সাত মাসেই ব্যাংক থেকে পুরো বছরের টাকা নিয়েছে সরকার
চলতি অর্থবছরের এখনও ৫ মাস বাকি। অথচ এরইমধ্যে ব্যাংক খাত থেকে সরকার পুরো বছরের টাকা নিয়ে ফেলেছে। শুধু তাই নয়, মাত্র ৭ মাসে পুরো বছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা বেশি নিয়ে ফেলেছে সরকার।বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এমন তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, গত অর্থবছরের (২০১৮-২০১৯) জুলাই থেকে ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত (৭ মাসে) সরকার ব্যাংক খাত থেকে নিয়েছিল মাত্র ৫৫০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের (২০১৯-২০২০) একই সময়ে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ৫৩ হাজার ২১১ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে চলতি অর্থবছরে ব্যাংক থেকে ৫২ হাজার ৬৬১ কোটি টাকা বেশি ঋণ নিয়েছে সরকার। এই টাকার পরিমাণ গত অর্থবছরে সরকার ব্যাংক খাত থেকে যে ঋণ নিয়েছিল, তারচেয়েও ২৯ হাজার কোটি টাকা বেশি।
২০১৯-২০ অর্থবছরে সরকার অভ্যন্তরীণ খাত থেকে মোট ৭৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা ঋণ নেবে বলে ঠিক করে। এর মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৪৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার কথা। কিন্তু মাত্র সাত মাসেই পুরো বছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ৫ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকারও বেশি পরিমাণ ঋণ নিয়েছে সরকার।
সরকারের এভাবে ঋণ নেওয়ার প্রবণতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদরা। এ প্রসঙ্গে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ বেড়ে গেলে সবচেয়ে বড় সমস্যা হয় ব্যক্তি বিনিয়োগ বা বেসরকারি খাতে। এতে একদিকে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতিও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তিনি উল্লেখ করেন, ব্যাংকের টাকা উৎপাদনশীল খাতে গেলে অর্থনীতি চাঙা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি অব্যাহতভাবে কমছে। এতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হচ্ছে। তার মতে, সরকারের ঋণ বেড়ে গেলে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের তহবিল পেতে সমস্যা হয়। ফলে বিনিয়োগ বাড়ে না। বিনিয়োগ না বাড়লে উৎপাদনও বাড়ে না। আর উৎপাদন না হলে বাধাগ্রস্ত হয় সামগ্রিক অর্থনীতি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত সরকারের ব্যাংক ঋণের স্থিতি ছিল ৮৮ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা। ২০২০ সালের ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত সরকারের ব্যাংক ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৬১ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত এক বছরে (১২ মাসে) নতুন করে সরকার ব্যাংক থেকে ৭২ হাজার ৪৯৯ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, সরকারের নেওয়া ৫৩ হাজার ২১১ কোটি টাকার মধ্যে ৪৪ হাজার ৫৮৮ কোটি টাকাই নিয়েছে বেরসকারি ব্যাংক থেকে। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নিয়েছে ৮ হাজার ৬২৩ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ১০ বছরের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের সবচেয়ে বেশি ধার করার রেকর্ডটি ছিল ২০১৮-১৯ অর্থবছরের। তবে ওই অর্থবছরে ধার নেওয়ার পরিমাণ ছিল ৩০ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা। অথচ এই অর্থবছরের সাত মাসেই পুরো অর্থবছরের টাকা নেওয়া শেষ করেছে সরকার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযাযী, ব্যাংক থেকে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের চেয়ে সরকারের ঋণের প্রবৃদ্ধি বেশি হচ্ছে। বেসরকারি খাতে ২৭ শতাংশ ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে এখন ৯ শতাংশের ঘরে নেমেছে। আর সরকারি খাতে ১২ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫৯ দশমিক ৮১ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে।
এদিকে সরকারের ঋণ নেওয়ার প্রবণতা বাড়ায় আশানুরূপ ঋণ পাচ্ছে না বেসরকারি খাত। গত কয়েক মাস ধরে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার ধারাবাহিকভাবে কমছে। গত ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ। এই হার গত দশ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরের নভেম্বরে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ, অক্টোবরে ছিল ১০ দশমিক ০৪ শতাংশ। যা আগের মাস সেপ্টেম্বরে ছিল ১০ দশমিক ৬৬ শতাংশ। আগস্টে ছিল ১০ দশমিক ৬৮ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সংগঠন ‘অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ’ এর সাবেক চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, সরকারের ঋণ নেওয়া বাড়লে বেসরকারি খাতে ঋণ দেওয়াটা কঠিন হয়ে পড়ে। চলমান প্রবণতায় কিছুটা চাপ সৃষ্টি হলেও ব্যাংকগুলোর তহবিল বাড়ানো সম্ভব হলে সমস্যা থাকবে না বলেও মনে করেন তিনি।