আকবর আলী যেন ২৩ বছর আগের আকরাম খান

0

সেদিনও বৃষ্টি নেমেছিল। সে ম্যাচেও রান তাড়া করে কঠিন বিপদে ছিল বাংলাদেশ। হ্যাঁ, ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফির কথা বলছি। সেমিফাইনাল নিশ্চিতের ম্যাচে হল্যান্ডের সাথে বৃষ্টিভেজা ম্যাচে ২০ রানের কমে ৪ উইকেট হারিয়ে অথৈ জলে হাবডুবু খাচ্ছিলো বাংলাদেশ।

সেই সংকটে, বিপদে আর প্রয়োজনে শক্ত হাতে হাল ধরেছিলেন তখনকার অধিনায়ক আকরাম খান। ডাচ ফাস্টবোলার লিফাব্রে আর পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত আসিম খান তখন বল হাতে আগুন ঝরাচ্ছিলেন। তাদের বোলিং তোপে উড়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের টপ অর্ডার।

কিন্তু প্রথমে মিনহাজুল আবেদিন নান্নুকে সাথে নিয়ে পরে একাই লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে দারুণ এক ম্যাচ জেতানো ‘ফিফটি’ উপহার দেন আইসিসি ট্রফিতে বাংলাদেশের অধিনায়ক আকরাম খান।

তার হাত ধরেই আসলে কোয়ার্টার ফাইনালেরর বেড়া টপকে শেষ চারে পৌঁছে গিয়েছিল বাংলাদেশ। প্রকারন্তরে ঐ জয়েই প্রথমবার বিশ্বকাপের টিকিট প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল টাইগারদের।

২৩ বছর পর দক্ষিণ আফ্রিকার পচেফস্ট্রমে দেখা মিললো আরেক নবীন আকরাম খানের। পূর্বসূরী আকরাম খানের মত এবার দলের বিপদে ত্রাণকর্তার ভূমিকায় অধিনায়ক আকবর আলী।

বিশ্ব যুব ক্রিকেটের ফাইনালে রাজ্যজয়ী বীরের মত দল জিতিয়েই হাসিমুখে মাঠ ছেড়েছেন আকবর আলী। অধিনায়কের চওড়া ব্যাটেই যুব ক্রিকেটে প্রথম বিশ্বসেরার মুকুট বাংলাদেশের।

১৭৮ রানের ছোট্ট টার্গেট ছুঁতে গিয়ে ৫০ রানে (৮.৫ ওভারে) প্রথম উইকেট। এর চেয়ে চমৎকার শুরু আর কি হতে পারে? কিন্তু তারপর হঠাৎ মড়ক। ৬৫ রানে ৪ আর ৮৫ ‘তে ইনিংসের অর্ধেকটা খুইয়ে বসা। তখন মনে শঙ্কা, সেই এশিয়া কাপের মত তীরে এসে তরী ডুববে না তো?

দক্ষিণ আফ্রিকার পচেফস্ট্রমে ফিরে আসবে কি কলম্বোর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামের করুণ স্মৃতি? লেগস্পিনার রবি বিষ্ণুর বিষাক্ত স্পিন ছোবল দেখে অমন শঙ্কাই জাগলো।

বারবার মনে হচ্ছিলো, এবার বিশ্ব যুব ক্রিকেটের ফাইনালে ঘুরে ফিরে সেই এশিয়া কাপের ‘রিমেক’ হবে না তো? কথায় বলে, ঘর পোড়া গরু নাকি সিঁদুরে মেঘ দেখলেও ভয় পায়। আজ (রোববার) ভারতীয়দের ১৭৭ রানে অলআউট করার পর ব্যাটিংয়ে নেমে বাংলাদেশের উড়ন্ত সূচনার পর মিডল অর্ডারের মড়ক দেখে অমন শঙ্কাই জাগছিল।

একটু মনের আয়নায় দাঁড়িয়ে খেয়াল করুন, দিনটি ছিল ২০১৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর। ভেন্যু কলম্বোর প্রেমাদাসা স্টেডিয়াম। যুব (অনূর্ধ্ব-১৯) এশিয়া কাপের ফাইনালে ভারতকে ১০৬ রানে অলআউট করেও শেষ হাসি হাসতে পারেনি বাংলাদেশ।

ভাববেন না ম্যাচটি ২০ ওভারের ছিল। ওটাও ৫০ ওভারের টুর্নামেন্ট। যেখানে বাঁহাতি পেসার মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর বিধ্বংসী পেস আর অফস্পিনার শামীম হাসানের জাদুকরি স্পিন বোলিংয়ের মুখে ভারতীয় ইনিংস শেষ হয় ৩২.৪ ওভারে মাত্র ১০৬ রানে।

আজকের মত সেদিনও ভারতের মাত্র তিনজন ব্যাটসম্যান দুই অংকে পৌঁছেছিলেন। তারা হলেন উইকেটকিপার ও অধিনায়ক জোরেল (৫৭ বলে ৩৩), শাসওয়াত রায়াত (২৫ বলে ১৯) আর করন লাল (৪৩ বলে ৩৭)। জবাবে বাংলাদেশ ৩৩ ওভারে অলআউট হয়ে গিয়েছিল ১০১ রানে।

বাঁহাতি স্পিনার অথর্ব বিনোদ আনকোলেকার (৮-২-২৮-৫) একাই স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় নীল করে ছেড়েছিলেন। সাথে বাঁহাতি পেসার আকাশ সিংও (৩/১২) মেতে উঠেছিলেন ধ্বংসযজ্ঞে। অধিনায়ক আকবর আলী (২৩), মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী (২১), তানজিব সাকিব (১২) আর রাকিবুল হাসান (১১) চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারেননি বাংলাদেশকে।

এবার বিশ্ব যুব ক্রিকেটের ফাইনালেও কি শেষ পর্যন্ত ঐ এশিয়া কাপের পুনরাবৃত্তি হবে? শঙ্কা জেগেছিল ঠিকই। কিন্তু অধিনায়ক আকবর আলীর দৃঢ়তায় কর্পুরের মত উবে গেল সেই সব সংশয় আর শঙ্কা ।

হিমালয়ের মত অবিচল থেকে দলকে জয়ের বন্দরে পৌঁছে বিশ্বসেরার মুকুট মাথায় পড়ে নিলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। অষ্টম উইকেটে তাকে অসাধারণ সঙ্গ দিয়েছেন বাঁহাতি স্পিনার রাকিবুল হাসানও।

১৪৩ রানে সপ্তম উইটে পতনের পরও সাহস হারাননি আকবর আর রকিবুল। অষ্টম উইকেটে অবিচল আস্থা ও আত্মবিশ্বাসে বলিয়ান আকবর আলী এক পর্যায়ে ৩২ ওভার থেকে ৩৬.৪ ওভার পর্যন্ত একটি রানও করেননি। জানতেন, এখন রান করার চেয়ে উইকেটে টিকে থাকাই হবে আসল কাজ। সেই কাজটি দক্ষতার সাথে করে ৩৬.৫ ওভারে গিয়ে মিডঅফে ঠেলে প্রথম সিঙ্গেলস নেন আকবর আলী।

শেষ পর্যন্ত অধিনায়ক সামনে থেকে নেতৃত্ব দিলেন। অষ্টম উইকেটে রাকিবুলকে সাথে নিয়ে অবিচ্ছিন্ন ৩৪ রানের জুটি গড়ে জয় নিশ্চিত করলেন। আকবরের ৭৭ বলে ৪৩ রানের ইনিংসটি বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরেই লিখা থাকবে।

হাফসেঞ্চুরি কিংবা শতরানের ইনিংস নয়, কিন্তু আকবরের আলীর এই ইনিংসটি ছিল যে কোনো সেঞ্চুরি বা হাফসেঞ্চুরির চেয়েও দামি। দলের বিপর্যয়ে যেভাবে হাল ধরলেন, মনে পড়ে গেল সেই সাতানব্বইয়ের আকরাম খানকে।

২০২০ সালে এসে মনে হতে পারে, বাংলাদেশ এখন নিয়মিতই বিশ্বকাপ খেলে। সেরা আটে উঠেছে দুইবার, আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনালে খেলার রেকর্ডও আছে টাইগারদের। তাহলে ‘৯৭র আইসিসি ট্রফিতে খেলা আকরাম খানের ঐ ইনিংসটি এত গুরুত্বপূর্ণ কেনো?

কারণ হলো, আসলে আকরাম খানের হল্যান্ডের বিপক্ষে খেলা ৬৮ রানের ম্যাচ জেতানো ইনিংসের ওপরেই বাংলাদেশ ক্রিকেটের সত্যিকারের ভিত গড়ে ওঠা। সে ম্যাচে না জিতলে, ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপেই খেলা হতো না টাইগারদের।

অপেক্ষায় থাকতে হতো পরের আইসিসি ট্রফির দিকে। আর অনিবার্যভাবেই, ‘৯৯ সালে বিশ্বকাপ না খেললে ২০০০ সালে টেস্ট মর্যাদাও লাভ হতো না। কাজেই এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, বাংলাদেশের ক্রিকেটের উত্তরণে আকরাম খানের সেই ইনিংসই সবচেয়ে বড় রচয়িতা।

পচেফস্ট্রমে যুব বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলা অধিনায়ক আকবরের ৪৩ রানের ইনিংসটিও মহা মূল্যবান। ম্যাচের পরিস্থিতি যেমন ছিলো, ১৭৮ রানের লক্ষ্যেই হারার উপক্রম হয়েছিল। সেখান থেকে মাথা ঠাণ্ডা রেখে দলকে জয়ের বন্দরে পৌঁছে দিয়েছেন আকবর। যা বাংলাদেশকে এনে দিয়েছে প্রথমবারের মতো বিশ্বমানের কোনো সাফল্য। কাজেই আকরামের পর এখন আকবরই বাংলাদেশ ক্রিকেটের অন্যতম বড় নায়ক। 

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com