জাতিসংঘের আদালতে ‘ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার মামলার শুনানি শুরু
জাতিসংঘের শীর্ষ আদালত ‘ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গাজা যুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ এনে এবং রাফা অভিযানের ওপর জরুরি স্থগিতাদেশ’ চেয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার করা মামলার শুনানি আবার শুরু করেছে।
ইসরায়েল এ মামলাকে ‘সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন’ এবং ‘নৈতিকতা বিরোধী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। শুক্রবার তাদের বক্তব্য উপস্থাপনের কথা রয়েছে।
দক্ষিণ আফ্রিকা এ মামলাটি করার পর ‘দ্য ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস’ (আইসিজে) শব্দগুলো নিয়ে ব্যাপক পর্যালোচনা হচ্ছে, বিশেষ করে রুলিংয়ে ‘বিশ্বাসযোগ্য’ শব্দের ব্যবহার নিয়েই মূল আলোচনা হচ্ছে।
গত জানুয়ারিতে আইসিজে একটি অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দিয়েছিল এবং সেখানে একটি অংশ সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। সে অংশটি হচ্ছে – আদালতের দৃষ্টিতে, তথ্য উপাত্ত ও পরিস্থিতি- দক্ষিণ আফ্রিকার অন্তত কিছু দাবির বিষয়ে সমাপ্তি টানতে যথেষ্ট এবং এ জন্য সুরক্ষা চাওয়ার বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্য।
পরে কিছু আইনবিদ এর নানা ব্যাখ্যা করেন। কেউ কেউ বলেন যে গাজায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার যে অভিযোগ সেটিকেই ‘বিশ্বাসযোগ্য’ বলেছে আদালত। এই ব্যাখ্যা দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে। জাতিসংঘের প্রেস বিজ্ঞপ্তি, বিভিন্ন অধিকার সংস্থাগুলোর বিবৃতি এবং বিবিসিসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে।
আদেশ দেওয়ার সময় আইসিজের প্রেসিডেন্ট ছিলেন জোয়ান ডনোঘেউ। বিবিসিকে তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আদালতে আসলে তার রুলিংয়ে তা বলেনি।
বরং তিনি বলেন, ওই রুলিংয়ের উদ্দেশ্য ছিল এটা ঘোষণা করা- ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মামলার অধিকার দক্ষিণ আফ্রিকার আছে এবং ফিলিস্তিনিদের ‘গণহত্যা থেকে সুরক্ষার বিশ্বাসযোগ্য অধিকার’ আছে, যে অধিকার অপূরণীয় ক্ষতির ঝুঁকিতে ছিল।
বিচারকরা জোর দিয়েছিলেন যে, তাদের এখনই বলার দরকার নেই গণহত্যা হয়েছে কিংবা না। তবে সমাপ্তি টেনেছেন এভাবে, দক্ষিণ আফ্রিকার কিছু অভিযোগ প্রমাণ হলে তা জাতিসংঘের গণহত্যা বিষয়ক কনভেনশনের আওতায় পড়তে পারে।
এখন দেখা যাক মামলার ব্যাকগ্রাউন্ড এবং কিভাবে আইনি বিতর্কের নিষ্পত্তি হয়েছিল। আইসিজে মূলত তৈরি হয়েছিল দেশগুলোর মধ্যে আন্তর্জাতিক আইনের সাথে সম্পর্কিত বিরোধগুলো নিয়ে কাজ করার জন্য।
এর মানে হলো- সদস্য দেশগুলো যেসব আইনের বিষয়ে একমত হয়েছে যেমন গণহত্যা কনভেনশন, একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল যাতে করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যেভাবে গণহত্যা হয়েছিল তার পুনরাবৃত্তি যেন আর না হতে পারে।
গত ডিসেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকা আইসিজেতে প্রমাণের পদক্ষেপ নেয় যে তাদের দৃষ্টিতে ইসরায়েল গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে যেভাবে যুদ্ধ করেছে তাতে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে।
দেশটির অভিযোগ, ইসরায়েল যেভাবে যুদ্ধ বাস্তবায়ন করেছে তা ‘বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে গণহত্যা’ কারণ, দক্ষিণ আফ্রিকার মামলা অনুযায়ী, সেখানে ইসরায়েলের লক্ষ্য ছিল ‘গাজায় ফিলিস্তিনিদের ধ্বংস করে দেওয়া’।
ইসরায়েল এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা বলেছে, মাঠে যা ঘটেছে তার বিভ্রান্তিকর উপস্থাপন করা হয়েছে এই মামলায়।
গণহত্যার বিষয়ে দক্ষিণ আফ্রিকাকে পরিষ্কার ও শক্ত প্রমাণ আদালতে দিতে হবে। ইসরায়েলের এসব অভিযোগ পর্যালোচনার অধিকার থাকবে এবং তাদের যুক্তি থাকবে হামাসের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার আইনগত অধিকার বিষয়ে। ডজনেরও বেশি দেশ তাদের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
এই পুরো বিষয়ের প্রস্তুতি ও যুক্তিতর্কে কয়েক বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। সে কারণেই দক্ষিণ আফ্রিকা বিচারকদের একটি ‘অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপ’ নেওয়ার অনুরোধ করেছিল।
আইসিজের টার্ম অনুযায়ী ‘আদালতের আদেশ’ হলো আদালতের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগে আরও ক্ষতি যেন না হয় বা পরিস্থিতির যেন আর অবনতি না হয় সেজন্য একটি আদেশ। আদালত যেন ‘ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকারের আরও মারাত্মক ও অপূরণীয় ক্ষতি’ থেকে সুরক্ষার জন্য ইসরায়েলকে আদেশ দেয় সেই অনুরোধ করা হয়েছে।
দুই দিন ধরে দুই দেশের আইনজীবীরা তর্কবিতর্ক করছেন, গাজার ফিলিস্তিনিদের সেই অধিকার আছে কি না যা আদালতের সুরক্ষা দেওয়া দরকার। পরে সতের জন বিচারক গত ২৬ জানুয়ারি (কেউ কেউ ভিন্নমত পোষণ করেছেন) তাদের রুলিং দিয়েছেন।
আদালত বলেনি, ইসরায়েলি গণহত্যা করেছে কি-না। কিন্তু তারা যে শব্দ প্রয়োগ করেছে তাতে এমনটা মনে হয়েছে কি না যে এ বিষয়টি তারা অনুধাবন করতে পেরেছেন- এ প্রশ্ন উঠছে।
এপ্রিলে প্রায় ছয়শ ব্রিটিশ আইনজীবী দেশটির প্রধানমন্ত্রীর কাছে লেখা চিঠিতে ইসরায়েলের কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধের দাবি জানিয়েছে। চিঠিতে তারা ‘গণহত্যার বিশ্বাসযোগ্য ঝুঁকির’ কথা উল্লেখ করেছে।
পরে এর পাল্টা দিয়েছে ইউকে লইয়ার্স ফর ইসরায়েল। ১৩০০-সদস্যের শক্তিশালী এই গ্রুপটি বলেছে, আইসিজে শুধু তাদের রুলে বলেছে গণহত্যা থেকে সুরক্ষার বিশ্বাসযোগ্য অধিকার গাজার ফিলিস্তিনিদের আছে।