ধরিত্রী বাঁচাতে বিশ্বনেতাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াল শিশুরা
জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে বিশ্বের বড় অর্থনীতির পাঁচ দেশের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়েছে। সোমবার জাতিসংঘে জার্মানি, ফ্রান্স, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা ও তুরস্কের বিরুদ্ধে ওই মামলা দায়ের করেন সুইডিশ পরিবেশ আন্দোলনকর্মী সাহসী কিশোরী গ্রেটা থানবার্গসহ ১৬ সদস্যের একটি দল।
অভিযোগ, জলবায়ু সংকট ও বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধে পর্যাপ্ত ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়নি ওই দেশগুলো। এর মধ্য দিয়ে দেশগুলোর নেতারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই মামলার মধ্য দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনবিরোধী লড়াইয়ে কার্যত পুরো বিশ্বের বিরুদ্ধে দাঁড়াল শিশুরা।
এর আগে জলবায়ু সংকটে সমন্বিত পদক্ষেপের দাবিতে বিশ্বব্যাপী ছাত্র বিক্ষোভের নেতৃত্ব দেন থানবার্গ।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় পদক্ষেপ নিতে রাজনীতিবিদদের বাধ্য করতে গত বছর স্কুল শিক্ষার্থীদের নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলেন গ্রেটা।
এরপর বড়দেরও তাদের সঙ্গে যোগ দেয়ার আহ্বান জানান তিনি। তার সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে গত শুক্রবার বিশ্বের বিভিন্ন শহরে জড়ো হয় লাখ লাখ শিক্ষার্থী। আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করেন বিভিন্ন বয়সের প্রায় ৪০ লাখ মানুষ।
সিএনএন জানায়, সোমবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের শুরুতে মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের আহ্বানে আয়োজিত জলবায়ু বিষয়ক সম্মেলন ইউএন ক্লাইমেট অ্যাকশন সামিটে অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে নিজ নিজ দেশের কার্বন নিঃসরণ কমাতে নীতি ও পরিকল্পনা ঘোষণা করেন বিশ্ব নেতারা। সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়ায় বিশ্বনেতাদের বিরুদ্ধে সমালোচনার তোপ দাগেন গ্রেটা।
পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, ‘বড়রা যেখানে ব্যর্থ সেখানে সমস্যার সমাধান নিয়ে এগিয়ে আসছেন তরুণরাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘জলবায়ু সংকটে শিশু-কিশোররাই সঠিক অবস্থানে রয়েছে।’
এরপর রাস্তায় এক সংবাদ সম্মেলনে জলবায়ু নিয়ে উন্নত দেশগুলোর আন্তরিকতা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন গ্রেটা ও তার দল। সেই সঙ্গে সর্বোচ্চ কার্বন নিঃসরণকারী ওই পাঁচ দেশের বিরুদ্ধে মামলা দেয়ার কথা ঘোষণা করেন। তাদের পক্ষে মামলার নথি রুজু করে আন্তর্জাতিক আইন পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হাউসফিল্ট।
মামলার অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির আইনজীবীরা বলেছেন, শিশুদের মৌলিক অধিকারের প্রতিশ্রুতি নিয়ে ১৯৮৯ সালে বিশ্বের সর্বাধিক দেশ কর্তৃক শিশু অধিকার সনদ নামে ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। প্রায় ৩০ বছর আগে স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক শিশু অধিকার সনদে উল্লিখিত নীতিমালা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছে ওই পাঁচটি দেশ।
মামলার নথিতে বলা হয়, চলমান জলবায়ু সংকটের ভয়াবহ ও প্রত্যক্ষ পরিণতি দেখেও এর মোকাবেলায় নিজেদের পর্যাপ্ত সম্পদ ব্যবহার করেনি অভিযুক্ত দেশগুলো।
২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তি অনুযায়ী কার্বন নিঃসরণ দুই ডিগ্রির নিচে রাখতে তারা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সেই প্রতিশ্রুতি তারা রক্ষা করেনি। চুক্তি অনুযায়ী যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল তা এই দেশগুলোর কারণেই ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে।
ফলে প্রতিনিয়তই বাড়ছে দাবদাহ, ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার মতো প্রাকৃতিব বিপর্যয়। বরফ গলে বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির উচ্চতা।
মামলার ১৬ বাদী ১২টি ভিন্ন ভিন্ন দেশের নাগরিক এবং তাদের বয়স ৮ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে। এদের সবাই নিজ নিজ দেশের জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবের শিকার।
নিজের শহর দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনের মানুষ কিভাবে পানির অভাব মোকাবেলা করছে সেই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন ১৭ বছর বয়সী আয়াখা মেলিথাফা। মামলা রুজুর পর গ্রেটা বলেন, ‘মামলার মাধ্যমে আমরা একটা বার্তাই দিতে চেয়েছি।
আর সেটা হচ্ছে, জলবায়ু ইস্যুতে যথেষ্ট পানি ঘোলা করা হয়েছে। আর নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা চ্যালেঞ্জ জানাবই। এই সংকটের জন্য যারা দায়ী, তাদের মুখোশ খুলে দেব। আমরা এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে বিশ্ব নেতাদের বাধ্য করবই।’
জলবায়ু পরিবর্তনের খারাপ প্রভাব সম্পর্কে দলের অন্যতম সদস্য আলাস্কার আদিবাসী ইউপিয়াক গোত্রের কার্ল স্মিথ বলেন, ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক উষ্ণতা আমাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। যে পশু ও মাছ শিকারের ওপর আমাদের মানুষগুলো নির্ভরশীল তা আস্তে আস্তে সংকুচিত হয়ে আসছে।
নাইজেরিয়ার লাগোস শহর থেকে আসা ১২ বছর বয়সী ডেবি আদেগবাইল অ্যাজমায় আক্রান্ত। কয়েক বছরে আফ্রিকার দেশটিতে দাবদাহ বৃদ্ধির কারণে তার অ্যাজমাও বৃদ্ধি পেয়েছে। ডেবি জানান, সম্প্রতি তার দেশে বন্যা এবং এর ফলে প্রতিবছরই পানিবাহিত রোগ মহামারী আকার ধারণ করছে।
এ নিয়ে সবসময় ভয়ে থাকে নিজ শহর লাগোসের অধিবাসীরা। প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপদেশ মার্শাল আইল্যান্ডস থেকে নিজের অভিযোগ জানাতে এসেছেন র্যানটন আনজাইন।
দেশে মাত্র ৮০ একর আয়তনের একটি দ্বীপ ইবেয়িতে বাস করে তার পরিবার। তাদের সেই থাকার জায়গা দিন দিন পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। আনজাইন বলেন, ‘কখনও কখনও আমি আমার মনের চোখেই দেখতে পাই, আমার স্বপ্নের ইবেয়ি দ্বীপ পানিতে ডুবে যাচ্ছে।