দেবীদুর্গার বিদায় বেলায় মণ্ডপে মণ্ডপে সিঁদুর খেলায় মেতেছে হিন্দু ধর্মাবলম্বী নারীরা
দেবীদুর্গার বিদায় বেলায় বগুড়ার বিভিন্ন এলাকায় মণ্ডপে মণ্ডপে দুর্গা মাকে সিঁদুরে রাঙ্গিয়ে সিঁদুর খেলায় মেতে উঠেছে হিন্দু ধর্মাবলম্বী নারীরা।
কেননা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের শারদীয় দুর্গোৎসবে ধর্মীয় রীতিনীতি অনুযায়ী এখন দেবীদুর্গাকে বিসর্জন দেওয়ার পালা।
বিজয়াদশীর তিথিতে দেবী দুর্গাকে বিদায় জানানোর সময় সন্নিকটে। শহরের বিভিন্ন মন্দিরের চিত্র ছিল আনন্দময় ও উৎসব মুখর।
রোববার (১৩ অক্টোবর) সকালে শহরের মালতিনগর, দত্তবাড়ি, ডালপট্রি, চেলোপাড়া, জলেশ্বরীতলাসহ বেশ কয়েকটি এলাকার পূজামণ্ডপে গিয়ে এমন দৃশ্য চোখে পড়ে।
এ বছর বগুড়া জেলায় মোট ১২টি উপজেলায় ৬৩৪টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এখন পর্যন্ত জেলার কোথাও কোনো বিশৃঙ্খলা ছাড়াই সবকটি মন্দির বা মণ্ডপে আনন্দ উৎসবের সঙ্গে দুর্গোৎসব পালন করেছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা।
গত ৯ অক্টোবর ষষ্ঠীতে দশভুজা দেবী দুর্গার আমন্ত্রণ ও অধিবাসনের মাধ্যমে শুরু হয় পূজার আনুষ্ঠানিকতা। উঁচু-নিচু, ধনী-গরিব ভেদাভেদ ভুলে পরবর্তী চার দিন হিন্দু ধর্মাবলম্বীসহ আপামর বাঙালি মেতে উঠে দুর্গোৎসবে। এবার দেবীর আগমন হয়েছে দোলায় (পালকি) এবং গমন হবে ঘোটকে (ঘোড়ায়)। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রত্যাশা ছিল দেবীর আগমনে বিশ্ব হবে শান্তিময়, অশুভ শক্তিকে বিনাশ করে উদয় হবে শুভ শক্তির। এখন ঢাক-ঢোল, শঙ্খ ধ্বনি আর উলুধ্বনি দিয়ে দেবী দুর্গাকে বিদায় দেওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে ভক্তরা।
জেলা পূজা উদ্যাপন পরিষদের তথ্য মতে, জেলার ১২টি উপজেলার মধ্যে বগুড়া সদরে ১১৭টি, শাজাহানপুরে ৪৮টি, শিবগঞ্জে ৫৩টি, সোনাতলায় ৪১টি, সারিয়াকান্দিতে ২৩টি, ধুনটে ২৮টি, গাবতলীতে ৬৩টি, শেরপুরে ৮৬টি, নন্দীগ্রামে ৪৫টি, কাহালুতে ২৭টি, আদমদীঘিতে ৬৩টি এবং দুপচাঁচিয়ায় ৪০টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এদিকে শেষ সময় মন্দিরে মন্দিরে ঢাকের তালে সিঁদুর খেলায় মেতে উঠে সব বয়সের বিবাহিত নারীরা। তাদের একে অপরকে রং এ রাঙ্গিয়ে আনন্দ উৎসব করে। আজকের দিনটিতে মা দুর্গাকে সিঁদুর দিয়ে তারপর নিজেরা একে অপরকে সিঁদুর দেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী নারীরা। এটি হিন্দু নারীরা দেবী দুর্গার আশীর্বাদ হিসেবে গ্রহণ করে।
