বাজেটে সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণ মূল্যস্ফীতির কারণ হতে পারে: আইসিএবি
২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নেওয়ার যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে তা মূল্যস্ফীতির কারণ হতে পারে বলে জানিয়েছে দি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড একাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি)।
প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটের ওপর চার্টার্ড একাউন্টেন্টদের ভাবনা তুলে ধরতে শনিবার (৮ জুন) এক সংবাদ সম্মেলনে আইসিএবির সভাপতি মোহাম্মদ ফোরকান উদ্দীণ এ অভিমত দেন।
তিনি বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতির দিক থেকে, দেশের মুদ্রাস্ফীতির হার ৯ শতাংশের বেশি, যা উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির ইঙ্গিত। মোট বাজেটের প্রায় ২০ শতাংশ অর্থাৎ ১ লাখ ৬০ হাজার ৯০০ কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে অর্থায়ন করার প্রস্তাব করা হয়েছে, যা মূল্যস্ফীতির কারণ হতে পারে।
ফোরকান উদ্দীণ বলেন, অর্থমন্ত্রী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার একটি সময়োপযোগী ও ব্যাপক আকারের বাজেট সংসদে পেশ করেছেন। প্রস্তাবিত বাজেট আমাদের জিডিপির ১৪.২ শতাংশ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বৈশ্বিক সংকট, ডলার সংকট, ব্যবসা-বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে মন্দা এবং অন্যান্য বৈশ্বিক অনিশ্চয়তা থাকা সত্ত্বেও সরকার ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ নিয়েছে। যা আমাদের একটি উন্নত দেশে পৌছার যাত্রায় সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
তিনি বলেন, কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর জন্য কর নেট সম্প্রসারণ এখন সময়ের দাবি। আমরা বিশ্বাস করি যে ডকুমেন্ট ভেরিফিকেশন সিস্টেম (ডিভিএস) বাস্তবায়নে এনবিআর এবং আইসিএবির যৌথ উদ্যোগ কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব অর্জনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে এবং আগামী দিনেও অধিকতর অবদান রাখবে।
তিনি আরও বলেন, কর রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য ডিভিএস বাস্তবায়নে আইসিএবি-কে সহায়তার জন্য আমরা অর্থ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) ধন্যবাদ জানাই।
আইসিএবি সভাপতি বলেন, বাজেট বক্তৃতায় রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ডিভিএস’র অবদানকে গুরুত্ব প্রদান করা এবং করদাতা কর্তৃক প্রদর্শিত আয়ের সত্যতা এবং স্বচ্ছতা বাড়ার কথা উল্লেখের জন্য আমরা অর্থমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই।
বিগত বছরগুলোর ন্যায় এ বছরেও আইসিএবি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে ২০২৪-২৫ বাজেট সংক্রান্ত রাজস্ব আইনের যেমন- আয়কর আইন ২০২৩ ও আয়কর বিধিমালা ২০২৩, মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন ২০১২ এবং মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক বিধিমালা ২০১৬, কাস্টমস আইনসহ অন্যান্য আইন ও বিধির ওপর প্রস্তাবনা প্রেরণ করেছে বলে জানান তিনি।
প্রস্তাবিত বাজেটে বেশ কিছু বাস্তবভিত্তিক উদ্যোগ নেওয়ার জন্য সরকারের প্রশংসা করে তিনি আয়কর আইনে কয়েকটি সুপারিশকে স্বাগত জানান। এরমধ্যে রয়েছে-
১. দুই বছরের জন্য প্রযোজ্য করের হার প্রবর্তন
২. প্রাইভেট কোম্পানি এবং ওয়ান পার্সন কোম্পানির (OPC) জন্য করের হার হ্রাস করা
৩. নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর উৎস কর হ্রাস
৪. স্বাভাবিক ব্যক্তি, প্রাথমিক ও প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা দানে নিয়োজিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ৫ কোটি টাকার নিম্নে গ্রস প্রাপ্তি রয়েছে এরূপ কোনো ফার্ম, ট্রাস্ট, ব্যক্তিসঙ্ঘ, ফাউন্ডেশন, সমিতি, এবং সমবায় সমিতি ছাড়া অন্যান্য সব করদাতার জন্য নিরীক্ষিত আর্থিক বিবরণীর বাধ্যবাধকতার বিধান।
এসময় তিনি কয়েকটি বিষয় বিবেচনার সুপারিশ করেন। এরমধ্যে রয়েছে-
১. রাষ্ট্রপতির আদেশে বা সংসদীয় আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এবং একই আইনের বিধি-বিধান অনুসারে গঠিত পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক পরিচালিত স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, যারা শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়নে নিয়োজিত, ওই সব পেশাদার এবং বৃত্তিমূলক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সপ্তম তফসিলের অধীনে একই কর কাঠামোর আওতায় আনা।
২. মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়া পূর্ব নির্ধারিত শতাংশের হার, মানদণ্ড এবং দৈবচয়নের ভিত্তিতে ট্যাক্স–ভ্যাট নিরীক্ষার নথি নির্বাচন করা এবং নিরীক্ষা পদ্ধতি সহজীকরন।
আইসিএবির পক্ষ থেকে ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক আইনে পরিবর্তনের প্রশংসা করা হয়। এরমধ্যে রয়েছে-
১. আপিলাত ট্রাইব্যুনাল এবং আপিল কমিশনারেটে আপিলের জন্য আবেদন জমা দেওয়ার সময়, জরিমানা ছাড়া চাহিদার ২০ শতাংশের পরিবর্তে ১০ শতাংশ প্রদান করা।
২. ১০ কোটি টাকার ওপরে টার্নওভার রয়েছে এমন প্রতিষ্ঠানকে VDS কর্তৃপক্ষ হিসাবে অন্তর্ভুক্তি করণে ভ্যাট আহরণ বাড়বে।
৩. ভ্যাট নেট সম্প্রসারণের জন্য ইএফডিএমএস স্থাপনের উদ্যোগ।
বাংলায় নতুন শুল্ক আইন ২০২৩ প্রণয়ন ও ৬ জুন ২০২৪ থেকে এর কার্যকর করাকেও স্বাগত জানিয়েছে আইসিএবি। সেই সঙ্গে শুল্ক আইনের কয়েকটি বিষয়ের প্রশংসা করেছে। এরমধ্যে রয়েছে –
১. নতুন শুল্ক আইনে ধারা ৯০ (৩) এর আওতায় স্ব-মূল্যায়নের বিধান চালু করা হয়েছে।
২. দাবিকৃত শুল্ক এবং কর বা জরিমানার বিরুদ্ধে আপিল দায়েরের ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে শুল্ক বা কর ৫০ শতাংশের থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে।
৩. ফেরত দাবি করার সময়সীমা ৬ মাস থেকে বাড়িয়ে ৩ বছর করা হয়েছে।
৪. বিল অফ এন্ট্রি বা বিল অফ এক্সপোর্টের স্থলে নির্ধারিত ফরম ও পদ্ধতিতে ঘোষণা করে শুল্কায়ন এবং পণ্য ছাড়করণের সুযোগ প্রদান।
৫. পণ্য ঘোষণা প্রতিস্থাপন, সংশোধন ও প্রত্যাহারের বিধান রাখা।