২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর ‘গুম’ হন কুমিল্লার লাকসাম উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য মো. সাইফুল ইসলাম হিরু এবং লাকসাম পৌরসভা বিএনপির সভাপতি মো. হুমায়ূন কবির পারভেজ। সম্পর্কে তারা চাচা-ভাতিজা। স্বজনদের দাবি, একই সময়ে র্যাব ১১-এর সদস্য পরিচয়ে দুজনকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। কোনও সুরাহা করতে না পেরে ঘটনার ছয় মাস পর মামলা করেন পরিবারের সদস্যরা। কিন্তু আজ পর্যন্ত ‘নিখোঁজ’ দুই ব্যক্তির কোনও খোঁজ নেই, নেই মামলারও কোনও অগ্রগতি।
হিরু ও হুমায়ুনের পরিবারের দাবি, রাজনৈতিক কারণে বিএনপির এই দুই নেতাকে গুম করা হয়েছে। কুমিল্লার লাকসামের স্থানীয় সংসদ সদস্য বিএনপির এই দুই শীর্ষ নেতাকে র্যাব সদস্যদের দিয়ে অপহরণের পর গুম করেছেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর কথিত ‘আয়নাঘর’ থেকে গুমের শিকার কয়েকজন ব্যক্তি ফিরে আসেন। এই খবরে আশায় বুক বেঁধেছেন লাকসামের দুই নেতার স্বজনরা। তারা গিয়েছেন প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদফতরের (ডিজিএফআই) অফিসসহ বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে। কিন্তু কোথাও খোঁজ পাননি হিরু ও হুমায়ুনের খোঁজ। আদৌ এই দুজন বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন, সঠিক তথ্য জানতে চান স্বজনরা।
হুমায়ূন কবির পারভেজের স্ত্রী শাহনাজ আক্তার বলেন, ‘২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর হিরু ও হুমায়ূনকে র্যাব ১১-এর সদস্যরা তুলে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় আমরা বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কাছে ধরনা দিয়েও কোনও সাড়া পাইনি। তবে সে সময় র্যাব ১১-এর অধিনায়ক (সিইও) লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ আমাদের বলেছিলেন, ‘আপনারা স্থানীয় সংসদ সদস্যের (মো. তাজুল ইসলাম, সাবেক মন্ত্রী) সঙ্গে ঝামেলা মিটিয়ে আসেন। তারপর আপনাদের বিষয়টি দেখবো’। তখন আমরা তাজুল ইসলামের সঙ্গেও দেখা করেছিলাম। তার কাছে হিরু-হুমায়ূনকে ফিরিয়ে দেওয়ার আকুতি-মিনতি করেছিলাম। তারপরও তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি। পরে র্যাবের তারেক সাঈদও আর আমাদের সঙ্গে দেখা দেননি।’
শাহনাজ আক্তার বলেন, ‘এখন তো আওয়ামী লীগ সরকার নাই। এখন কেন আমার স্বামী ও চাচাকে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে না? এখন কেন র্যাবের অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে না? তারাই তো হিরু-হুমায়ূনকে নিয়ে গেছে। তাদের জিজ্ঞেস করলেই সব জানা যাবে কোথায় আছে তারা? কেন তাদের গুম করা হয়েছে? কার নির্দেশে তাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে? কোথায় তাদের রাখা হয়েছে?’
গুমের ঘটনার বর্ণনা করে শাহনাজ আক্তার বলেন, ‘২০১৩ সালের শেষ দিকে বিএনপি-জামায়াতের অবরোধ চলছিল। ওই বছরের ২৭ নভেম্বর রাতে লাকসামে বিশেষ অভিযান চালায় র্যাব-পুলিশ। তখন উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক এমপি হিরুর মালিকানাধীন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ‘লাকসাম ফ্লাওয়ার মিলে’ অভিযান চালিয়ে এক্সিম ব্যাংকের লাকসাম শাখার ম্যানেজারসহ ৯ জনকে গ্রেফতার করে। র্যাবের অভিযানের খবরে ওই রাতেই সাইফুল ইসলাম হিরু, পৌর বিএনপির সভাপতি হুমায়ূন কবির পারভেজ ও তাদের আরেক সহযোগী জসিম উদ্দিনকে নিয়ে একটি অ্যাম্বুল্যান্সে করে লাকসাম থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন। অ্যাম্বুল্যান্সটি কুমিল্লা-নোয়াখালী মহাসড়কের আলীশ্বর এলাকায় পৌঁছালে সড়কে ব্যারিকেড দিয়ে র্যাব পরিচয়ে তাদের আটক করে।’
‘তারা হিরু ও হুমায়ূনকে একটি সাদা মাইক্রোবাসে তুলে কুমিল্লার দিকে নিয়ে যায়। আর জসিম উদ্দিনকে লাকসাম থেকে গ্রেফতার করা ৯ জনের সঙ্গে লাকসাম থানায় হস্তান্তর করেন র্যাব ১১-এর কুমিল্লা শাখার তৎকালীন ডিএডি শাহজাহান আলী। পরদিন সকালে জসিম ও এক্সিম ব্যাংকের ম্যানেজারসহ ১০ জনকে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠায় পুলিশ। কিন্তু ওই দিনের পর থেকে হিরু ও হুমায়ূনের কোনও খবর পাওয়া যায় না’, যুক্ত করেন তিনি।
এ ঘটনায় ২০১৪ সালের ১৮ মে হুমায়ূন কবির পারভেজের বাবা রংগু মিয়া বাদী হয়ে অপহরণের পর গুমের অভিযোগ এনে কুমিল্লা আদালতে মামলা করেন। ওই মামলায় র্যাব ১১-এর সাবেক অধিনায়ক (সিইও) ও নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, র্যাব ১১-এর তৎকালীন কুমিল্লা ক্যাম্পের দায়িত্বে থাকা কোম্পানি ২-এর মেজর শাহেদ হাসান রাজীব, উপসহকারী পরিচালক (ডিএডি) মো. শাহজাহান আলী, উপপরিদর্শক (এসআই) কানি সুলতান আহমেদ ও অসিত কুমার রায়কে অভিযুক্ত করা হয়।
সন্তানকে ফিরে পাওয়ার আকুতি নিয়ে নানা জায়গায় ধরনা দিয়ে ২০১৪ সালের ৩১ আগস্ট মারা যান হুমায়ূনের বাবা ও মামলার বাদী রসু মিয়া। পরে তার ছোট ছেলে গোলাম ফারুকের আবেদনের পর আদালত তাকে ওই মামলার বাদী করেন।
বাদীপক্ষের প্রধান আইনজীবী মুহাম্মদ বদিউল আলম সুজন বলেন, ‘এখন পর্যন্ত যারাই তদন্ত করেছেন, তাদের কেউই অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদ করেননি। সবাই বিষয়টি এড়িয়ে গিয়েছেন। কেউই জানতে চায়নি এ ঘটনার মূলে কারা আছে, কেন তাদের গুম করা হয়েছে, তাদের অবস্থান কোথায়।’
শাহনাজ আক্তার বলেন, ‘হিরু-হুমায়ূনকে গুম করেই তারা শান্ত হয় নাই। এরপর সরকার ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা আমাদের জায়গা-জমি নিয়ে গেছে। অনেক কষ্টে পরিবার নিয়ে বেঁচে আছি। আমার তিন সন্তান (এক ছেলে ও দুই মেয়ে)। তখন তিন জনই ছোট ছিল। এত বছর আমরা লাকসামে থাকতে পারিনি, লুকিয়ে লুকিয়ে থাকতে হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, “ওই ঘটনার পর থেকে যারা যেভাবে বলেছেন, সেভাবে কাজ করেছি। ‘মায়ের ডাক’ সংগঠনের বিভিন্ন কর্মসূচিতে দাঁড়িয়েছি, অনেক মানববন্ধন করেছি। কতবার যে থানা পুলিশ, আদালত ও বিভিন্ন সংস্থার কাছে গিয়েছে, কোথাও কোনও সাড়া পাইনি।”
‘র্যাব আমার স্বামী (হুমায়ূন) ও চাচাকে (হিরু) গুম করেছে। এখন সঠিক তদন্ত হলেই সব বেরিয়ে আসবে’ উল্লেখ করে শাহনাজ বলেন, ‘হিরু-হুমায়ূনকে গুম করার মূল কারণ হলো রাজনীতি। আমরা এখনও অপেক্ষায় আছি তারা ফিরে আসবেন। সন্তানরা বাবার অপেক্ষায় পথ চেয়ে থাকে। তারা প্রতিদিন জানতে চায়, বাবা কি আর আসবে না? আমাদের বাবা কি মারা গেছেন? আমরা কি আর বাবাকে দেখতে পাবো না? তাদের এমন প্রশ্নে আমি কোনও উত্তর দিতে পারি না। আমার কাছে কোনও উত্তর নেই!’
