আনার হত্যা নিয়ে বীভৎস বর্ণনা দিলো পুলিশের হেফাজতে থাকা জিহাদ
বাংলাদেশের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে পুলিশের হেফাজতে থাকা জিহাদ হাওলাদারকে দিয়ে ঘটনার পুনর্নির্মাণ করানো হয়েছে। এছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ জানতে পেরেছে যে আজীমের পোশাক, মোবাইল ফোন কোথায় ফেলা হয়েছিল এবং লাশ থেকে খুলি আলাদা করে টুকরো করার পরে তাই-বা কোথায় ফেলে দিয়েছিল আততায়ীরা।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ জানিয়েছেন, যে তাদের সামনেই সোমবার জিহাদ পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দেয় কিভাবে হত্যা করা হয় সংসদ সদস্যকে।
তার কথায়, ‘পশ্চিমবঙ্গের সিআইডি তাকে সোমবার ঘটনার পুনর্নির্মাণের জন্য ওই ফ্ল্যাটে নিয়ে গিয়েছিল, আমরাও সেখানে ছিলাম।’
পরিচয় প্রকাশ না করে পশ্চিমবঙ্গ সিআইডির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ওই ফ্ল্যাটে যখন ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিচ্ছিল জিহাদ, তার সঙ্গে ঢাকায় ধৃত আমানুল্লাহসহ অন্যদের বয়ানে কিছু অসঙ্গতি পাওয়া যায়। সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকেই একাধিকবার ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ঢাকা আর কলকাতায় ধৃতদের মুখোমুখি জেরাও করা হয়।
এর আগে, রোববার কলকাতায় এসে সন্ধ্যা থেকে বেশ কয়েক ঘণ্টা পশ্চিমবঙ্গ সিআইডির হেফাজতে থাকা অন্যতম অভিযুক্ত জিহাদকে নিজে জেরা করেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ।
গ্রেফতার জিহাদকে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের সদর দফতর ভবানী ভবনে রাখা হয়েছে, সেখানেই চলে এই জেরা। তার আগে ঢাকার গোয়েন্দারা গিয়েছিলেন নিউ টাউনের সেই ফ্ল্যাটে, যেখানে হত্যা করা হয় বাংলাদেশের সংসদ সদস্যকে। দুই জায়গা থেকেই একাধিকবার ঢাকায় গ্রেফতারকৃতদের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলেন রশীদ।
ঘটনার পুনর্নির্মাণে যা জানা গেল
জিহাদ সোমবার ঘটনার যে বিবরণ দিয়েছে ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে, তার ওপর ভিত্তি করে জানা যাচ্ছে যে ১৩ মে দুপুর ৩টা নাগাদ দুই অভিযুক্ত ফয়সাল এবং আমানুল্লাহর সাথে ফ্ল্যাটে প্রবেশ করেন সংসদ সদস্য।
ওই ফ্ল্যাটটি ডুপ্লেক্স, অর্থাৎ ফ্ল্যাট হলেও তার ভেতরেই দুটি তলা রয়েছে।
দুই অভিযুক্ত আজীমকে নিয়ে ফ্ল্যাটে ঢোকার সময়ে তৃতীয় অভিযুক্ত সেলেস্তি রহমান ওপরের তলায় ছিল, আর নিচের অংশেরই ভেতরের একটি ঘরে ছিল জিহাদ এবং সিয়াম।
জিহাদ পশ্চিমবঙ্গ সিআইডির হাতে ধরা পড়লেও সিয়াম পলাতক। তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন সে সম্ভবত নেপালে পালিয়েছে।
জিহাদের দেয়া বর্ণনা অনুযায়ী ফ্ল্যাটে প্রবেশের পরেই ক্লোরোফর্ম ভেজানো কাপড় আজীমের মুখে চেপে ধরা হয় এবং তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। এরপর শ্বাসরোধ করে তাকে হত্যা করা হয় ফ্ল্যাটের রান্নাঘর-সংলগ্ন জায়গায়।
সিআইডির ওই কর্মকর্তা বলছিলেন, ‘ফ্ল্যাটের যে হলঘর, অর্থাৎ বসার এবং খাওয়ার জায়গা, সেখানে একটি সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো আছে। সেটি খুনের আগে, ৭ মে দুপুর নাগাদ সেলেস্তি রহমান কাপড় আর লিউকোপ্লাস্ট দিয়ে ঢেকে দেন।’
অভিজাত ফ্ল্যাটগুলোতে সাধারণত ঘরের কাজ করেন যারা, তাদের ওপরে নজরদারির জন্য এ ধরনের সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়।
ওই সিসিটিভি-র ফুটেজ কার কাছে আছে, তা এখনো স্পষ্ট নয়।
লাশ লোপাটের ব্যবস্থা
খুনের পরে কিভাবে লাশ লোপাট হবে, তাও আগে থেকেই ঠিক করা ছিল বলে গ্রেফতারকৃতরা আগেই ঢাকা এবং পশ্চিমবঙ্গ পুলিশকে জানিয়েছিল।
সোমবার জিহাদ যে বর্ণনা দেয়, তাতে জানা যাচ্ছে যে রান্নাঘর-সংলগ্ন জায়গায় হত্যা করার পরে জিহাদ আজীমের লাশ থেকে চামড়া ছাড়িয়ে নেয় ও হাড় এবং মাংস পৃথক করে ফেলে। শরীর থেকে কেটে ফেলা হয় মাথাও।
দেহের মাংস আর মাথার খুলি টুকরোও করে জিহাদই।
এই কাজে জিহাদ চপার জাতীয় ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করেছিল বলে সিআইডিকে জানিয়েছে। ওই অস্ত্র স্থানীয়ভাবে কিনে এনেছিল আমানুল্লাহ।
দেহের টুকরোগুলো ছোট ছোট প্যাকেটে ভরে ফেলা হয়।
ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তা মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ পরে বলছিলেন, ‘আমরা ওই বাড়িতে দাঁড়িয়ে বর্ণনা শুনলাম যে কীভাবে মাননীয় সংসদ সদস্যকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। শুধু হত্যা করা হয়নি, লাশটাকে যাতে গুম করা যায়, তার জন্য শুনলাম কীভাবে শরীর থেকে মাংস আলাদা করা হয়েছে।’
‘একজন পুলিশ অফিসার হিসেবে আমি ওই বর্ণনা শুনে মানতে পারছিলাম না যে এতটা নিষ্ঠুর, এত পাষাণ তারা!’ বলছিলেন রশীদ।
প্রমাণ লোপাটের জন্য আরেকটি কাজ করেছিল আততায়ীরা।
সোমবার জিহাদের দেয়া বর্ণনা অনুযায়ী ফ্ল্যাটে ঢোকার আগে তিনজনই বাইরে জুতা রাখার ক্যাবিনেটে নিজেদের জুতা খুলে প্রবেশ করেছিলেন।
কিন্তু ওই ফ্ল্যাটের প্রবেশপথে নজরদারি রাখার জন্য যে সিসিটিভি আছে, তার ফুটেজ থেকে তদন্তকারীরা দেখতে পেয়েছিলেন যে ১৩ মে বিকেল ৪টা নাগাদ তারা ফ্ল্যাটের দরজা খুলে জুতাগুলো ভেতরে সরিয়ে নিচ্ছে।
জিহাদ সোমবার সেই ঘটনারও বর্ণনা দিয়েছে।
আজীমের পোশাক কোথায় গেল?
সিআইডির ওই অফিসার বলছেন, ‘ঘটনার পুনর্নির্মাণের সময়ে জিহাদ জানিয়েছে যে সে জীমের টুকরো করা দেহাংশ ভর্তি প্যাকেটগুলো নিয়ে রওনা হয় ভাঙ্গরের কৃষ্ণমাটি সেতুর দিকে। তার সঙ্গে আরো ছিল লাশ টুকরো করার অস্ত্র এবং আনোয়ারুল আজীমের পোশাক এবং মোবাইল।
ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, ‘মোবাইল এবং মি. আজীমের পোশাক সে ফেলে দেয় নিউ টাউন থেকে কৃষ্ণমাটি সেতুর দিকে যাওয়ার পথে গাবতলা বাজার নামে একটি জায়গায়। সেখানেও বাগজোলা খালই বইছে।’
সিআইডি এবং ঢাকার ডিবি প্রধানের সামনে জিহাদ জানিয়েছে যে সেখান থেকে আরও এগিয়ে গিয়ে কৃষ্ণমাটি সেতুর কাছে একটি বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে নিচে নেমে দেহাংশ ভরা প্যাকেটগুলো খালের পানিতে ফেলে দেয় সে। সঙ্গে লাশ টুকরো করার কাজে ব্যবহৃত চপারটিও।
ওই জায়গাতেই তিন দিন ধরে ডুবুরি আর নৌকা নামিয়ে তল্লাশি চালাচ্ছে সিআইডি।
সোমবার সেখানেও গিয়েছিলেন রশীদসহ পশ্চিমবঙ্গ সিআইডির একটি দল।
সেখানে সাংবাদিকদের তিনি জানান, ‘জিহাদকে নিয়ে আমরা খালের পাড়ে এসেছি। কোন জায়গায় তারা লাশটাকে ফেলেছিল সেটা আমরা দেখছি। এবং কীভাবে এটা উদ্ধার করা যায়, তা নিয়ে আমরা মিটিংও করেছি। আমরা মনে করি দ্রুতই আমরা দেহ অথবা দেহের অংশবিশেষ আমরা উদ্ধার করতে পারব।’
একদিকে যখন জিহাদ দেহাংশের টুকরো, অস্ত্র, মোবাইল এবং পোশাক নিয়ে ভাঙ্গরের দিকে রওনা হলো, তখন অন্য একটি রাস্তা ধরে আরেক অভিযুক্ত ফয়সাল, এমনটাই জানাচ্ছেন তদন্তকারীরা।
তারা এটা জেনেছেন যে উত্তর ২৪ পরগনারই শাসন অঞ্চলে মাথার খুলির টুকরোগুলো ফেলে দেয়া হয়েছিল।
অর্থাৎ, মোট তিনটি জায়গায় আলাদাভাবে লাশ লোপাট করা হয়েছে, সরিয়ে ফেলা হয়েছে অন্যান্য প্রমাণও।
আবার আনোয়ারুল আজীমের ভারতীয় মোবাইলটি নিয়ে বিহার হয়ে নেপালের পথে রওনা হয়েছিল আরেক অভিযুক্ত সিয়াম। সেই সিমটি কয়েকবার অ্যাক্টিভেটও করেছিল সে এবং সেখান থেকে কলকাতায় আজীমের বন্ধু গোপাল বিশ্বাসকে কয়েকবার মেসেজ পাঠায়, বাংলাদেশেও সংসদ সদস্যর সহায়কের কাছে ফোন করে একবার।
আনোয়ারুল আজীম নিখোঁজ হওয়ার পরে তার মোবাইল নম্বর ট্র্যাক করতে গিয়ে মুজফ্ফরপুরে লোকেশন খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল বলে কলকাতায় বাংলাদেশ উপ-দূতাবাসের এক কর্মকর্তা বিবিসিকে আগেই জানিয়েছিলেন, তখনো তার খুন হওয়ার খবর জানা ছিল না কারও।
তদন্তকারীরা বলছেন, এটাও সম্ভবত খুনের মূল পরিকল্পনারই অংশ ছিল, যাতে আজীমের পরিবার এবং বন্ধুরা বুঝতেই না পারেন যে তিনি নিরুদ্দেশ। সুচারুভাবে পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করে যাতে পালিয়ে যেতে পারে, তার জন্য সময় নিচ্ছিল তারা।
সূত্র : বিবিসি