বিশ্বচ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ
রকিবুল হাসানের ব্যাট থেকে আসা জয়সূচক রানটি পূর্ণ হওয়ার আগেই উসাইন বোল্টের গতিতে লাল-সবুজের পতাকা হাতে মাঠে ঢুকে পড়লেন দলের সবাই। চ্যাম্পিয়ন, চ্যাম্পিয়ন চিৎকারে প্রকম্পিত পচেফস্ট্রুমের আকাশ-বাতাস। উৎসবের সেই ঢেউ মহাদেশ পেরিয়ে মুহূর্তেই গ্রাস করে ফেলে টিএসসি থেকে টেকনাফ, গোটা বাংলাদেশকে।
কাল দুপুর থেকে ঐতিহাসিক এক ক্ষণেই দাঁড়িয়ে ছিল বাংলাদেশের ক্রিকেট। অপেক্ষার প্রহর শেষে রাতে ধরা দিল চূড়ান্ত সাফল্য। দক্ষিণ আফ্রিকার পচেফস্ট্রুমে রোববার অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের ফাইনালে টুর্নামেন্ট ইতিহাসের সফলতম দল ভারতকে তিন উইকেটে হারিয়ে নতুন এক ইতিহাস লিখল বাংলাদেশ যুব দল।
যে কোনো পর্যায়ের ক্রিকেট তো বটেই, সব খেলা মিলিয়েই প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জিতল বাংলাদেশ। রংধনুর দেশে আকবর আলীরা লিখলেন বাংলাদেশের ক্রীড়া ইতিহাসে রঙিনতম অধ্যায়টি। অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেটে বাংলাদেশ এখন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। জাতীয় দল যে সাফল্য পায়নি সেটাই করে দেখাল যুবারা।
সেটাও অনবদ্য পরিণত পারফরম্যান্সে। টস হেরে ব্যাটিংয়ে নামা ভারতকে ১৭৭ রানে গুটিয়ে দিয়ে ইতিহাস গড়ার মঞ্চটা সাজিয়ে দিয়েছিলেন পেসাররা। মাঝারি লক্ষ্য তাড়ায় ৫০ রানের উদ্বোধনী জুটিতে সহজ জয়ের পথেই ছিল বাংলাদেশ। এরপর হঠাৎ ঝড়ে তীরে এসে তরী ডোবার শঙ্কা জেগেছিল।
১০২ রানে ছয় উইকেট হারিয়ে ব্যাকফুটে চলে যাওয়া দলকে সামনে থেকেই ঘুরে দাঁড়ানোর পথ দেখালেন অধিনায়ক আকবর আলী। পারভেজ হোসেন (৪৭) ও রকিবুলকে নিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় সব চাপ সামলে দলকে জয়ের ঠিকানায় পৌঁছে দেন ৪৩ রানে অপরাজিত থাকা আকবর।
জয় থেকে বাংলাদেশ যখন ১৫ রান দূরে, ক্ষণিকের বৃষ্টিতে কিছু সময় বন্ধ ছিল খেলা। এতে ডাক-ওয়ার্থ লুইস পদ্ধতিতে বাংলাদেশের নতুন লক্ষ্য দাঁড়ায় ৪৬ ওভারে ১৭০ রান। ২৩ বল বাকি থাকতেই সমীকরণ মিলিয়ে গোটা দেশকে উচ্ছ্বাসে ভাসার ঐতিহাসিক উপলক্ষ্য এনে দেন আকবররা।
১৯৯৭ আইসিসি ট্রফি বাদ দিলে ক্রিকেটের বৈশ্বিক কোনো টুর্নামেন্টে এটাই বাংলাদেশের প্রথম শিরোপা। যুবাদের এ সাফল্য ভবিষ্যতে হয়তো বড়দের বিশ্বকাপ জয়ের প্রেরণা হবে। বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নে শুরুতেই পাল তুলে দিয়েছিলেন বোলাররা। সঙ্গে দাপুটে ফিল্ডিংয়ে কখনই মাথা উঁচু করতে পারেনি ভারত।
ব্যাটিংয়েও দুই ওপেনার পারভেজ হোসেন ও তানজিদ হাসান উড়ন্ত সূচনা করেন। ১৭৮ রানের লক্ষ্যটা তখন খুব ছোটই মনে হচ্ছিল। অতি আক্রমণের চেষ্টায় ওপেনিং জুটি ভাঙে ৫০ রানে। সেমিফাইনালে সেঞ্চুরি করে ম্যাচে জয়ের নায়ক মাহমুদুল হাসানও নেমে ছন্দ পেয়ে যান।
সেখান থেকে মাটিতে নামতে বেশি সময় লাগেনি বাংলাদেশের। লেগ-স্পিনে বরাবরই দুর্বল বাংলাদেশ। যুবারাও সেটা কাটিয়ে উঠতে পারলেন না। রবি বিষ্ণু বোলিংয়ে আসার সঙ্গেই চিত্র পাল্টে যেতে থাকে। ওপেনার তানজিদ আউট হন বড় শট খেলতে গিয়ে। এরপর দলীয় ৬২ রানের সময় বিষ্ণুর গুগলি বুঝতেই পারেননি মাহমুদুল।
আট রান করেই বোল্ড হয়ে ফেরেন তিনি। তার সঙ্গে মাঠ ছাড়েন ওপেনার পারভেজ হোসেনও। হ্যামস্ট্রিংয়ের চোট নিয়ে ২৫ রান করে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে মাঠ থেকে বের হন। বিপদ যেন আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরে। বিষ্ণু তার পরের ওভারে আবার ফিরিয়ে দেন সবচেয়ে পরিণত তৌহিদ হৃদয়কেও।
এই লেগির বোলিংয়ে চাপ বাড়তেই থাকে। এখানেই থামা নয়। এক ওভার পরে এসে শাহাদাতকে কিছুটা সামনে খেলতে বাধ্য করেন বিষ্ণু। ঝুলে গিয়ে রক্ষণাত্মক খেলতে গিয়েই স্ট্যাম্পিংয়ের শিকার হন শাহাদাত। এরপর শামীম ছক্কা মারতে গিয়ে আউট হলে ৮৫ রানে তখন বাংলাদেশের পাঁচ উইকেট নেই।
জীবন পেয়েও অভিষেক দাস বেশিদূর এগোতে পারেননি। দলের হাল ধরতে আবার ইনজুরি নিয়ে মাঠে প্রবেশ করেন পারভেজ। পরে অধিনায়ককে দারুণ সঙ্গ দিয়েছেন তিনি। ৪১ রানের জুটি গড়ে দলকে জয়ের পথে রেখে ৪৭ করা পারভেজ আউট হন পার্ট টাইমার জয়সওয়ালের বলে। তখনও চাপ নেননি অধিনায়ক। ঠাণ্ডা মাথায় একপাশ আগলে রেখে এগিয়ে গেছেন বাংলার আকবর। মাঝে বৃষ্টি বাধা হয়ে দাঁড়ালেও সেটা বাংলাদেশের জয় আটকাতে পারেনি।
এবারের যুব বিশ্বকাপে ভারত ফাইনালের আগে কখনই অলআউট হয়নি। কিন্তু ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের আটকানোর রেসিপিটা জানা ছিল বাংলাদেশের। এজন্য তিন পেসার নিয়ে একাদশ সাজায় টিম ম্যানেজমেন্ট। টস ভাগ্য সহায় হওয়ায় আরও একধাপ এগিয়ে যায় যুব টাইগাররা।
