত্তি কেন?
তারা বলছেন, নামাজ পড়লে কাজের চাপ অনেক কমে যাবে এটা স্বাভাবিক কিন্তু পুঁজিবাদী আর সমাজতান্ত্রীদের জন্য এটা হুমকি কারণ তারা শ্রমিকদের রক্ত চুষে খেতে না পারলে তাদের শান্তি লাগে না। যেখানে গার্মেন্টস শ্রমিকরা এক মিনিট বিশ্রামের জন্য সুযোগ পায়না, দুপুরের খাওয়ার এক ঘন্টা সময় দিলেও তার ক্ষতিপূরণ স্বরূপ এক ঘন্টা কাজ করতে হয়, সেখানে এমন উদ্যোগ নিশ্চয় প্রশংসনীয়।
অনেকেই বলছেন, একটি প্রতিষ্ঠানে নিজস্ব নিয়ম নীতি থাকতে পারে। কিন্তু সরকার সেখানে হস্তক্ষেপের অধিকার রাখে না। কর্তৃপক্ষ যদি নামাজ বাধ্যতামূলক করা হয় তাহলে এটা ক্ষতির কিছু নয় বরং এটা এক প্রকার শারীরিক উপকার ও দুনিয়া-আখেরাতের জন্য একটি সফলতা। সবচেয়ে বড় কথা গার্মেন্টস কর্তৃপক্ষ অন্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য নামাজ বাধ্যতামূলক করেনি।
অনেকেই আবার প্রশ্ন তুলে লিখেছেন, ধর্মীয় বিধান পালন করা মুসলমানদের নৈতিক দায়িত্ব৷ সেটা পালন করতে বাধ্য করাকে যদি চাপিয়ে দেয়া বা অন্যায় বলা হয় তাহলে যেকোন পর্যায়ে কর্মরত কোন কর্মীকে তার দায়িত্ব পালনে বাধ্য করাটাও তো অন্যায় বলতে হবে। পুলিশের দায়িত্ব হলো জনগণকে নিরাপত্তা দেয়া। কিন্তু সে যদি নিরাপত্তা না দিয়ে তার দায়িত্ব পালনে অবহেলা করে। তখন তাকে তার দায়িত্ব পালনে বাধ্য করা হলে সেটা কি অন্যায় হবে?
তারা বলছেন, ইসলাম ধর্মে তো আছে উর্ধতন অধঃস্তনদের নামাজে বাধ্য করবে। মুসলিমদের জন্য নামাজ বাধ্যতামূলক। এখন মুসলিম পরিচয়ে কারখানায় ঢুকে নামাজ না পড়লে তাকে চাকরিচ্যুত করার অধিকার অবশ্যই রাখে কর্তৃপক্ষ। নইলে তাদেরকেও হয়তো পরকালে জবাবদিহিতার আওতায় আসতে হবে এই দায়িত্বশীল আচরণ না করার কারণে। কর্তৃপক্ষের এমন আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা অধিকার খর্ব করা হবে। তাই তাদের মতো করে তাদের থাকতে দেওয়া উচিৎ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব নিয়ম কানুন থাকতেই পারে, কারো এসব নিয়ম পছন্দ না হলে সে প্রতিষ্ঠানে কাজ না করলেই পারে। কোন স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের আভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে সরকারের সমালোচনা করা অনুচিত। এখানে সংবিধানের বিরোধীতার কোন প্রশ্নই আসেনা। সংবিধানে বলা হয়েছে এক ধর্মের মানুষের উপর অন্য ধর্মের বিষয় চাপিয়ে দিতে পারবেন না। এখানেতো তেমনটা ঘটেনি। কারখানা কর্তৃপক্ষ শুধুমাত্র ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের জন্য নামাজ বাধ্যতামূলক করেছে। তারা বলছেন, কারখানা কর্তৃপক্ষের এমন উদ্যোগ নেতিবাচক না বরং ইতিবাচক। যদি সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় সংগীত বাধ্যতামূলক করতে পারে তাহলে মুসলিমদের জন্য নামাজও বাধ্যতামূলক করা সরকারের দায়িত্ব।
দেখা গেছে, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আভ্যন্তরীণ নিয়ম কানুন নিয়েও সরকারের হস্তক্ষেপ হয়েছে। বছরের শুরুতে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলে মেয়েদের ড্রেসকোডে মাথায় স্কার্ফ বা ওড়না ব্যবহারের নির্দেশনা থাকলেও নতুন প্রণীত ড্রেসকোডে সেখানে স্কার্ফ বা ওড়না ব্যবহার নিষিদ্ধ করে সরকারের ওপর মহলের কর্মকর্তারা। শুধু তাই নয় শিক্ষকদের ড্রেসের বিষয়েও আপত্তি জানায় সরকার। কোনো শিক্ষক এখন থেকে আর পাঞ্জাবী পরে স্কুলে আসতে পারবেন না। পাঞ্জাবী পরলেও এর উপরে বাধ্যতামূলকভাবে আলাদা কটি পরতে হবে। শিক্ষকদের জুতা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও রয়েছে সরকারি হুকুম জারি।