বেরিয়ে এলো মতিউরের প্রথম স্ত্রী লাকির থলের বেড়াল
এক ছাগলকাণ্ডেই বেরিয়ে এলো জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা ড. মতিউর রহমান ও তার প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ লাকির থলের বেড়াল।
নরসিংদীতে মতিউর রহমানের প্রথম স্ত্রীর অঢেল সম্পত্তির খোঁজ মিলেছে।
লায়লা কানিজ লাকি রায়পুরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। সরকারি তিতুমীর কলেজের বাংলা বিষয়ের সহযোগী অধ্যাপকের চাকরি ছেড়ে ২০২২ সালে রাজনীতিতে এসেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উপজেলা চেয়ারম্যান হন তিনি। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক।
জানা যায়, রায়পুরার মরজালে ৩০ বিঘা জমির ওপর গড়ে তোলা হয়েছে আলিশান ওয়ান্ডার পার্ক ও ইকো রিসোর্ট। যা স্থানীয়ভাবে লাকি পার্ক নামেও পরিচিত। ছাগলকাণ্ডে পর পার্কটির মালিকানা লাকির নয় বলে দাবি করছেন কর্মকর্তারা তারা বলছেন, পার্কটির মালিক আবুল খায়ের মানিক। তবে লাকির দুই সন্তান তৌফিকুর রহমান অর্ণব ও ফারজানা রহমান ইপ্সিতার মালিকানা রয়েছে। পার্কটির ভেতরের প্রায় তিন বিঘা আয়তনের লেকটি লায়লা কানিজের ‘লাকি মৎস্য খামার’ নামে নিবন্ধিত।
সরেজমিনে ওয়ান্ডার পার্ক ও ইকো রিসোর্টে গিয়ে দেখা গেছে, ২০০ টাকার টিকিট কেটে পার্কে প্রবেশ করছেন দর্শনার্থীরা পার্কের ভেতরে রয়েছে বিলাসবহুল কটেজ। এতে রয়েছে নয়টি রুম। বিভিন্ন বয়সীদের জন্য রয়েছে সাতটি রাইড। যা আলাদা টিকিট কেটে উপভোগ করতে হয়। পুরো পার্কজুড়ে বিভিন্ন ভাস্কর্য ও স্থাপনা। প্রতিদিন শত শত মানুষ এই পার্কে ঘুরতে আসছেন। এখানে পিকনিক ও বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজনেরও ব্যবস্থা রয়েছে।
টিকিটবিক্রেতা বাতেনের কাছে পার্কটির মালিক কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, এটা উপজেলা চেয়ারম্যানের নয়; এর মালিক আবুল খায়ের মানিক। লাকি আপা মাঝেমধ্যে পার্কে আসেন। তিনি আর কোনো তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানান।
তবে পার্কটির সামনের ফুচকাবিক্রেতা মিরাজ বলেন, আমরা পার্কটি উপজেলা চেয়ারম্যান লাকি আপার বলেই জানি। তিনি ও তার পরিবার পার্কে এসে তদারকি করেন। পার্কের ভালো-মন্দের খোঁজখবর নেন, প্রয়োজনে পরামর্শ দেন। ওনার অনেক সম্পত্তি আছে শুনেছি। ওনার গাজীপুরের পূবাইলে ‘আপন ভুবন’ নামে একটি পিকনিক স্পট রয়েছে।
পার্কের সামনের মুদি দোকানদার সোহাগ বলেন, পার্কটি সবাই উপজেলা চেয়ারম্যানের বলেই জানে। এটি অনেক জায়গা নিয়ে বড় করে করা হয়েছে। ওনার আরও সম্পত্তি রয়েছে।
এছাড়া মরজাল বাসস্ট্যান্ড থেকে এক কিলোমিটার দূরত্বেই রয়েছে মতিউর রহমান ও লায়লা কানিজ দম্পতির আধুনিক স্থাপত্যের ডুপ্লেক্স বাড়ি। বাড়ির পাশের রাস্তার নাম করা হয়েছে ‘লায়লা কানিজ লাকি সড়ক’।
গাজীপুরের পূবাইলে আপন ভুবন নামে বিনোদন পার্ক ও পিকনিক স্পট থেকে শুরু করে রয়েছে বাণিজ্যিক এলাকায় কোটি কোটি টাকার জমি-প্লট রয়েছে লাকির। তাছাড়াও তার রয়েছে নরসিংদী ও ঢাকায় আলিশান বিলাসবহুল বাড়ি।
