সালমান এফ রহমানের নানা আর্থিক অনিয়মের তথ্য প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অতি ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত সালমান এফ রহমানের নানা আর্থিক অনিয়মের তথ্য প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে। এখন পর্যন্ত যে তথ্য জানা গেছে, তাতে দেখা যায় পুঁজিবাজার ও ব্যাংক খাত থেকে অন্তত ৫০ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন সালমান এফ রহমান। এর মধ্যে কয়েকটি ব্যাংক থেকে ঋণের নামে নিয়েছেন ৪০ হাজার কোটি টাকার মতো। আর কারসাজি ও বন্ড ছাড়ার মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে তুলে নিয়েছেন ৭ হাজার ১২৫ কোটি টাকা। তবে সালমান এফ রহমান পুঁজিবাজার ও ব্যাংক খাত থেকে কত টাকা আত্মসাৎ করেছেন তার চূড়ান্ত হিসাব এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
হাসিনা সরকারের পতনের পর ইতিমধ্যে পুলিশের হাতে আটক হয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর এই উপদেষ্টা। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে দেশের ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণের নামে নেওয়া অর্থ যাতে ফিরিয়ে দিতে না হয় সেজন্য তাকে বারবার পুনঃতফসিলের সুযোগ দেওয়া হয়েছে, বাড়ানো হয়েছে ঋণসীমাও। শুধু ব্যাংকঋণ নয়, পুঁজিবাজার কেলেঙ্কারিতেও সালমান এফ রহমান শীর্ষে রয়েছেন। এরমধ্যে শেয়ার ও বন্ড কেলেঙ্কারিতে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত সাবেক এই সংসদ সদস্য।
১৯৯৬ ও ২০১০ সালের পুঁজিবাজার কেলেঙ্কারির পরও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বলীয়ান সালমান এফ রহমান বহাল তবিয়তে ছিলেন। সর্বশেষ ২০১০ সালের ধসের পর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের তদন্ত প্রতিবেদনে তার কাছ থেকে পুঁজিবাজারকে সতর্ক রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) সর্বশেষ চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম পুঁজিবাজার লুটে তাকে অবারিত সুযোগ করে দিয়েছিলেন।
২০২০ সালে শিবলী রুবাইয়াত এসইসি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই সালমান এফ রহমানের বিপুল প্রভাব তৈরি হয় পুঁজিবাজারে। নিজ কোম্পানির শেয়ার কারসাজির পাশাপাশি কৃত্রিমভাবে অন্য কোম্পানির শেয়ারের দর বাড়িয়ে বেআইনি মুনাফা তুলে নিয়েছেন তিনি। সর্বশেষ ২০২২ সালে বেক্সিমকো লিমিটেডের শেয়ার কারসাজি করে অন্তত ৫০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন সালমান এফ রহমান। পথে বসিয়েছেন লাখো বিনিয়োগকারীকে। এরই মধ্যে সুকুক ও আমার বন্ড ইস্যু করে আরও চার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন আর্থিক খাত কেলেঙ্কারির অভিযোগ থাকা সাবেক এই সংসদ সদস্য (এমপি)। এর মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের আর্থিক ভিত্তি দুর্বল করে দেওয়া হয়েছে। পুঁজিবাজার থেকে মাত্র দুই বছরে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসির এক তদন্ত প্রতিবেদনে বেক্সিমকো লিমিটেডের শেয়ার কারসাজিতে সবচেয়ে বেশি মুনাফার অধিকারী ৮ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে, যাদের নেপথ্যে সালমান এফ রহমান রয়েছেন বলে মনে করছে তদন্ত দল। শেয়ার দরে কারসাজি ও বন্ডের মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে আরও অর্থ সংগ্রহে কোম্পানির মুনাফাও বাড়িয়ে দেখিয়েছেন তিনি। তবে কারসাজি ও বন্ডের অর্থ সংগ্রহ শেষ হলে মুনাফা সেই আগের অবস্থায় অর্থাৎ তলানিতে নেমে যায় কোম্পানিটির।
পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৯-২০ হিসাববছরে বেক্সিমকো লিমিটেডের শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) ছিল ৫১ পয়সা, পরের বছর করোনার মধ্যে ২০২০-২১ হিসাববছরে ইপিএস দেখানো হয় ৭ টাকা ৫৩ পয়সা। ২০২১-২২ হিসাববছরে কোম্পানিটির ইপিএস দাঁড়ায় ১৪ টাকা ৩২ পয়সায়। শেয়ার কারসাজি ও সুকুক আল ইস্তিসনা নামের গ্রিন সুকুক ইস্যুর মাধ্যমে ৩ হাজার কোটি টাকা নেওয়ার পর বেক্সিমকোর আয় ২০২২-২৩ হিসাববছরেই অর্ধেকে নেমে যায়। আর ‘আমার বন্ডের’ মাধ্যমে আরও এক হাজার কোটি টাকা নেওয়ার পর কোম্পানির ইপিএস নেমে আসে ১ টাকায়।
কারসাজির মাধ্যমে অর্থলুটের অভিযোগ উঠলেও এসইসির তৎকালীন চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াতের কারণে সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। উল্টো নব্বইয়ের দশকের ডিবেঞ্চার খেলাপি বেক্সিমকোর কোম্পানিগুলোকে চার হাজার কোটি টাকার বন্ড ইস্যুর সুযোগ করে দেন শিবলী রুবাইয়াত। বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহের ক্ষেত্রে বিভিন্ন শর্ত থেকে অব্যাহতিও দেয় এসইসি। এমনকি সালমানের বন্ডগুলো কেউ কিনতে না চাইলেও বিভিন্ন ব্যাংকসহ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হুমকি-ধমকি দিয়ে তা গছিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। এখন সেসব বন্ড নিয়ে দুশ্চিন্তায় বিনিয়োগকারীরা। প্রায় সবগুলো ব্যাংক বেক্সিমকোর বন্ড কিনতে বাধ্য হয়েছিল।
শেয়ার নিয়ে কারসাজির মাধ্যমে অর্থ লুটে নেওয়ার পর দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে বিশেষ ব্যবস্থায় বেক্সিমকোর শেয়ারে ফ্লোর প্রাইস আরোপ করে রেখেছে এসইসি। ফলে হাজার হাজার বিনিয়োগকারীর বিপুল পরিমাণের অর্থ আটকে গেছে কোম্পানিটির শেয়ারে। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই গত ৪ এপ্রিল বেক্সিমকোকে ২ হাজার ৬২৫ কোটি টাকার আনসিকিউরড জিরো কুপন বন্ড ছাড়ার অনুমোদন দেয় এসইসি। এ বন্ডটির কেনার প্রক্রিয়া চলছিল। ইতিমধ্যে কত টাকা তুলে নিয়েছেন তা জানা যায়নি।
সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে শুধু পুঁজিবাজার নয়, ব্যাংক লুটের ইতিহাসও অনেক পুরনো। তবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের সহায়তায় সরকারি-বেসরকারি প্রায় সব ব্যাংক থেকেই বিপুল পরিমাণের ঋণ নিয়েছেন তিনি। এই ঋণ যাতে ফেরত দিতে না হয় সেজন্য সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার ও ফজলে কবিরের প্রত্যক্ষ সহায়তায় দফায় দফায় পুনঃতফসিলের সুবিধা দেওয়া হয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকার সুদ মওকুফ করা হয়েছে, ঋণের আসল পরিশোধে মেয়াদ আট বছর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। আবার ঋণ শোধ না দিলেও আরও ঋণ নিতে সীমা বাড়ানো হয়েছে।
সালমানকে দেওয়া সব ব্যাংকঋণের পরিমাণ এখনো চূড়ান্ত হিসাব না হলেও এর পরিমাণ ৪০ হাজার কোটি টাকার কম হবে না বলে মনে করছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তারা। রাষ্ট্রীয় জনতা ব্যাংক থেকেই সালমান এফ রহমান তার বিভিন্ন কোম্পানির নামে অন্তত ২৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন, যা ৭২ শতাংশই এখন খেলাপি। এরমধ্যে গত চার বছরেই দেওয়া হয়েছে সবচেয়ে বেশি ঋণ, ১৯ হাজার কোটি টাকা। এসব ঋণ নিতে নতুন নতুন কোম্পানির সৃষ্টি করা হয়েছে।
জনতা ব্যাংকের নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত বেক্সিমকো ৯টি নতুন কোম্পানি চালু করেছে। এর মধ্যে ২০২২ সালে মাত্র এক মাসে আটটি নতুন কোম্পানি তৈরি করে ওই সব কোম্পানির নামে ঋণ নিয়েছে।
বিধি অনুযায়ী, একক ঋণগ্রহীতাকে ব্যাংকগুলো তাদের পরিশোধিত মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি ঋণ দিতে পারে না। জনতার বিতরণ করা ৯৮ হাজার কোটি টাকার ঋণের ২৫ দশমিক ৫১ শতাংশ বেক্সিমকোর মালিকানাধীন ৩০টি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে। এই ৩০ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২৬টি একক ঋণগ্রহীতার সীমা লঙ্ঘন করেছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের সাবেক ও বর্তমান একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সালমান এফ রহমান ব্যাংকিং বিধিবিধানকে পাশ কাটিয়ে জনতার বোর্ড ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সহায়তায় বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়েছেন। এছাড়া গত তিন বছরে জনতা ব্যাংকের ঋণ বেড়েছে দ্রুতগতিতে। ২০১৫ সালে জনতার কাছে বেক্সিমকো ও এর আওতাধীন প্রতিষ্ঠানের ঋণের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৪৫ কোটি টাকা এবং ২০২০ সালে যা বেড়ে দাঁড়ায় ৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকায়। সর্বশেষ চলতি বছরের জুন শেষে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের প্রায় ৪৯ শতাংশ মন্দ ঋণে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ খেলাপি ঋণ বেক্সিমকো গ্রুপের।
রাষ্ট্রায়ত্ত আরেক ব্যাংক সোনালী বেক্সিমকো গ্রুপকে ১ হাজার ৮৩৮ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। এর বাইরে বেক্সিমকো কমিউনিকেশন কোম্পানির বন্ড কিনেছে ৩০০ কোটি টাকার। রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক থেকে বেক্সিমকো গ্রুপ ১ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে, যার বড় অংশই ঝুঁকিতে। এর বাইরে অগ্রণী ব্যাংক বেক্সিমকো গ্রুপের দুই কোম্পানির ৪৮০ কোটি টাকার বন্ড কিনেছে। রূপালী ব্যাংকে বেক্সিমকো গ্রুপের ৯৯৫ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে। এর বাইরে ব্যাংকটি বেক্সিমকো কমিউনিকেশনস বন্ডে ২৫০ কোটি টাকা ও বেক্সিমকো সুকুকে ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে।
সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন আইএফআইসি ব্যাংক থেকে বেক্সিমকো সুকুকে ৫৭৭ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। এবি ব্যাংকে থাকা বেক্সিমকোর দুটি বড় ঋণ পুনর্গঠন করা হয়, যার পরিমাণ ১৭৫ কোটি টাকারও বেশি। শুধু বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকেই নয়, সালমান এফ রহমান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল থেকেও বিপুল পরিমাণের ঋণ নিয়ে খেলাপি হয়ে গেছেন, যার পরিমাণ বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, সালমান এফ রহমান সবসময় ঋণ পুনঃতফসিল করতেন এবং বেক্সিমকোকে খেলাপিদের তালিকাভুক্ত না করতে তার রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করতেন।
জানা গেছে, টেক্সটাইল, ফার্মাসিউটিক্যালস, পিপিই, সিরামিক, রিয়েল এস্টেট, কনস্ট্রাকশন, ট্রেডিং, মেরিন ফুড, আইসিটি, মিডিয়া, ডিটিএইচ, ফিনান্সিয়াল সার্ভিসেস ও এনার্জি খাতে আগ্রহী এই ব্যবসায়ী গ্রুপটি তাদের ঋণের একটি বড় অংশ ২০২২ সালের জুনে এবং বাকিটা গত বছরের জুনে পুনঃতফসিল করেছে। ২০২৩ সালেও গ্রুপটির বিপুল পরিমাণের ঋণ নতুন করে পুনঃতফসিল করা হয়।