হুমায়ূন কবির পারভেজের ছেলে শাহরিয়ার কবির রাতুল বলেন, ‘আশা করছি নতুন সরকারের কাছ থেকে একটি ইতিবাচক খবর পাবো। কার নির্দেশে বাবা ও দাদাকে গুম করা হলো, তাদের কোথায় রাখা হয়েছে, কেমন আছে বাবা- খুব জানতে ইচ্ছে করে।’
সাইফুল ইসলাম হিরুর একমাত্র ছেলে রাফসাল ইসলাম। তার স্ত্রী ফরিদা ইসলাম হাসি। দীর্ঘদিন স্বামীর হারানোর শোক সয়ে অসুস্থ হয়ে তিনি এখন হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায়।
রাফসাল ইসলাম বলেন, ‘র্যাবের তৎকালীন সিইও তারেক সাঈদ এই গুমের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই সব বেরিয়ে আসবে। এই অপহরণ ও গুমের নেপথ্যে রয়েছে রাজনৈতিক কারণ। তারেক সাঈদ এখনও বেঁচে আছেন। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই তো সব বেরিয়ে আসবে। তবেই জানা যাবে সবকিছুর নেপথ্যে কে ছিল।’
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা লাকসাম সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার সৌমেন মজুমদার বলেন, ‘আমাদের আগে এ মামলা পিবিআই, সিআইডি ও থানা পুলিশ তদন্ত করেছে। আমরা চেষ্টা করছি তথ্য-উপাত্ত জোগাড় করার। অনেক পুরোনো ঘটনা হওয়ায় সঠিক সময়ে সাক্ষী পাওয়া যাচ্ছে না। তবু আমরা চেষ্টা করছি প্রকৃত ঘটনা উৎঘাটন করার।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আসলে আপনারা জানেন র্যাবের কোনও অভিযান ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনুমতি ছাড়া হয় না। এ ঘটনায় র্যাবের কয়েকজন জুনিয়র সদস্যদের সঙ্গে কথা হয়েছিল। তবে তেমন কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি। আবার অনেক সময় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সবাইকে ডেকে পাওয়া যায় না। গুমের বিষয়ে যেহেতু কমিশন গঠন হয়েছে, তারা যদি তদন্তের স্বার্থে কাউকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকে, তাহলে সময়মতো পাওয়া যাবে।’
গুম কমিশনের সচিব ও অতিরিক্ত জেলা জজ মো. বুলবুল হোসেন বলেন, ‘বিগত সময়ে অপহরণ ও গুম হওয়া ব্যক্তিদের তথ্য সংগ্রহ করে যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে হচ্ছে। এরপর আরও কিছু কাজ করা হবে। এখনই এ সম্পর্কে বিস্তারিত বলা যাচ্ছে না। একটু সময় লাগবে।’
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন