ধাক্কা সামালের অবস্থায় নেই ব্যাংক খাত
দেশের ব্যাংক খাত নিয়ে বড় ধরনের আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলা হয়েছে, অভিঘাত সামলানোর মতো অবস্থায় নেই ব্যাংক খাত। বড় ধরনের ধাক্কা এলে ব্যাংক খাতের মূলধন সংরক্ষণের হার ঋণাত্মক ৭ দশমিক ২২ শতাংশে নেমে যাবে। এ ধাক্কা মাঝারি মানের হলে মূলধন সংরক্ষণের হার এক শতাংশের নিচে অর্থাৎ শূন্য দশমিক ৭ শতাংশে নেমে যাবে।
আর এ ধাক্কা ন্যূনতম হলেও মূলধন সংরক্ষণের হার সোয়া ৮ শতাংশে নেমে যাবে। ব্যাংক খাতের ঝুঁকিসহন ক্ষমতা যাচাই (স্ট্রেস টেস্ট) প্রতিবেদনে এমনই আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করা হয়েছে। ব্যাংকগুলো এখনই ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আগাম পদক্ষেপ না নিলে ব্যাংকিংব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে বলে বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন।
জানা গেছে, ব্যাংক খাতের যেকোনো অভিঘাত বা ধাক্কা এলে তার সহ্য করার ক্ষমতা কতটুকু তা যাচাই করে থাকে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ঝুঁকিসহন ক্ষমতা যাচাইকে ব্যাংকিং ভাষায় স্ট্রেস টেস্ট বলা হয়। কতগুলো সূচক বা নির্দেশকের মাধ্যমে এ ঝুঁকিসহন ক্ষমতা যাচাই করা হয়। এর মধ্যে প্রধান তিনটি সূচক হলো- ঋণ ঝুঁকি, বাজার ঝুঁকি, ও তারল্য ঝুঁকি। ঋণ ঝুঁকির মধ্যে আবার পাঁচটি উপাদান রয়েছে। এর মধ্যে সরাসরি শ্রেণীকৃত ঋণের হার বৃদ্ধিজনিত ঝুঁকি, বড় ঋণগ্রহীতাদের ঋণ শ্রেণীকৃত হওয়া ঝুঁকি, সহায়ক জামানতের মূল্য হ্রাসকৃত ঝুঁকি, শ্রেণীকৃত ঋণের মান হ্রাস হওয়াকৃত ঝুঁকি এবং কোনো নির্দিষ্ট খাতে ঋণ শ্রেণীকৃত হওয়ার ঝুঁকি।
আর বাজার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, সুদহার পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি এবং পুঁজিবাজারে মূল্য হ্রাসজনিত ঝুঁকি। অপর দিকে তারল্য ঝুঁকির আওতায়, কোনো প্রকার আমানত গ্রহণ ছাড়াই পাঁচ দিন পর্যন্ত গ্রাহকের চাহিদা মেটানোর সক্ষমতা একটি ব্যাংকের আছে কি না- তা যাচাই করা হয়। প্রত্যেক নির্দেশকের তিন রকমের অভিঘাত যাচাই করা হয়। এর মধ্যে ন্যূনতম অভিঘাত, যা শক-১, মাঝারি অভিঘাত যা শক-২ এবং বৃহৎ অভিঘাত যা শক-৩ নামে অভিহিত।
সাধারণত তিন মাস অন্তর এ ঝুঁকিসহন ক্ষমতা যাচাই করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ শেষ স্ট্রেস টেস্ট প্রতিবেদন দেয়া হয় সেপ্টেম্বরভিত্তিক তথ্যের ভিত্তিতে। সর্বশেষ ওই প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত ন্যূনতম অভিঘাত বা ধাক্কা সামলানের অবস্থায় নেই। স্ট্রেস টেস্ট প্রতিবেদন অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সরাসরি শ্রেণীকৃত ঋণ বৃদ্ধির পাওয়ার ক্ষেত্রে। এর পরেই রয়েছে শীর্ষ ঋণগ্রাহকের শ্রেণীকৃত হওয়া।
এরপর পর্যায়ক্রমে রয়েছে, নির্দিষ্ট খাত শ্রেণীকৃত হওয়া ও সহায়ক জামানতের মূল্যহ্রাস পাওয়া। তবে দেশের ব্যাংকিং খাতে বাজার ঝুঁকির প্রভাব খুব বেশি নয়।
দেশের ব্যাংকিং খাতের বর্তমান প্রেক্ষাপট অনুযায়ী, বড় অভিঘাত এলে অর্থাৎ খেলাপি ঋণ ১৫ শতাংশ বাড়লে ন্যূনতম মূলধন তথা ১১ দশমিক ৬৫ শতাংশ হারে মূলধন সংরক্ষণ করতে ব্যর্থ হবে দেশের ৩৪টি সরকারি ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক। মাঝারি অভিঘাত অর্থাৎ খেলাপি ঋণ ৯ শতাংশ বাড়লেও ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হবে ৯টি বাণিজ্যিক ব্যাংক।
বড় ঋণগ্রহীতাদের ঋণ বৃদ্ধিজনিত ঝুঁকির মধ্যে বড় অভিঘাত এলে অর্থাৎ শীর্ষ ১০জন ঋণগ্রহীতা ঋণখেলাপি হলে ৩৭টি বাণিজ্যিক ব্যাংক ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হবে। আর মাঝারি মানের ধাক্কা অর্থাৎ শীর্ষ সাতজন ঋণগ্রহীতা ঋণখেলাপি হলে ৩৫টি বাণিজ্যিক ব্যাংক ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণ করতে পারবে না। আর ন্যূনতম অভিঘাত অর্থাৎ তিন শীর্ষ ঋণগ্রহীতাও যদি ঋণখেলাপি হন তাহলে ২১টি বাণিজ্যিক ব্যাংক ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণ করতে পারবে না।
এ দিকে এ পর্যন্ত যেসব ব্যাংকের বড় ধরনের ঋণকেলেঙ্কারির তথ্য প্রকাশ পেয়েছে তার বেশির ভাগ ঋণেরই পর্যাপ্ত সহায়ক জামানত ছিল না। আবার যে পরিমাণ সহায়ক জামানত ছিল তার বেশির ভাগই সরকারি খাস জমি, ভুয়া দলিল অথবা ঋণের বিপরীতে সহায়ক জামানতের মূল্য ১০ শতাংশও নেই।
সহায়ক জামানতের মূল্য হ্রাসজনিত ঝুঁকির বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্ট্রেস টেস্ট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঋণের বিপরীতে সহায়ক জামানতের মূল্য ৪০ শতাংশ কমে গেলে ব্যাংকিং খাতের ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণের হার ৮ দশমিক ৯৯ শতাংশে নেমে আসবে। আর এ ঝুঁকি মাঝারি মানের হলেও অর্থাৎ সহায়ক জামানতের মূল্য ২০ শতাংশ কমে গেলে মূলধন সংরক্ষণের হার সোয়া ১০ শতাংশে নেমে যাবে।
ব্যাংক খাতে সাধারণত তিন ধরনের খেলাপি ঋণ রয়েছে। এর মধ্যে নিম্নমানের খেলাপি ঋণ, সন্দেহজনক খেলাপি ঋণ এবং মন্দমানের খেলাপি ঋণ। খেলাপি ঋণ মন্দমানের হলে ওই ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয়। আর প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় ব্যাংকের আয় খাত থেকে। এ কারণে খেলাপি ঋণ মন্দমানের বেশি হলে ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা কমে যায়। অনেক ব্যাংকের আয় দিয়েও তা সঙ্কুলান করতে পারে না। এর ফলে প্রভিশন ঘাটতিতে পড়ে ব্যাংকগুলো।
আবার মন্দ ঋণের বিপরীতে যে আয় হয় ওই আয় ব্যাংকগুলো আয় খাতে নিতে পারে না। সুদ আয় স্থগিত করে আলাদা হিসেবে রাখতে হয়। খেলাপি ঋণের গুণগত মান পরিবর্তন ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্টেস টেস্ট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বড় ধরনের ধাক্কা অর্থাৎ খেলাপি ঋণের গুণগত মান যদি ১৫ শতাংশ পরিবর্তন হয় তাহলে বিদ্যমান অবস্থায় ব্যাংক খাতের মূলধন সংরক্ষণের হার ছয় শতাংশে নেমে আসবে। আর যদি মাঝারি মানেরও ধাক্কাও আসে তাহলে মূলধন সংরক্ষণের হার ৭ দশমিক ৪৭ শতাংশে নেমে আসবে। আর যদি ন্যূনতম ধাক্কাও আসে তাহলেও ব্যাংক খাতের ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণের হার ১০ দশমিক ৯২ শতাংশে নেমে আসবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের স্ট্রেস টেস্ট প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাজার ঝুঁকির ক্ষেত্রে দেশের ব্যাংক খাতের বর্তমান অবস্থায় তেমনে কোনো প্রভাব পড়বে না। তবে বাজার ঝুঁকি ও ঋণঝুঁকি একত্রে এলে আমাদের ব্যাংক খাত ন্যূনতম ধাক্কাও সামলাতে পারবে না। কারণ, বড় ধরনের অভিঘাত এলে দেশের ৩৯টি ব্যাংক মূলধন হারাবে। অর্থাৎ মূলধন ঋণাত্মক ৭ দশমিক ২২ শতাংশে নেমে আসবে।