উইকেটের সুবিধা কাজে লাগানোর জন্য টস জিতে ফিল্ডিং নিতে ভুল করেননি আকবর আলী। শুরুতে দুর্দান্ত লাইন-লেন্থের পসরা সাজিয়ে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের দিকে তোপ দাগেন পেসাররা। সতীর্থ গতি তারকাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ইনিংসের মাঝের অংশে কম যাননি বাংলাদেশের স্পিনাররাও। অনেক ডট বল খেলিয়ে প্রতিপক্ষের ওপর চেপে ধরে রেখেছিলেন বোলাররা। সঙ্গে দারুণ ফিল্ডিং বোলারদের বাড়তি শক্তি জুগিয়েছে।
পেসার শরিফুল ইসলাম প্রথম ওভারেই জানিয়ে দেন কেন তিনি আলাদাভাবে আলোচনায় থাকেন। প্রথম ওভারে ঠিকমতো ব্যাটেই খেলতে পারেননি ওপেনার যাসাশবি জয়সওয়াল। শরিফুল পান মেডেন। পরের ওভারে আক্রমণে আসা তানজিম হাসানও বৈচিত্র্য ও গতিতে মেডেন পেয়ে যান।
ভারতের বাকি ব্যাটসম্যানরা শরিফুলদের বুঝতে না পারলেও পড়ে ফেলেছিলেন জয়সওয়াল। ভারতের পক্ষে পুরো ইনিংসে তিনি একাই লড়েছেন। শরিফুল ও তানজিমের ভালো বোলিং শুরু থেকে চাপে রাখে ভারতকে। প্রথম ছয় ওভারে তারা তুলেছিল মাত্র আট রান। এরপর এসেই উইকেট তুলে নেন স্পিনার হাসান মুরাদের জায়গায় সুযোগ পাওয়া অভিষেক দাস।
রানের গতি খুবই মন্থর হলেও ৯৪ রানের জুটি গড়ে চাপ সামলে নেন জয়সওয়াল ও তিলক ভার্মা। ভারতের রানের দম আটকে রাখেন বোলাররা। এরই মধ্যে দলের প্রয়োজনের মুহূর্তে আসরে নিজের চতুর্থ ফিফটি তুলে নেন জয়সওয়াল। বিপজ্জনক হয়ে ওঠা এ জুটি ভেঙে অল্প সময়ের মধ্যে দু’বার উৎসব করে বাংলাদেশ।
৬৫ বলে ৩৮ করে তানজিম হাসান সাকিবের বলে সীমানার কাছে ক্যাচ দেন ভার্মা। দারুণভাবে বল লুফে নেন দীর্ঘদেহী শরিফুল। এরপর প্রিয়ম গার্গকে তানজিদ হাসানের ক্যাচে পরিণত করেন স্পিনার রকিবুল হাসান। ভারতীয় অধিনায়ক করেন নয় বলে সাত রান।
শুরুতে আগ্রাসী বোলিংয়ে প্রতিপক্ষকে চাপে রাখলেও প্রথমদিকে উইকেট পাননি শরিফুল। এরই মধ্যে চতুর্থ উইকেটে ধ্রুব জুরেলকে নিয়ে শক্ত ভিত দাঁড় করিয়ে ফেলেন জয়সওয়াল। তবে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে জয়সওয়ালকে ফেরান শরিফুল। ৪০তম ওভারে শেষ দুই বলে দু’বার উল্লাস করেন তিনি।
ভেঙে দেন জয়সওয়াল-জুরেলের ৪২ রানের জুটি। পাশাপাশি ভারতের বড় সংগ্রহের স্বপ্নেও তিনি দেন জোর ধাক্কা। ভারতের একমাত্র হাফ সেঞ্চুরিয়ান বাঁ-হাতি ওপেনার ১২১ বলে ৮৮ করে ফেরেন। ভারত সেখান থেকে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। শামীম-শরিফুলদের দুর্দান্ত ফিল্ডিং ও পেসারদের ভেরিয়েশনে ভারত ১৭৭ রানেই অলআউট হয়। শেষ ২১ রান তুলতে তারা সাত উইকেট হারায়। অভিষেক নেন তিনটি এবং শরিফুল ও তানজিম দুটি করে উইকেট নেন।