বিয়েবহির্ভূত সন্তানের পিতৃপরিচয় কী হবে
আমাদের সমাজব্যবস্থায় বিয়েবহির্ভূত সন্তান জন্ম নেয়া ‘পাপের ফল’ বলে অভিহিত করা হয়। বিয়ে ছাড়া যেসব শিশু জন্মে তাদের অবৈধ সন্তান বলা হয়। বাবা-সন্তানের আইনগত সম্পর্ক পিতৃত্ব এবং মা-সন্তানের আইনগত সম্পর্ক মাতৃত্ব, তা সন্তান বৈধ হোক বা না হোক। কোনো সন্তানকে বৈধ হতে হলে সে অবশ্যই কোনো পুরুষ এবং সেই পুরুষের স্ত্রীর সন্তান হতে হবে, অন্য কোনো কিছুর ফলে সন্তান হলে তা অবৈধ সম্পর্কের ফল বলে গণ্য হবে। ওই সন্তানকে বৈধ করা যাবে না। কোনো নারীর গর্ভে কোনো সন্তান জন্ম নিয়েছে কেবল এর প্রমাণ দিয়েই মাতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। সন্তানটি অবৈধ হলেও মাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাতে বাধা থাকে না।
মুসলিম আইনে সন্তানের বৈধতা সম্পর্কে অনুমান এবং ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনের ১১২ ধারার মধ্যে একটি প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব রয়েছে। সাক্ষ্য আইনের ১১২ ধারা মুসলিম আইনের ওই বিধানকে অতিক্রম করেছে, যা এলাহাবাদ হাইকোর্টের একটি মামলায় প্রশ্ন উঠেছে। এলাহাবাদ হাইকোর্ট স্থির করেন, ধারাটি মুসলিম আইনের বিধানকে অতিক্রম করেছে এবং এটি কেবল মুসলমানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। লাহোর হাইকোর্টেও ওই একই অভিমত গ্রহণ করা হয়েছে। অযোধ্যার চিফ কোর্ট ঘোষণা করেছেন, যদি ১১২ ধারাটি মুসলমানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়, তবুও তা কোনো অনিয়মিত বিয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে না।
সাক্ষ্য আইনের ১১২ ধারায় বলা আছে- ‘কারো মায়ের সাথে কোনো ব্যক্তির আইনসিদ্ধ বিয়ে চালু থাকাকালে অথবা বিয়ে বিচ্ছেদের পর ২৮০ দিনের মধ্যে তার মা অবিবাহিত থাকাকালে যদি তার জন্ম হয় এবং যদি প্রতীয়মান না হয় যে, ওই ব্যক্তি যখন মাতৃগর্ভে এসে থাকতে পারে অনুরূপ কোনো সময়ে বিবাহিত পক্ষদ্বয়ের পরস্পরের মধ্যে মিলনের পথ উন্মুক্ত ছিল না, তবে জন্মের বিষয় দ্বারা অবশ্যই চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত হবে যে সে তার মায়ের সাথে বিবাহিত ওই ব্যক্তির সন্তান।’ এ ধারা অনুযায়ী, একজন পুরুষ ও একজন নারীর মধ্যে একটি বৈধ বিয়ে অনুষ্ঠিত হওয়ার পর যখনই কোনো সন্তান জন্মগ্রহণ করবে সে বৈধ সন্তান বলে পরিগণিত হবে। কারণ এই ধারার ইংরেজি ভার্সনে ‘ডিউরিং দ্য কন্টিনিউয়াস অব এ ভ্যালিড ম্যারেজ’ এই শব্দগুলো ব্যবহার করায় বিয়ের পরের দিন সন্তান জন্ম নিলে সেও বৈধ সন্তান বলে পরিগণিত হচ্ছে, যা খুবই অবাস্তব। আমাদের দেশের মুসলিম হানাফি আইনে একটি বৈধ বিয়ের ছয় মাসের আগে কোনো সন্তান জন্ম নিলে সে অবৈধ সন্তান বলে গণ্য হয়। এখানে স্পষ্টত মুসলিম আইনের সাথে সাক্ষ্য আইনের অসামঞ্জস্যতা পরিলক্ষিত হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- সাক্ষ্য আইন মুসলিম আইনের ওপর প্রাধান্য পাবে; নাকি মুসলিম আইন সাক্ষ্য আইনের ওপর প্রাধান্য পাবে। ডি. এফ. মোল্লার মতে, সাক্ষ্য আইন মুসলিম আইনের ওপর প্রাধান্য পাবে।
নাসরিন জাহান (পারুল) ও অন্যান্য বনাম খবির আহমেদ ও অন্যান্য, ৬১ ডিএলআর (এইচসিডি) (২০০৯) ৬৯৭ মামলায় সন্তানের বৈধতার জন্য দু’টি শর্ত দেয়া হয়েছে। প্রথমত, কোনো ব্যক্তির মায়ের সাথে অন্য কোনো ব্যক্তির আইনসঙ্গত বিয়ে কায়েম থাকাকালে; অথবা বিয়ে বিচ্ছেদের পর ২৮০ দিনের ভেতর তার মা অবিবাহিত থাকাকালে যদি সন্তান জন্ম নেয় তাহলে সেই সন্তান বৈধ বলে চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত। তবে তার জন্য আরো একটি শর্ত থাকা লাগবে, ওই ব্যক্তি যখন মাতৃগর্ভে তখন বিবাহিত পক্ষদ্বয়ের মধ্যে মিলনের পথ উন্মুক্ত ছিল। প্রথম দু’টি শর্তের যেকোনো একটি এবং শেষ শর্তটি পাওয়া গেলে সেই সন্তান বৈধ বলে চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত হবে। এটিই সাক্ষ্য আইন অনুযায়ী সন্তানের বৈধতার চূড়ান্ত প্রমাণ।
মুসলিম হানাফি আইনে অবৈধ সন্তান তার মায়ের এবং মাতৃকুলের অংশীদার হয়। একইভাবে মা বা মাতৃকুলে অবৈধ সন্তান অংশীদার হয়। কিন্তু শিয়া আইনে অবৈধ সন্তান মায়ের অংশীদার নয় এবং মাতৃকুলেও অবৈধ সন্তান উত্তরাধিকার হয় না।
এ দিকে পিতৃত্ব নির্ধারণে ডিএনএ পরীক্ষার আদেশের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে বলে মত দিয়েছেন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। বিচারপতি আফতাব আলম ও বিচারপতি আরএম লোধার সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ রায়ে বলেন, যখন কোনো সন্তানের পিতৃত্ব নির্ধারণের বিষয় উত্থাপিত হবে এবং যেখানে পারিবারিক বিরোধ দেখা গেছে, তখন যতটা সম্ভব বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ও ব্যবহারের প্রয়োগ কমাতে হবে। কারণ, এ পরীক্ষা কারো ব্যক্তিগোপনীয়তাও খর্ব করতে পারে। এমন হস্তক্ষেপ পক্ষদ্বয়ের শুধু অধিকার নষ্ট করে না, এটি সন্তানের ওপর গুরুতর ক্ষতিকর প্রভাব বয়ে আনতে পারে। আদালতের রায় হচ্ছে, এমন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা কোনো কোনো সময় একটি নির্দোষ সন্তানকে অবৈধ বানিয়ে দিতে পারে। এমনকি সন্তানটির বাবা-মা গর্ভধারণের সময় একত্রে থাকলেও সন্তান জন্মের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিতে পারে এ ধরনের পরীক্ষার কারণে।
সুপ্রিম কোর্টের রায়ে আরো বলা হয়, বাচ্চার পিতৃত্ব নির্ধারণের ক্ষেত্রে ডিএনএ পরীক্ষা শুধু একটা গৎবাঁধা বিষয় হলে হবে না। আদালতকে সাক্ষ্য আইনের ১২ ধারায় উল্লিখিত অনুমানের ওপর নির্ভর করতে হবে এবং ভিন্ন উদ্দেশ্য গ্রহণ করতে হবে। যেখানে এ ধরনের পরীক্ষা ছাড়া সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছা সম্ভব নয়, সে ক্ষেত্রেই কেবল ‘অত্যাবশ্যক’ হিসেবে অনুমোদন দেয়া যেতে পারে।
ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুসারে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ও নারী বিয়ে না করে যদি একত্রে বসবাস করে, তা আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ নয়।
দেশটির সুশীলসমাজের ধারণা, ভারতের সুপ্রিম কোর্টের ওই রায় নতুন প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের লিভটুগেদারে উৎসাহিত করবে, বিয়েবহির্ভূত সম্পর্কের প্রবণতা বহুলাংশে বাড়বে এবং বিয়ে নামের সামাজিক প্রতিষ্ঠান দুর্বল হয়ে পড়বে। যদিও খ্যাতনামা ইংরেজি দৈনিক এশিয়ান এজ সুপ্রিম কোর্টের ওই রায়কে ‘মাইলফলক’ হিসেবে অভিহিত করেছে। পত্রিকাটির বক্তব্য, ‘এ রায়ের প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী।’ সামাজিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের দেশ রক্ষণশীল। বাংলাদেশে এমন বিয়েবহির্ভূত নারী-পুরুষের জীবনযাপন এখন পর্যন্ত সামাজিক অনাচার ও ধর্মীয় পাপাচার হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছে। দেশে এমন জীবনযাপন আইনগত স্বীকৃতি পেলে সামাজিক মূল্যবোধ বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে। যদিও আমাদের দেশে এটি আইনের দৃষ্টিতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয়, তবুও আর্থ-সামাজিক-ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে এ ধরনের জীবনযাপন অনাকাঙ্ক্ষিত।
লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও
আইনগ্রন্থ প্রণেতা