নাম মিলনমেলা, অথচ উচ্ছ্বাস নেই, আছে বিএনপি নেতাকর্মীদের বেদনার্ত-ভয়ংকর অতীত!
নাম মিলনমেলা, অথচ উচ্ছ্বাস নেই! আছে বেদনার্ত-ভয়ংকর অতীত! যে স্মৃতি দুঃস্বপ্নের মতো তাড়া করে ফেরে! সেই দুঃস্বপ্নের স্মৃতিময় ভয়ংকর অতীতের মিলনমেলা বসেছিল যশোরে। ‘ভিন্নমতের কারণে নির্যাতন, জেল-জুলুমের শিকারদের’ এই মিলনমেলা আয়োজন করে যশোর সদর উপজেলা ও নগর বিএনপি।
রোববার (১২ জানুয়ারি) যশোর জেস গার্ডেন পার্কে দিনভর এই মিলনমেলায় অংশ নেন বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের প্রায় তিন হাজার নেতাকর্মী। মিলনমেলায় অতীত হাতড়ে চোখের জলে ভাসেন তারা।
মিলনমেলায় আগতদের কারো পা নেই, কেউ ক্র্যাচে ভর করে ঘুরছেন, কেউবা বছরের পর বছর ছিলেন পরিবার পরিজন ছাড়া। কেউ আবার মামলায় জর্জরিত হয়ে বছরের পর বছর থেকেছেন কারাগারে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে ‘ভিন্নমতের’ কারণে অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার তারা।
দীর্ঘদিন পর রোববার এই মিলনমেলায় এসে একে অন্যের সঙ্গে উন্মুক্ত পরিবেশে খাওয়া দাওয়া, কুশল বিনিময় আর স্মৃতিচারণ করেন তারা। ভয়ংকর-আতঙ্কিত অতীত সামনে এনে স্মৃতিকাতর হয়ে অনেকেই ভেঙে পড়েন কান্নায়।
যশোর সদরের লেবুতলা ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক হায়দার আলী জানান, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোট নিয়ে সমালোচনা করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দেন তিনি। পরে পুলিশ স্থানীয় বাজার থেকে তুলে এনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও নাশকতা মামলার আসামি করে কারাগারে পাঠায়। দীর্ঘ দুই বছর তিন মাস কারাভোগের পর বাড়ি ফিরলেও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের লাগাতার হামলা মামলায় জর্জরিত তিনি।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘লোকসমাগম হওয়া কোনো অনুষ্ঠানে যোগদান করতে পারিনি, পুলিশি আটকের ভয়ে। এখন উন্মুক্ত পরিবেশে এমন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পেরে ভালো লাগছে। কিন্তু মনের মধ্যে পুলিশি আতঙ্ক তাড়া করে ফিরছে!’
পার্কের একটি মেহগনি গাছের সঙ্গে প্লাস্টিক চেয়ারে হেলান দিয়ে উদাস মনে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলেন ইউনুচ আলী ওরফে তারা বাবু। তিনি সদর উপজেলার দেয়াড়া ইউনিয়ন বিএনপির সহ-প্রচার সম্পাদক। সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি পরিহিত চল্লিশোর্ধ্ব এই ব্যক্তির পাশে পড়ে ছিল দুটি ক্র্যাচ। ক্র্যাচে ভর দিয়েই তিনি এসেছিলেন মিলনমেলায়।
ইউনুচ আলী জানালেন, ভিন্নমতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে ২০১৪ সালের ২৭ মার্চ বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় সাদা পোশাকধারী পুলিশ। এরপর অস্ত্র উদ্ধারের নাটক সাজিয়ে পায়ে গুলি করে হাসপাতালে ভর্তি করে। চিকিৎসায় একটি পা কেটে ফেলতে হয় তার। এরপর অস্ত্র, নাশকতার মামলার আসামি করে আদালতে পাঠালে তাকে কারাগারে পাঠান বিচারক।
তিনি বলেন, দুই বছরের বেশি সময় কারাভোগ করে বাড়ি ফিরলেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি তিনি। কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড না করলেও শুধুমাত্র বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলেই বিগত সরকারের পুলিশ তাকে পঙ্গু করেছে।
শুধু এই দু’জন নন, বিগত সরকারের শাসনামলে ‘ভিন্নমতের কারণে’ যশোর বিএনপির কয়েক হাজার নেতাকর্মী অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বছরের পর বছর ঘটে যাওয়া নির্যাতনের চিহ্ন এখনও তারা শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছেন। বিগত সরকারের সময় নির্যাতন নিপীড়নের শিকার হওয়া প্রায় তিন হাজার বিএনপি নেতাকর্মীকে এই মিলনমেলায় নিয়ে আসে যশোর সদর ও নগর বিএনপি। দীর্ঘদিন পর মুক্ত আকাশের নিচে বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে একে অপরের কুশল বিনিময় করেন এসব নেতাকর্মী।
বিগত সময়ে আওয়ামী লীগের দুঃশাসনে নির্যাতিত নেতাকর্মীদের সম্মান জানাতে এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক (খুলনা বিভাগ) অনিন্দ্য ইসলাম অমিত।
তিনি বলেন, ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে সদর উপজেলা ও নগর বিএনপির অনেক নেতাকর্মী রাজপথে ছিলেন। অনেকে মিথ্যা মামলায় জেলে গেছেন। অনেকে শহীদ হয়েছেন। পঙ্গুত্ববরণ করেছেন অনেকেই। আমরা চেয়েছি ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশকে একটি কাতারে আনতে। আত্মার আত্মত্যাগকে সম্মান জানানোর জন্য মিলনমেলার আয়োজন করা হয়েছে। একইসঙ্গে জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি মনে করে, ফ্যাসিবাদের পতন শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষে সম্ভব ছিল না। আমরা বারংবারই সমমনা রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষকে ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের আহ্বান জানিয়েছি। ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে সবাই অংশ নিয়েছে। তাই শুধু দলীয় নেতাকর্মী নয়, ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়া চিকিৎসক, শিক্ষক, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, ছাত্রপ্রতিনিধি, নারী নেত্রীসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষকে সম্মান জানানোর জন্য এই মিলনমেলা। তাদের আত্মত্যাগকেও আমরা সম্মান জানাচ্ছি। নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ঐক্যবদ্ধ না থাকলে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন সম্ভব হবে না। এই আয়োজনের মাধ্যমে সেই বার্তা দিতে চাই।