স্কুল-কলেজ ভবন নির্মাণে ৫ শতাংশ কমিশন নিতেন দীপু মনির ভাই টিপু
আওয়ামী লীগ সরকারের চার মেয়াদের তিনবারের মন্ত্রী ও একবার সংসদ-সদস্য ডা. দীপু মনির গ্রেফতারের পর ক্ষমতার অপব্যবহার ও ঘুস-দুর্নীতির নানা তথ্য বের হতে শুরু করেছে। বিগত সরকারের প্রথম মেয়াদে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, তৃতীয় মেয়াদে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং চতুর্থ মেয়াদে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান তিনি। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকও ছিলেন। এসব পদ-পদবি পেয়ে গত প্রায় ১৬ বছর তিনি বেশ বেপরোয়া ছিলেন। স্কুল-কলেজ ভবন নির্মাণে ৫ শতাংশ কমিশন নিতেন তার ভাই টিপু।
শিক্ষার উন্নয়ন বাজেটের বেশিরভাগ বরাদ্দ পায় শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর (ইইডি)। এ খাতে সব ঠিকাদারকে ৫ শতাংশ কমিশন দিয়ে কাজ নিতে হতো। ইইডির পুরো নিয়ন্ত্রণ ছিল দীপু মনির ভাই টিপুর হাতে। দীপু মনি ও তার ভাই টিপুর হাত থেকে রক্ষা পায়নি চাঁদপুরে দীর্ঘদিনের প্রতিষ্ঠিত আল-আমিন একাডেমি নামক প্রতিষ্ঠানটিও। তার ভাই নিজের মতো করে প্রতিষ্ঠিত এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির সবকিছু তছনছ করে নিজের লোক বসান।
নিজ জেলায় চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য শুধু জমি অধিগ্রহণে ৩৫৯ কোটি টাকা দুর্নীতির পাঁয়তারা করেন দীপু মনি। বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের আগেই সেখানকার সাড়ে ৬২ একর জমি মৌজা দরের চেয়ে ২০ গুণ বেশি দাম দেখিয়ে দলিল করে নেন তার নিকটাত্মীয়রা। তারা ভূমি অধিগ্রহণে প্রশাসনিক অনুমোদনের আগেই চাঁদপুর সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নে জায়গা ঠিক করে নিজেদের নামে দলিল করিয়ে নেন। পরবর্তী সময়ে সেসব জমিই প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নির্বাচন করে এবং জেলা প্রশাসনকে অধিগ্রহণের জন্য বলে। সেখান থেকে ৩৫৯ কোটি অতিরিক্ত টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এ অধিগ্রহণের বিরোধিতা করেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিস। তিনি চাঁদপুরে দীপু মনির ভাইসহ আওয়ামী লীগের একাধিক নেতাকর্মীর জমি দখলের বিরুদ্ধে অবস্থানের জন্য আলোচিত ছিলেন। টিপুসহ বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী ভুয়া দলিলের মাধ্যমে ৪৮ একরের বেশি জমির দখল নেওয়ার প্রতিবাদ জানানোর ৪৮ ঘণ্টা পর তাকে নেত্রকোনায় বদলি করা হয়। পরে সরকার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের সেই জায়গায় ওই বিশ্ববিদ্যালয় করার বিষয়টি বাতিল করে।
চাঁদপুরের পদ্মা ও মেঘনার ডুবোচর থেকে ফ্রি-স্টাইলে বালু উত্তোলনেও চোখ ছিল দীপু মনির। তার ঘনিষ্ঠ লোক হিসাবে পরিচিত লক্ষ্মীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও চলচ্চিত্র নির্মাতা সেলিম খানকে সেই বালু তুলতে উৎসাহী করেন তিনি। তার ভাই টিপু সেলিম খান থেকে মোটা অঙ্কের সুবিধা নিতেন। চাঁদপুরে মেঘনা নদী থেকে সেলিম খানের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে বালু তোলার প্রতিবাদ যারাই করেছেন তারাই দীপু মনির রোষানলে পড়েছেন। চাঁদপুরে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে দীপু মনির বিরোধ ও দূরত্ব শুধু বালু উত্তোলন নিয়ে প্রতিবাদ করা নিয়ে। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নাছির উদ্দীন আহমেদকে কোণঠাসা করতে তার বিরুদ্ধে বালুখেকো সেলিম খানের লোকজন দিয়ে শহরে মিছিল করানো হয়। এছাড়াও দীপু মনির কাছের লোকদের দাপটে দলীয় ত্যাগী নেতাকর্মীরাও ছিলেন অবহেলিত।
নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী বালু তোলার সমালোচনা করে পদ হারান। গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর বিশ্ব নদী দিবসের আলোচনায় তিনি বলেন, মেঘনায় অবৈধভাবে যারা বালু উত্তোলন করছেন, তাদের সঙ্গে চাঁদপুরের একজন নারী মন্ত্রীর সম্পর্ক আছে। এর দুদিন পরই মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যানের পদ থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, দীপু মনির নির্বাচনি এলাকা হাইমচর-নীলকমল ইউনিয়নের বাহেরচরে বিপুল পরিমাণ খাসজমি নিজের কবজায় নিয়ে দীপু মনির ভাই টিপু তৈরি করেন মাছের ঘের, গবাদি পশুর খামার ও সবজি বাগান। শুধু সরকারি জমির ওপরই নিয়ন্ত্রণ নেননি, ওই এলাকার নাম বদল করে নিজের নামে রেখেছেন ‘টিপু নগর’। যে জমি সরকারি খাস তা প্রভাব খাটিয়ে নামজারি করে নেন দীপু মনির ভাই টিপু।
নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী, নোট-গাইড বিক্রি নিষিদ্ধ হলেও সারা দেশে দেদার বিক্রি হচ্ছে এসব বই। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৯৭ শতাংশ শিক্ষার্থী নোট বা গাইডের ওপর নির্ভরশীল। মুখে নোট-গাইডের বিরোধিতা করলেও দীপু মনি নোট-গাইড বিক্রেতাদের কাছ থেকে নিয়মিত কমিশন নিতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ কাজে তাকে সহায়তা করতেন এক প্রকাশনীর মালিক। সেই প্রকাশনীর মালিকের বাড়িও চাঁদপুরে। ঢাকার এক নোট-গাইড প্রকাশক জানান, ৩ মাস পরপর অন্তত ২৫ কোটি টাকা কমিশন নিতেন দীপু মনি।