আর মাঝারি মানের ধাক্কা এলেও ৩৮টি ব্যাংক মূলধন হারাবে। অর্থাৎ ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণের হার ১ শতাংশের নিচে (শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ) নেমে আসবে। আর ন্যূনতম ধাক্কা এলেও ১২টি ব্যাংক মূলধন সংরক্ষণ করতে পারবে না। অর্থাৎ ব্যাংক খাতের ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণের হার ৮ দশমিক ৩২ শতাংশে নেমে আসবে।
ব্যাংকিং খাতের বর্তমান অবস্থা উত্তরণ করতে না পারলে বড় ধরনের বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, ব্যাংকগুলো এখনই ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আগাম ব্যবস্থা না নিলে ব্যাংকিং ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে। এতে এ খাতের ওপর গ্রাহকের আস্থা নষ্ট হবে, যা সামগ্রিক অর্থনীতিতেই নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এ বিষয়ে জানিয়েছেন, ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেছে। বড় বড় গ্রাহকের কাছে ব্যাংকঋণ কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ছে। তাদের কাছ থেকে ঋণ আদায় কমে গেছে। এটাই ঝুঁকির অন্যতম কারণ বলে তিনি মনে করেন। এটা অব্যাহত থাকলে ব্যাংকগুলোর যেকোনো প্রকার লেনদেনের সক্ষমতা কমে যাবে। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে যাবে। কাক্সিত হারে জাতীয় ঋণ প্রবৃদ্ধি হবে না।
ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর এ বিষয়ে জানিয়েছেন, নানা কারণে ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকিসহন ক্ষমতা কমে গেছে। বিভিন্ন ঝুঁকিতে দেশের ব্যাংকিং খাত নাজুক হয়ে পড়েছে। গত ১০ বছরে ব্যাংকের মুনাফা প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কমেছে। একই সাথে কমেছে আমানত এবং ব্যাংকগুলোর ঋণ দেয়ার সমতা। কিন্তু এসব সমস্যা যথাযথভাবে আমলে নেয়া বা স্বীকার করা হচ্ছে না।
তিনি বলেন, ব্যাংকের মন্দ ঋণ বেড়েছে বিপুল হারে। কিছু গ্রাহককে বিপুল আঙ্কের ঋণ দেয়া হচ্ছে। এতে যেকোনো অবস্থার পরিবর্তন হলে এসব গ্রাহকের কাছ থেকে ঋণ আদায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। আর এ কারণেই ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকির মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
ড. মনসুর বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের স্ট্রেস টেস্ট অনুযায়ী এমনিতেই ১০টি ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে। এর ওপর ন্যূনতম ধাক্কা এলে আরও ১২টি ব্যাংকসহ মোট ১২টি ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে পড়বে। আর তিনজন শীর্ষ ঋণ গ্রাহকের সমস্যা হলে ২১টি ব্যাংক মূলধন ঘাটতির মুখে পড়বে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ প্রতিবেদন বড় ধরনের বিপদের কথাই মনে করে দিচ্ছে। এসব ধাক্কা সামলানোর সক্ষমতা ব্যাংকগুলোকে বাড়াতে হবে। না হলে বড় ধরনের বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব হবে না বলে মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ।