যেভাবে দখলদারির মাধ্যমে গড়ে উঠেছিল বেনজীরের ‘রিসোর্ট’

0

গোপালগঞ্জে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে করা হয়েছে সাভানা ইকো রিসোর্ট অ্যান্ড ন্যাচারাল পার্ক। এ পার্কে জমির প্রায় সবই হিন্দু সম্প্রদায়ের। ভয় দেখিয়ে, জোর করে এবং নানা কৌশলে এসব জমি কেনা হলেও অনেক জমি দখলের অভিযোগ উঠেছে। এমনকি সরকারি সড়ক দখল করে ফটক নির্মাণ করে আটকে দেয়ায় অনেকই তাদের জমিতে যেতে পারছেন না।

অভিযোগ রয়েছে দুদক তদন্তের নির্দেশ দেয়ার পর আদালত মালামাল ক্রোক করার নির্দেশ দিলে পার্ক থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে মালামাল। দ্রুত তাদের জমি ফেরতের দাবি জানিয়েছে ভুক্তভোগীরা।

বৈরাগীটোল গ্রামে গিয়ে জানা গেছে, ২০১৫ থেকে ২০২০ সালে র‌্যাবের মহাপরিচালক এবং ২০২০ সাল থেকে থেকে ২০২২ পর্যন্ত আইজিপি থাকাকালীন গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার বৈরাগীটোল গ্রামে গড়ে তোলেন সাভানা ইকো রিসোর্ট অ্যান্ড ন্যাচারাল পার্ক। এই রিসোর্টে মানুষকে থাকার জন্য কক্ষ ভাড়া দেয়া হয়। ১০০ টাকা দিয়ে প্রবেশ করে ঘুরেও দেখা যায়। পার্কের ভেতরে খামার, নৌকা ভ্রমণের ব্যবস্থা, শিশুদের খেলার জায়গা ও হেলিপ্যাডসহ নানা স্থাপনা রয়েছে। পার্কটির নির্মাণকাজের তদারকি করতো পুলিশ ও র‍্যাবের কিছু সদস্য।

ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই পার্ক নির্মাণ করতে তিনি ওই এলাকার বহু হিন্দু সম্প্রদায়ের জমি ভয় দেখিয়ে জোর করে নিয়ে নেন। অনেকই জমি বিক্রি না করায় কৌশলে বালু ভরাট করে তা দখল করে নিয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে বিক্রি করতে না চাওয়ায় ভয়ভীতি ও হুমকি দেয়ায় পরিবার পরিজন নিয়ে অনেকেই দেশ ছেড়েছেন। প্রতিনিয়ত হুমকি দেয়ায় আতংকের মধ্যে দিন কাটতো এসব পরিবারগুলোর। তাদের জমি কিনতে এক পুলিশ কর্মকর্তাকে নিয়োজিত রেখেছিলেন বেনজীর আহমেদ।

এমনকি স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডির) করা একটি সরকারি সড়কের আড়াইশ মিটার পাকা সড়ক দখল করে নির্মাণ করছেন পার্কের প্রধান ফটক। এ ফটকটি বন্ধ রাখায় পার্কের পাশে ও ভেতরে থাকা নিজেদের জমি ও ঘেরে যেতে পারেন না স্থানীয়রা। ফলে জমির ফসল তুলতে এবং ঘের ও পুকুর থেকে মাছ সংগ্রহ করতে গেলেও বাঁধায় পড়তে হয় তাদের।

এদিকে গোপালগঞ্জ সদর এলাকায় বেনজীর আহমেদের মালিকানাধীন সাভানা ইকোরিসোর্ট অ্যান্ড ন্যাচারাল পার্কের সামনে স্থানীয়দের ওপর পুলিশের হামলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। শনিবার (১ জুন) সন্ধ্যার পর ওই ঘটনায় চারজন যুবক আহত হয়েছেন বলে দাবি স্থানীয় বাসিন্দাদের।