সরেজমিনে দেখা যায়, ভোর থেকেই শহরের দত্তবাড়ি, ডালপট্রি, চেলোপাড়া, মালতিনগর, জলেশ্বরীতলাসহ বিভিন্ন এলাকায় পূজামণ্ডপগুলোতে বাজছে বিদায়ের সুর। সকাল থেকেই ভক্তরা দেবী দুর্গার দর্শন পেতে ছুটছেন মণ্ডপগুলোতে। শেষ বেলায় দেবী দুর্গার আরাধনায় ব্যস্ত ভক্তরা। বিদায় মুহূর্তে মণ্ডপে মণ্ডপে ভক্তরা মেতেছে সিঁদুর খেলায়। ভক্তরা একে অপরের কপালে সিঁদুর দিচ্ছেন। গালে গালে কেটে দেন সিঁদুরের আঁচড়। সব মন্দিরের চিত্র ছিল আনন্দময় ও উৎসবমুখর। মণ্ডপে মণ্ডপে যাচ্ছেন আর মনের বাসনা পূরণে মায়ের আশীর্বাদ কামনা করছেন তারা।
এর আগে সকালে নির্ধারিত সময়ে উলু ধ্বনি, ঢাকের বাদন, কাশি, ঘণ্টা ও শঙ্খ বাজানো হয়। এরপর যথা নিয়মে পুরোহিতের মন্ত্রপাঠের মধ্য দিয়ে শুরু হয় দেবী দুর্গার পূজা। আর বিভিন্ন ভোগ্য সামগ্রী দিয়ে মণ্ডপে রাখা দেবী দুর্গার চরণে অঞ্জলি দেন ভক্ত সাধারণ। বিজয়া দশমীতে পূজামণ্ডপগুলোতে দেবী দুর্গাকে বিদায় জানানোর প্রস্তুতি সবার। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কানায় কানায় ভরে যায় মণ্ডপগুলো।
বগুড়ায় চেলোপাড়া সার্বজনীন কালী মন্দিরে সিঁদুর খেলতে ও দেবী দুর্গা মায়ের আশীর্বাদ নিতে আসা জয়ন্তী দাস, প্রীতিলতা দাস, হৈমন্তী ঘোষ, সুকলা সাহা বাংলানিউজকে জানান, এখন দেবী দুর্গাকে বিসর্জন দিতে হবে। ধর্মীয় বিধানমতে দেবী দুর্গাকে ধরে রাখার কোনো সুযোগ নেই। তাই সবাই বিজয়া দশমীতে মায়ের বিদায় বেলার আগ মুহূর্তে মায়ের আশীর্বাদ নিতে এসেছেন। তারা পূজা অর্চনা করেছেন। সে সঙ্গে অতীত জীবনের পাপ মোচন ও অশুভ শক্তির কবল থেকে বাঁচতে দেবী দুর্গার কাছে আশীর্বাদ কামনা করছেন।
তারা আরও জানান, বিবাহিত নারীরা প্রত্যেক দুর্গোৎসবের বিজয়া দশমীতে সিঁদুর খেলে থাকেন। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। তাদের পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা নাচে-গানে ও সিঁদুর খেলায় মেতে উঠেছে মন্তব্য তাদের।
জলেশ্বরীতলা সার্বজনীন দুর্গা মন্দিরে সিঁদুর খেলতে ও দেবী দুর্গা মায়ের আশীর্বাদ নিতে আসা অদিতি রায়, মিথি রানী, বীনা সরকার বাংলানিউজকে বলেন, দুর্গতিনাশিনীকে স্মরণ করার সঙ্গেই জড়িয়ে আছে সিঁদুরের মাহাত্ম্য। লাল রঙের প্রতি এই বিশেষ আকর্ষণ আমাদের সংস্কৃতিতে গভীরভাবে নিহিত। লাল রং উর্বরতা, প্রেম এবং আবেগের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়, যা বিশেষ করে নারীকেন্দ্রিক আচার অনুষ্ঠানে প্রতিফলিত হয়। লালপাড় সাদা শাড়ি এবং সাদা শাঁখা, লাল পলা এগুলো শুধু বাহারি নয়, বরং প্রতীকী। দশমীতে মা দুর্গা যখন তার স্বামীর কাছে ফিরছেন, তখন মাকে লাল রঙে সজ্জিত করে বিদায় দেওয়া হচ্ছে, যা একদিকে শ্রদ্ধা আর অন্যদিকে সম্পর্কের গভীরতা প্রকাশ করে।