লায়লা কানিজ লাকি চড়েন দামি ব্রান্ডের গাড়িতে। নির্বাচনি হলফনামায় সম্পত্তি উল্লেখ করলেও প্রকৃত বাজারমূল্য থেকে কম দেখিয়েছেন তিনি।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, শিক্ষক থেকে রাজনীতিবিদ বনে যাওয়া লায়লা কানিজের সম্পদের মধ্যে ১৫৪ শতাংশ কৃষিজমি ছাড়াও রয়েছে রাজউকে পাঁচ কাঠা, সাভারে সাড়ে ৮ কাঠা, গাজীপুরে ৫ কাঠা, গাজীপুরের পুবাইলে ৬ দশমিক ৬০ শতাংশ ও ২ দশমিক ৯০ শতাংশ, গাজীপুরের খিলগাঁওয়ে ৫ শতাংশ ও ৩৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ, গাজীপুরের বাহাদুরপুরে ২৭ শতাংশ, গাজীপুরের মেঘদুবীতে ৬ দশমিক ৬০ শতাংশ, গাজীপুরের ধোপাপাড়ায় ১৭ শতাংশ, রায়পুরায় ৩৫ শতাংশ, ৩৫ শতাংশ ও ৩৩ শতাংশ, রায়পুরার মরজালে ১৩৩ শতাংশ, সোয়া ৫ শতাংশ, ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ, ২৬ দশমিক ২৫ শতাংশ ও ৪৫ শতাংশ, শিবপুরে ২৭ শতাংশ ও ১৬ দশমিক ১৮ শতাংশ, শিবপুরের যোশরে সাড়ে ৪৪ শতাংশ, নাটোরের সিংড়ায় ১ একর ৬৬ শতাংশ জমি।
লাকির নির্বাচনী হলফনামা বলছে, তার বাৎসরিক আয় কৃষিখাত থেকে ১৮ লাখ, বাড়ি-অ্যাপার্টমেন্ট-দোকান ও অন্যান্য ভাড়া থেকে ৯ লাখ ৯০ হাজার, শেয়ার-সঞ্চয়পত্র-ব্যাংক আমানতের লভ্যাংশ থেকে ৩ লাখ ৮২ হাজার ৫০০, উপজেলা চেয়ারম্যানের সম্মানী বাবদ ১ লাখ ৬৩ হাজার ৮৭৫, ব্যাংক সুদ থেকে ১ লাখ ১৮ হাজার ৯৩৯ টাকা। বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তার জমা রয়েছে ৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।
স্থানীয়রা বলছেন, লায়লা কানিজের বাবা কফিল উদ্দিন আহম্মদ ছিলেন একজন খাদ্য কর্মকর্তা। তার মেয়ে লায়লা কানিজ সরকারি কলেজে শিক্ষকতা করলেও রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমানের সঙ্গে বিয়ের পর ভাগ্য খুলে যায়। গত ১৫ বছরে তার সম্পদ লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। তিনি এসব সম্পদ গড়েছেন তার স্বামী আলোচিত রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমানের অবৈধ উপার্জনে। শিক্ষকতার আয়ে বা পেনশনের টাকায় তার এত সম্পদ থাকার কথা নয়।
সরেজমিনে লায়লা কানিজ লাকির আলিশান বাড়ির চাকচিক্য ও সম্পদ দেখতে গেলে ভেতরে প্রবেশ করতে দেননি কেয়ারটেকার।
তিনি বলেন, উপজেলা চেয়ারম্যান বাড়িতে নেই। তিনি ঈদের পর একবার এসেছিলেন কিন্তু বেশিক্ষণ থাকেননি। ঢাকায় চলে গেছেন, বাড়ি বেশিরভাগ সময়ই খালি থাকে।
ফটকের বাইরে থেকে দেখা যায়, কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত আধুনিক স্থাপত্যের বাড়িটি বেশ বিলাসবহুল। বাড়িজুড়ে দেশি-বিদেশি গাছে সারি, সবুজ ঘাসের আঙিনা। পেছনে রয়েছে শান বাঁধানো ঘাট ও লেক। পাশে রয়েছে কর্মচারীদের থাকার স্থান, এটিও নান্দনিক একটি স্থাপনা।
বাড়িটির ভেতরে ঢুকেছেন এমন কয়েকজন জানান, বাড়িটিতে সবসময়ই লায়লা কানিজ লাকি থাকেন। আর মতিউর রহমান মাঝেমধ্যে আসেন। ভেতরে রাজকীয় সব আসবাবপত্র ও দামি জিনিসপত্রে ঠাসা।
স্থানীয় বাসিন্দা শাহজালাল বলেন, উপজেলা চেয়ারম্যানের এখানে খুব দাপট আছে। ওনার স্বামী এনবিআরে চাকরি করে জানি। দুই-তিন বছর আগে এই বিশাল বাড়িটি নির্মাণ করেছেন তিনি।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা জানায়, লাকির পার্কটিতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল সংসদ সদস্য সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর। এ সূত্রে তিনি রাজু এমপির ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। প্রথমে রায়পুরা উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য হন লাকি। ২০২৩ সালে রায়পুরা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সাদেকুর রহমান ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে উপনির্বাচনে প্রভাবশালী স্বামীর অবৈধ অর্থের প্রভাব ও রায়পুরার এমপি রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর সমর্থনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এছাড়াও নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদকের পদ বাগিয়ে নেন। বর্তমানে তিনি জেলাজুড়ে দানবীর হিসেবে সর্ব মহলে প্রশংসিত ও পরিচিতি লাভ করেছেন। ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তৃতীয় ধাপে গত ২৯ মে টেলিফোন প্রতীক নিয়ে চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী ছিলেন লাকি। ওই উপজেলায় নির্বাচনের ভোট গ্রহণের আগে ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী মো. সুমন মিয়ার মৃত্যুতে নির্বাচন স্থগিত করে প্রজ্ঞাপন জারি করেন নির্বাচন কমিশনার। আসছে ২৬ জুন নির্বাচন সম্পন্ন করতে পুনঃতফসিল ঘোষণার কথা রয়েছে।
তারা আরও বলেন, লাকিকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের ত্যাগী সব নেতারা এখন কোণঠাসা। অবস্থা এখন এমন, সংসদ সদস্য এবং তিনি একটি পক্ষ আর সব আওয়ামী লীগ নেতা আরেক পক্ষ। সংসদ সদস্যের সহযোগিতায় নরসিংদীর সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে দলীয় মনোনয়নও চেয়েছিলেন তিনি।
রায়পুরা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আফজাল হোসাইন বলেন, বর্তমানে যারা মন থেকে আওয়ামী লীগ করে তারা নির্যাতিত। তারা দলে সম্মান না পেয়ে দল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। একমাত্র এমপি সাহেবের উৎসাহে রাজনীতিতে এসেছেন লাকি। এমপি সাহেব পার্কে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করতেন যার সব বহন করতেন লাকি। তিনি টাকার কুমির। স্বামীর অবৈধ টাকার জোড়ে তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান হয়েছেন। তার কারণে দুঃসময়ের আওয়ামী লীগ করা নেতারা মূল্যায়ন পাচ্ছেন না। যার কারণে ক্ষতি হচ্ছে দলের। প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন। আমরা বিশ্বাস করি, অতি শিগগিরই এসব দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন তিনি।
পাহাড়সম সম্পদের হিসাবের ব্যাপারে জানতে লায়লা কানিজ লাকির ব্যবহৃত মোবাইলফোন নম্বরে একাধিকবার কল দিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি। যে কারণে তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
সুত্র: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর