সুন্দর নাম রাখার ইসলামিক দৃষ্টিকোণ
বাংলা উইকিপিডিয়ায় শিশুর সংজ্ঞা এভাবে দেয়া আছে- শিশু বা ইংরেজিতে ‘চাইল্ড’ হচ্ছে ভূমিষ্ঠকালীন ব্যক্তির প্রাথমিক রূপ। যে এখনো যৌবনপ্রাপ্ত হয়নি। কিংবা বয়ঃসন্ধিক্ষণে পৌঁছেনি। সে শিশু হিসেবে সমাজ এবং রাষ্ট্রে পরিচিত হবে। সাধারণত ১৫ বছরের নিচে অবস্থানকারীদের শিশু বলা হয়। জীববিজ্ঞানের ভাষায়- ‘মনুষ্য সন্তানের জন্ম এবং বয়ঃসন্ধির মধ্যবর্তী পর্যায়ের রূপই হচ্ছে শিশু।’ চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায়- ‘মায়ের মাতৃগর্ভে ভ্রুণ আকারে অভূমিষ্ঠ সন্তানই শিশু।’ সুতরাং আমরা বলতে পারি, যারা অপ্রাপ্তবয়স্ক এবং বুদ্ধি-বিবেচনার কোনো জ্ঞান রাখে না তারাই শিশু।
সুন্দর ও অর্থবহ নামের গুরুত্ব : মানুষ মাত্রই সুন্দরের জন্য লালায়িত। কিটস বলেছেন, ‘সুন্দর জিনিস চিরকালের আনন্দ।’ সুন্দরের প্রত্যাশী কিটস আরো বলেছেন, ‘সৌন্দর্যই সত্য, সত্যই সৌন্দর্য।’ শিলার বলেছেন, ‘সত্য জ্ঞানের জন্য বিদ্যমান থাকে আর সৌন্দর্য মানুষের অন্তরের পরিপূর্ণতা আনে।’ তাই সৌন্দর্যের প্রতি মানুষের আকর্ষণ চিরকালের। একটি শিশু জন্মগ্রহণের আগেই মা-বাবা একটি সুন্দর নামের খোঁজে সদা ব্যস্ত থাকেন। সুন্দর নাম রাখার চেয়ে এই শিশুর জন্য শ্রেষ্ঠ উপহার আর কিছু হতে পারে না। অবশ্য যেকোনো জিনিসের জন্য নামকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নাম ছাড়া তার পরিচয় পূর্ণ হতে পারে না। কার্ভেন্টিস বলেছেন, ‘অনেক ধন-সম্পদের চেয়ে একটা সুন্দর নাম ভালো।’ ইসলামের দৃষ্টিতে অর্থবহ এবং সুন্দর নাম বলতে বুঝায় ওই সমস্ত নাম, যে নামের মধ্য দিয়ে আল্লাহর প্রশংসা, দাসত্ব প্রকাশ পায়। আল্লাহর প্রিয়পাত্র নবী-রাসূলদের বরকতময় নামসমূহ। অথবা পুণ্যবান মনীষীদের নাম যারা মুসলিম জাতির সঙ্কটকালে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ইসলামী চেতনা পরিপন্থী কোনো নাম রাখা উচিত নয়, যে নামের দ্বারা আল্লাহর রহমত, করুণা ও মহত্ত্ব ফুটে উঠে সে ধরনের নাম রাখাই উত্তম।
সুন্দর নাম রাখা ইসলামিক দৃষ্টিকোণ : বিশ্বের সর্বাধিক পঠিত ধর্মগ্রন্থ আল কুরআনে বলা হয়েছে, ‘সুন্দরতম নামসমূহের অধিকারী আল্লাহ, অতএব তোমরা সেসব নাম ধরে তাঁকে ডাকো। যারা তাঁর নাম বিকৃত করে তাদেরকে বর্জন করো, তাদের কৃতকর্মের ফল তাদের দেয়া হবে’ (সূরা আরাফ-১৮০)।
এত সুন্দরভাবে সুন্দর নামে আল্লাহকে ডাকার ব্যাপারে বলেছেন। তাই নাম সুন্দর হওয়া এবং সুন্দরভাবে ডাকার কোনোমতেই উপেক্ষার সুযোগ নেই। অন্যত্র বলেছেন, আল্লাহ নিজে সুন্দর, তাই তিনি সুন্দরকে ভালোবাসেন। মানব জাতির আদি পিতা হজরত আদম আ:কে সৃষ্টি করে তিনি বিভিন্ন নাম শিক্ষা দিয়ে পরিচয় করে দিয়েছিলেন। কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে- ‘তিনি (আল্লাহ) আদম আ:কে যাবতীয় নামসমূহ শিক্ষা দিলেন, অতঃপর সে সব ফেরেশতার সামনে পেশ করলেন এবং বললেন, এ সমুদয়ের নাম আমাকে বলে দাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হও। তাঁরা (ফেরেশতারা) বললেন, ‘আপনি মহাপবিত্র! আপনি আমাদের যা শিখিয়েছেন, তা ব্যতীত আমাদের তো কোনো জ্ঞানই নেই। বস্তুত আপনি জ্ঞানময় ও প্রজ্ঞাময়’ (সূরা বাকারা- ৩১-৩২)।
তাই ইসলামে নামে গুরুত্ব সর্বাধিক, কারণ কিয়ামতের ময়দানে আল্লাহপাক ব্যক্তির নাম এবং পিতার নাম ধরে ডাকবেন। হজরত আবু দারদা রা: থেকে বর্ণিত, রাসূল সা: বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন তোমাদেরকে ডাকা হবে তোমাদের নামে এবং তোমাদের পিতার নামে। অতএব তোমাদের নামগুলো সুন্দর করে রাখো’ (আবু দাউদ, বায়হাকি ও মুসনাদে আহমদ)।
রাসূল সা: বলেন, ‘যখন তোমরা কারো নাম মুহাম্মদ রাখবে, তখন তাকে তোমরা মারবে না এবং বঞ্চিত করবে না।’ রাসূল সা: আরো বলেন, ‘তোমরা শিশুদের নাম মুহাম্মদও রাখবে আবার তাকে অভিশাপ ও গালাগালও দেবে?’ (অর্থাৎ এ নামের শিশুদের সাথে কোনো খারাপ ব্যবহার করবে না) এমনিতেই শিশুদের সাথে খারাপ ব্যবহার নিন্দনীয় কাজ। আর যদি মুহাম্মদ রাখা হয়, তাহলে আরো সাবধান হওয়া দরকার। এর বাস্তবরূপ আমরা দেখি যখন আরব দেশ তথা মধ্যপ্রাচ্য সফর করি। অপরিচিত কাউকে সম্বোধন করা হয় তখন ‘মুহাম্মদ’ বা ‘আহম্মদ’ বলে ডাকে। হজরত আবু মুছা রা: বলেন, ‘আমার প্রথম সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরে আমি তাকে নবী সা:-এর কাছে নিয়ে গেলাম। তিনি তার নাম রাখলেন ইবরাহিম। খেজুর চিবিয়ে তার মুখে দিলেন এবং খায়ের ও বরকতের জন্য দোয়া করে আমার কাছে ফিরিয়ে দেন।’
শাশ্বত জীবন বিধান ইসলামে শিশুর নাম রাখাটা সন্তানের অধিকার বলে উল্লেখ করেছেন। শিশুর জন্য সুন্দর নাম নির্বাচন করা বাবা-মায়ের অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য। নাম অর্থবহ হওয়া নামের সৌন্দর্য। কেননা রাসূল সা: অনেক অসুন্দর নামের পরির্বতন করে দিয়েছিলেন। বাজে অর্থহীন নাম তিনি পছন্দ করতেন না। অপছন্দ হলে পরিবর্তন করে তিনি উত্তম নাম দিতেন। হজরত আবদুর রহমান রা: বলেন, ‘আমি রাসূল সা:-এর কাছে উপস্থিত হলাম। তিনি প্রশ্ন করলেন? তোমার নাম কি? আমি বললাম, আমার নাম আবদুল উজ্জা।’ তিনি বললেন, ‘না তোমার নাম আবদুর রহমান, অন্য রেওয়ায়েতে আছে, আমার নাম আজিজ, মহানবী সা: বললেন, ‘আজিজ তো আল্লাহ! (উজ্জা একটি মূর্তির নাম। আবদুল উজ্জা মানে হলো উজ্জার দাস এবং কাউকে আজিজ বলে ডাকাও নিষেধ। পুরো নাম আবদুল আজিজ এভাবে ডাকা উচিত। অনেকে নাম পরিবর্তনের ব্যাপারে নিয়মমাফিক করার কথা বলে থাকেন বা নাম এভাবে হঠাৎ করে পরিবর্তন নিয়েও প্রশ্ন করেন? অথচ আল্লাহর রাসূল সা: তাৎক্ষণিকই পরিবর্তন করে দিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে গড়িমসি কাম্য নয়।
বর্তমানে নাম দেখলে বুঝার কোনো উপায় নেই যে, কোন ধর্মের? নামে কী অবস্থা! মুসলমানের নাম রাখি- গুড্ডু, গুল্লু, টিটন, মিল্টন, ডন, ময়না, টিয়া, ফুলি, গিটটু, আরো কত কি? অনেক সময় কাফের-মুশরিকদের নেতাদের নামে নাম রাখি। অনেক সময় হারাম এবং মাকরুহ নামও রাখি। যেমন- গোলাম রাসূল (রাসূলের দাস), আবদুল নবী (নবীর দাস) ইত্যাদি। আল্লাহর রাসূলের উম্মত দাবি করার পরও তাঁর নির্দেশনায় নাম রাখি না। তিনি বলেছেন, নবীদের নামে নাম রাখো। আল্লাহর নিকট পছন্দনীয় নাম হলো আবদুল্লাহ এবং আবদুর রহমান। প্রিয় নাম হলো হারেস এবং হাম্মাম। অত্যন্ত অপছন্দের নাম হলো হারব ও মুররাহ। সুতরাং নাম ইসলামী সংস্কৃতি ও সভ্যতার পরিচায়ক, একে গুরুত্ব না দেয়া হলে জাতি হিসেবে আমরা পরিচিতি হারিয়ে ফেলব।