তারা জানান, গণমাধ্যমে বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে সম্পত্তির দখলের বিষয়ে কথা বলায় পুলিশ তাদের ওপর লাঠিপেটা করে। পুলিশের লাঠির আঘাতে চারজন আহত হয়েছেন। তারা হলেন- ইকোপার্ক সংলগ্ন সাহাপুর ইউনিয়নের বৈরাগীটোল গ্রামের বিনোদ বিহারি বলের ছেলে বিপ্লব বল, সন্তোষ বলের ছেলে সঞ্জয় বল ও সাগর বল এবং ওই এলাকার রনি নামের এক যুবক।

এদিকে পুলিশ বলছে, সাভানা ইকোরিসোর্ট অ্যান্ড ন্যাচারাল পার্কের সামনে দোকানে স্থানীয় কিছু লোক ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। ওই এলাকায় জুয়া খেলছে এবং হইচই করছে। এতে ওই পার্কের দায়িত্বে থাকা কর্মচারীরা নিরাপত্তা হীনতায় ভুগছেন। এমন খবর পেয়ে সন্ধ্যার পর গোপালগঞ্জের বৌলতলী ফাঁড়ির পুলিশ সদস্যরা সেখানে যান। জুয়ার আড্ডায় থাকা মানুষজনকে সরাতে ধাওয়া দেয়া হয়। এ সময় একজন পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছে।

আরও জানা গেছে, বেনজীর পরিবারের রিসোর্টের মধ্যে কৃষি খামারে কাজ করার সময় ‘বিদ্যুৎস্পৃষ্ট’ হয়ে ২০২০ সালের এপ্রিলে মারা যান গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী সুখ দেব বল (১৯)। তার মৃত্যুর ঘটনায় আইনি ব্যবস্থা নিতে চেয়েছিলেন তার বাবা শুসেন বল। তবে পুলিশ কর্মকর্তা তৈমুরের হুমকিতে তারা মামলা করতে পারেননি।

অভিযোগ রয়েছে আদালত সম্পত্তি ক্রোকের নির্দেশ দিলে কয়েকটি ট্রাকের মাধ্যমে পার্ক থেকে মালামাল সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এমনকি ব্যাংক লোন নিয়ে করা খামার থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে গরু। এসব ব্যাপারে গণমাধ্যমে মুখ খোলায় কয়েকজন গ্রামবাসীকে পিটিয়ে আহত করারও অভিযোগ উঠেছে। পার্কের নিরাপত্তায় নিয়োজিত করা হয়েছে পুলিশ।

ভুক্তভোগী বিপ্লব বল জানান, ২০১৮ সাল নাগাদ এই পার্কের কাজ শুরু করেন বেনজীর আহমেদ। র‌্যাবের মহাপরিচালক থাকাকালীন তার লোকজন ছিলেন প্রচণ্ড আক্রমণাত্মক। তারা বিভিন্নভাবে প্রলোভন দেখিয়ে, ভয়ভীতি দিয়ে জমিগুলো নিয়ে নেন। আমার কাছে জমি চান। কিন্তু আমি দিতে না চাইলে বিভিন্ন সময় আমার জমি থেকে প্রায় তিনশ গাছ কেটে নেয়। তবে প্রশাসনের লোকজনই এখানে বেশি কাজ করতেন। প্রশাসনের তৈমুর ইসলাম নামে এক ব্যক্তি বেশি কাজ করতেন। তিনি আমাকে জমি দেয়ার কথা বলেন। কিন্তু আমি না দিতে চাইলে তারা জোর করে আমার জমিতে বালু ভরাট করে। আমি বাধা দিতে গেলে বলে এটা বাংলাদেশ, কোনো চিহ্ন থাকবে না। তারপরেও আমি জমি দিতে না চাইলে তা দখল করে নেয়।

একই গ্রামের ভুক্তভোগী আশুতোষ বল জানান, আমার জমি পার্কের বাউন্ডারির মধ্যে রয়েছে। এলজিইডির করা সড়ক দিয়ে আমাদের জমি ও ঘেরে যেতে হয়। কিন্তু এই সড়ক দখল করে পার্কের গেট নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে আমরা আমাদের জমি ও ঘেরে যেতে পারি না। যেতে গেলেই আমাদের বাধা ও হুমকি দেয়া হয়।

অপর ভুক্তোভোগী শংকর বল বলেন, আমি আমার জমিতে যেতে পারি না। সরকারি সড়ক দখল করে পার্কে নিয়ে গেছে। এমনকি আমার ৮০০ ফুটের মতো জায়গা দখল করেছে। এখন আমি ওই জমিতে কৃষিকাজ করতে পারি না। তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগও করতে পারিনি। আমি যদি আমার জায়গায় যেতে না পারি তাহলে ওই জায়গা কিভাবে দখলে রাখবো। এখন আমার জায়গায় আমারই যাওয়ার অধিকার নেই।

রিসোর্টের পাশের চায়ের দোকানদার ভুক্তোভোগী বাদল বল বলেন, আমার ভাইয়ের নাম প্রশান্ত বল। পৈত্রিক জমিজমা ভাগাভাগিতে আমি ও আমার ভাই জমি পাই। পার্ক করতে আমার ভাইয়ের জমি কিনতে চান বেনজীর আহমেদ। কিন্তু আমার ভাই জমি বিক্রি করতে না চাইলে জমিতে বালু ফেলা হয়। হঠাৎ দেখি আমার ভাই পরিবার নিয়ে ভারতে চেলে গেছে। একদিন ফোন দিয়ে বলে ভাই তুমিও ভারতে চলে আসো ওখানে থাকতে পারবা না।

অপর ভুক্তোভোগী লিপন বাকচি বলেন, এলজিইডির সড়কটি দখল করেছে পার্ক কর্তৃপক্ষ। এখানে গেট নির্মাণ করার ফলে এখন আমি আমার জমি ও ঘেরে যেতে পারি না। আমার জমিতে যেতে গেলে ১০০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে ভেতরে যেতে হয়। এখন এমন অবস্থা হয়েছে আমার নিজের জমিতে যেতে গেলে তাদের টাকা দিয়ে যেতে হবে।

ভুক্তোভোগী সঞ্জয় বল বলেন, পার্ক নির্মাণের পরে বেনজীর আহমেদ কতবার এসেছেন তা আমাদের জানা নেই, তবে অসংখ্য বার এসেছেন। যখন এখানে আসতেন তখন অসংখ্য পুলিশ ফোর্স থাকতো। সবশেষ ২ মাস আগে তিনি এখানে এসেছেন। আদালত সম্পত্তি ক্রোকের নির্দেশ দিলে কয়েকটি ট্রাকের মাধ্যমে পার্ক থেকে মালামাল সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এমনকি ব্যাংক লোন নিয়ে করা খামার থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে গরু।

স্থানীয়দের লাঠি পেটার বিষয়ে গোপালগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ আনিচুর রহমান বলেন, ওই এলাকায় পুলিশ লাঠিপেটা করেছে, এমন কোনো ঘটনা তাকে কেউ জানাননি। তবে পার্কে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের গোপালগঞ্জ সদর উপজেলা প্রকৌশলী এস এম জাহিদুল ইসলাম বলেন, কোনো ব্যক্তির জন্য এলজিইডি সড়ক নির্মাণ করে না। সরকারি সড়ক দখল করে ফটক নির্মাণ করে জনসাধারণের চলাচলে বাঁধা দেয়া হচ্ছে, এমন তথ্য জানা নেই। তবে অভিযোগ পেলে বিষয়টি দেখা হবে এবং সড়কটি অবমুক্ত করা হবে।

গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসক কাজী মাহবুবুল আলম বলেন, সড়ক দখলের কোনো অভিযোগ এখনো আমরা পাইনি। তবে এখন আমি বিষয়টি জানলাম। যেহেতু আদালত সম্পত্তি ক্রোকের নির্দেশ দিয়েছেন, তাই অভিযোগ পেলে আদালতে আপিল করে আদেশ পাওয়া গেলে জনস্বার্থে সড়কটি চলাচলে জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com