বেশ আগ থেকেই দেশের অর্থনীতিতে নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের নিম্নমুখিতা, জ্বালানি তেল অন্যতম। সবচেয়ে বড় বিষয় জীবনমানের উন্নয়ন করতে না পারা। বর্তমান পরিস্থিতির কারণে এসব চ্যালেঞ্জ আরও জটিল হলো। এমনিতেই দেশে এখন ১০ শতাংশের মতো মূল্যস্ফীতি রয়েছে। এর মধ্যে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকার আগামী দিনে কীভাবে সামাল দেবে সেটা দেখার বিষয়।
অর্থনীতিতে একটি বিষয় আছে। একবার খারাপ হলে তা সংক্রমণ ব্যাধির মতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। তবে খারাপ অবস্থা থেকে উত্তোরণে অনেক সময় লাগে। হঠাৎ করে অর্থনীতিতে চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে তেমন না। খারাপ অবস্থার পেছনে প্রথমত কিছু ভুলনীতি দায়ী। সেই ভুলনীতির ধারাবাহিকতার কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে।
সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির কারণে সেভাবে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান হচ্ছে না। আবার প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। সরকার এতদিন খারাপ তথ্য কার্পেটের নিচে আড়াল করে রেখেছিল। এখন তা সামনে আসছে।
কোটা সংস্কারকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন হলেও তা যে কেবল এজন্যই হয়েছে তা নয়। এই আন্দোলন বৈষম্যের বিরুদ্ধে। এটা অনিয়ম, দুর্নীতি, জিনিসের দামের বিরুদ্ধে মানুষের এক ধরনের প্রতিবাদ। এখন সরকার অতিরিক্ত বল প্রয়োগের মাধ্যমে হয়তো আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। অনেকে বলছে সব ঠিক হয়ে আসছে। এই সমস্যার সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের দিকে সরকারকে নজর দিতে হবে। পড়ালেখা শেষে একদিকে চাকরি পাচ্ছে না। বলা হচ্ছে শিক্ষিতদের মধ্যে ৩০ শতাংশ বেকার। তবে আমার মনে হয় এটা আরও অনেক বেশি। আবার যারা চাকরি পাচ্ছে তাদেরও ঠিকমতো পদোন্নতি, পদায়ন হচ্ছে না। আমার চেনা অনেকেই আছেন, পদোন্নতি ছাড়াই অবসরে গেছেন। তাদের অন্য দলের প্রতি ঝোঁক ছিল, তেমন না। তবে তারা হয়তো ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে অনেক বেশি যোগাযোগ রক্ষা করে চলেননি। ফলে সময় মতো আর পদোন্নতি হয়নি।
আমাদের বৈদেশিক খাতের অবস্থা এমনিতেই খারাপ। রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমছে। এ রকম অবস্থার পর পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। প্রবাসীরা এখন টাকা পাঠাবেন কিনা, টাকা পাঠালে তার স্বজন তুলতে পারবেন কিনা– এসব নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছেন। ফলে তারা এখন অর্থ পাঠাচ্ছেন কম। পাঠালেও ব্যাংকিং চ্যানেলের চেয়ে হুন্ডিতে পাঠাচ্ছেন বেশি। আবার অস্থিরতা থাকলে বিদেশি বিনিয়োগ কমে যায়। এমনিতেই রপ্তানি আয় কমছে। রেমিট্যান্স ও বিদেশি বিনিয়োগ যদি কমে যায় তাহলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, ডলার পরিস্থিতির উন্নয়ন হবে কীভাবে। কেবল আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার পেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে না।
সব মিলিয়ে এখন একটা ভীতিকর অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এ রকম চলতে থাকলে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকও প্রকল্প ঋণ ছাড় করা বন্ধ করে দেবে। কেননা, অস্থিরতা থাকলে প্রকল্পই তো বাস্তবায়ন হবে না। ফলে অর্থছাড় করবে কীভাবে। আবার অচল অবস্থা চলতে থাকলে বিদেশি ক্রেতারাও ভিন্ন কিছু ভাববেন। আমাদের প্রতিযোগী ভারত, চীন ও ভিয়েতনাম তৈরি পোশাক রপ্তানি বাড়ানোর চেষ্টা করছে। ফলে অস্থিরতা চলতে থাকলে চ্যালেঞ্জ বাড়বে। তারা সুযোগ নেবে।
অবস্থার উন্নয়নে সবাইকে আস্থায় নিতে হবে। আর এ কাজটি সরকারের দিক থেকেই করতে হবে। এজন্য সবার সঙ্গে আলোচনা করে কোথায় কোন সমস্যা আছে, কেবল শক্তি দিয়ে সমাধানের চেষ্টা না করে, আস্থা দিয়ে করতে হবে। মনে রাখতে হবে, শান্ত হয়ে আসা মানে কিন্তু অনিশ্চয়তা কেটে যাওয়া না। অনিশ্চয়তা থাকলে সরকার দেশি ও বিদেশি উভয় ক্ষেত্রেই নানা সমস্যায় পড়বে। অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য যা ভালো কিছু বয়ে আনবে না।
বাংলাদেশে প্রযুক্তি খাতের অনেক অগ্রগতি, স্মার্ট বাংলাদেশের কথা প্রচার করা হয়। অথচ বৈশ্বিক সূচকে আমাদের অবস্থান অনেক নিচে। আইটি পরিষেবায় আমাদের স্কোর ১০০-এর মধ্যে ৬২। অথচ বৈশ্বিক গড় স্কোর ৭৪ দশমিক ৮০ শতাংশ। আর আমাদের মতো নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের গড় স্কোর ৬৪ দশমিক ৮০ শতাংশ। আবার বৈশ্বিক উদ্ভাবন সূচকে ১৩২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৫। দুটি ক্ষেত্রেই আমরা পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় পিছিয়ে আছে। এর মধ্যে সম্প্রতি ইন্টারনেট বন্ধ রাখার মাধ্যমে আমরা কী বার্তা দিলাম? ফলে শুধু বক্তৃতা না দিয়ে প্রকৃত অবস্থার উন্নয়ন করতে হবে।
লেখক: সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক