রাজনৈতিক প্রভাবে যেভাবে একটি বিশ্ববিদ্যালয় দখলে নিলো ‘চৌধুরী পরিবার’
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) অর্থ এবং জমিতে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও গত ৯ বছর ধরে নিয়ন্ত্রণে নেই প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়। মহানগর আওয়ামী লীগের প্রয়াত সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর পরিবারের রাজনৈতিক প্রভাবে বিশ্ববিদ্যালয়টির নিয়ন্ত্রণ হারাতে হয় চসিককে। নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর দীর্ঘ আট বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়টি ঘিরে চলেছিল অর্থের লুটপাট। তবে এবার সোচ্চার হয়েছে চসিক। নিয়ন্ত্রণ ফেরত চেয়ে ইতোমধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে সংস্থাটি।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রাম নগরীতে বেশ কয়েকটি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে আসছিল সিটি করপোরেশন। এরই আলোকে নগরীতে উচ্চশিক্ষার দ্বার উন্মোচনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যাগ নেয় চসিক। সংস্থাটির নিজস্ব প্যাডে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন চেয়ে ২০০১ সালের ৫ ডিসেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়। ২০০২ সালের ২১ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনুমতি পায় চসিক। নগরীর প্রবর্তক মোড়ে এবং ওয়াসার মোড়ে ফিলিং স্টেশনের ওপরে সিটি করপোরেশনের জমিতে তিনটি ভবন নির্মাণ করা হয়। এসব ভবন নির্মাণসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় সিটি করপোরেশনের তহবিল থেকে ৪৬ কোটি ৯৩ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়।
১৯৯৪ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে টানা তিন মেয়াদে মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন এবিএম মহিউদ্দীন চৌধুরী। তার মেয়াদেই ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি। নিয়ম অনুযায়ী মেয়রই হবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান। সে অনুযায়ী ২০১০ সাল পর্যন্ত আট বছর ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন মহিউদ্দিন।
২০১০ সালের নির্বাচনে মহিউদ্দিন চৌধুরীকে হারিয়ে মেয়র হন মোহাম্মদ মনজুর আলম। মেয়রের পদ হারানোর পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান পদও হারাতে হয়। তবে মেয়র মনজুর আলম চসিকের সাধারণ সভায় মহিউদ্দিন চৌধুরীকে সম্মানস্বরূপ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টির সদস্য নির্বাচিত করেন। ওই মেয়াদের একপর্যায়ে মহিউদ্দিন চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজের বলে দাবি করে বসেন।
পরবর্তীতে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানা নিয়ে বিরোধ শুরু হয়। চট্টগ্রামের রাজনীতিতে নাছিরের সঙ্গে মহিউদ্দিন চৌধুরীর বিরোধ ছিল। ২০১৫ সালের ১৪ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এক চিঠি দিয়ে নতুন মেয়র নাছির উদ্দীনকে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে সম্বোধন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ প্যানেলসহ খালি পদগুলো পূরণে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। পাশাপাশি সর্বশেষ ট্রাস্টি বোর্ড নিবন্ধন করা হয়নি জানিয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে আইন অনুযায়ী ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করতে বলা হয়।
তবে ইউজিসি ওই চিঠি কেন উপাচার্য বা রেজিস্ট্রার বরাবর দেয়নি, এই যুক্তি তুলে এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন করেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। আদালত রুলের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমে মহিউদ্দিনের অংশগ্রহণে কোনও ধরনের বাধা না দেওয়ার নির্দেশ দেন। ২০১৬ সালের ১২ জুন দেওয়ানি আদালতে প্রতিকার চাওয়ার নির্দেশনা দিয়ে মহিউদ্দিন চৌধুরীর পিটিশনটি খারিজ করে দেন উচ্চ আদালত। এই রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন অধ্যাদেশ-১৯৮২ ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-১৯৯২-এর কোনোটিতেই সিটি করপোরেশনকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। আদালতের পর্যবেক্ষণের বিরুদ্ধে সিটি করপোরেশন রিভিউ পিটিশন করেছিল। ২০১৭ সালের মে মাসে রিভিউ পিটিশনের রায়ে উচ্চ আদালত উল্লেখ করেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা-সংক্রান্ত পর্যবেক্ষণ কোনও পক্ষের ওপর প্রযোজ্য হবে না।
এই রুলের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবার লিভ টু আপিল পিটিশন করেন মহিউদ্দিন। কিন্ত শুনানিতে তিনি হাজির না হওয়ায় ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি লিভ টু আপিলটি খারিজ করে দেন আদালত। এরপরও তৎকালীন মেয়র নাছির উদ্দীনকে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ২০১৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান মহিউদ্দিন।
২০১৯ সালের নতুন সরকারের শিক্ষা উপমন্ত্রীর দায়িত্ব পান মহিউদ্দিনের ছেলে মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। পরে শিক্ষামন্ত্রী হন। এরপর নিজের প্রভাব খাটিয়ে পছন্দমতো ট্রাস্টি বোর্ডে সদস্য অন্তর্ভুক্ত করেন। অপরদিকে দলের হাইকমান্ডের নির্দেশে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃত্ব ছাড়তে বাধ্য হন নাছির। একই সঙ্গে চসিক হারায় নিজ অর্থে ও জমিতে প্রতিষ্ঠা করা বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন নওফেল। অর্থাৎ বাবার মৃত্যুর পর নওফেল প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়টি দখলে নিয়ে নেন।
গত ৫ আগস্ট সরকারের পতনের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃত্ব নিয়ে নড়েচড়ে বসে চসিক। সংস্থাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃত্ব এবং মালিকানা ফেরত চাইছে। গত ৫ সেপ্টেম্বর মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব বরাবর চিঠি দেন চসিকের প্রধান নির্বাহী শেখ মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম।
চিঠিতে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কর্তৃক ইস্যুকৃত পত্রটি চ্যালেঞ্জ করে মহিউদ্দিন চৌধুরী হাইকোর্ট বিভাগে রিট করেছিলেন। ২০১৬ সালের ১২ জুন সেটি খারিজ হয়ে যায়। এরপর হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে মহিউদ্দিন আপিল বিভাগে সিভিল পিটিশন করলে আপিল বিভাগ ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি সেটিও খারিজ করে দেন। ফলে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ সিটি করপোরেশনের হাতেই আছে।
চিঠিতে আরও বলা হয়, চসিকের নিয়ন্ত্রণে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়টি নিয়মতান্ত্রিক ও আইনগতভাবে নিজেদের কর্তৃত্বে নেওয়ার সব রকম প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর মহিবুল হাসান নিজেই ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়ে অন্যায়ভাবে বিশ্ববিদ্যালয় দখল করে নেন। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফলে বর্তমানে একটি জনকল্যাণমূলক অন্তবর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের প্রেক্ষাপটে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়টি চসিকের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য করপোরেশনের কাছে লিখিত আবেদন করেছেন। চসিকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও নিজেদের ত্যাগ-তিতিক্ষা ও অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় নিজেদের তত্ত্বাবধানে আনার পক্ষে আছেন।
এ প্রসঙ্গে সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘চসিকের উদ্যাগে, অর্থে এবং জমিতে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এটি চসিকের প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান। এর মালিকানা পরিবর্তন করা হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়টি জোরপূর্বক দখলে নিয়েছিল একটি পরিবার। আমরা মালিকানা ফিরে পেতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে চিঠির জবাব পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মহিউদ্দিন চৌধুরী পরিবারের নিয়ন্ত্রিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ১২ সদস্য বিশিষ্ট ট্রাস্টি বোর্ড রয়েছে। বোর্ডের চেয়ারম্যান সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী। এতে সদস্য হিসেবে আছেন তার মা হাসিনা মহিউদ্দিন ও ছোট ভাই বোরহানুল হাসান চৌধুরী। বাকি সদস্যদের মধ্যে এস আলম গ্রুপের তিন সদস্য সাইফুল আলম মাসুদ, আবদুস সামাদ লাবু ও মোহাম্মদ শহীদুল আলম। বোর্ডের বাকি ছয় সদস্য হলেন- উপাচার্য অধ্যাপক অনুপম সেন, আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, রেমন্ড আরেং, প্রকৌশলী শহীদুল আলম ও সাবেক সংসদ সদস্য সাবিহা মুসা। তবে সরকার পতনের পর ট্রাস্টি বোর্ডের কোনও সদস্যকে প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে না। তাদের মোবাইল নম্বরও বন্ধ আছে। এজন্য তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।
প্রায় ১৬ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদে আছেন অধ্যাপক অনুপম সেন। সংশ্লিষ্টরা জানান, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী ৭৫ বছর বয়সের পর উপাচার্যের দায়িত্ব পালনের সুযোগ না থাকলেও ৮৪ বছর বয়সেও উপাচার্য পদে আছেন তিনি। সরকার পতনের পর শিক্ষার্থীদের একটি পক্ষ উপাচার্যের পদ থেকে অনুপম সেনকে সরিয়ে দিতে এবং আরেকটি পক্ষ বহাল রাখতে আন্দোলন করছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ছয়টি অনুষদের মোট ১৪টি বিভাগে ছয় হাজারের বেশি শিক্ষার্থী আছেন। শতাধিক শিক্ষকসহ মোট তিন শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক বাজেট প্রায় ৭১ কোটি টাকা।
সর্বশেষ গত শুক্রবার (১৩ সেপ্টেম্বর) চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সিটি করপোরেশনের অর্থে নির্মিত প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানা চসিকের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছেন শিক্ষার্থীরা।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মুসফিক আল মাসুম, বাইত উল্লাহ বায়াত বলেন, ২০০২ সালের চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের জমিতে ৪২ কোটি ৯৩ লাখ টাকা বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়টি। এটিকে পারিবারিক সম্পদে রূপান্তরিত করেছেন সাবেক সিটি মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। তিনি ছাত্র ও গণহত্যার মাস্টারমাইন্ড সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসানের বাবা। ক্ষমতার জোরে মহিবুল হাসানের পরিবার প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়টিকে দখল করেছেন। এখানে নিয়োগ, আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতিসহ সব অনিয়মের তদন্তপূর্বক আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাই আমরা। সেইসঙ্গে জমি সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি পূর্বক স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ, শিক্ষক- কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে ইউজিসি আইন অনুসরণ করে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার দাবি জানাই।
বাংলা ট্রিবিউন