বর্তমান সরকার আমলে গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেছে।
ঢাকা সিটি করপোরেশনে নির্বাচিত মেয়ররা মাত্র পাঁচ থেকে সাত শতাংশ মানুষের ভোট পেয়েছে এবং বাকিটা জাল ভোট বলে দাবি করেছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন। গতকাল মঙ্গলবার মতিঝিলে নিজের আইনি চেম্বারে ফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে তিনি এ দাবি করেন।
সরকারবিরোধী প্রধান এই রাজনৈতিক জোটের শীর্ষ নেতা ড. কামাল বলেন, ‘ঢাকার দুই সিটিতে ক্ষমতাসীন দলের মেয়র প্রার্থীরা যত ভোটে বিজয়ী হয়েছেন, তার মধ্যে সর্বোচ্চ সাত শতাংশ বাদে বাকিটা জাল ভোট।’ তিনি বলেন, ‘নির্বাচিত মেয়ররা মাত্র পাঁচ থেকে সাত শতাংশ মানুষের রায় পেয়েছে। বাকি ফল ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) জাল ভোট। বর্তমান সরকার আমলে গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেছে। এই সরকার চায় ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে না যাক, তারা ভোটারদের ভয় পায়।’
গত ১ ফেব্রুয়ারির ঢাকা সিটির নির্বাচনে উত্তরে ভোট পড়েছে ২৫ দশমিক ৩০ শতাংশ ও দক্ষিণে ২৯ দশমিক ০২ শতাংশ। গড়ে দুই সিটিতে ভোট পড়েছে ২৭ দশমিক ১৫ শতাংশ। ক্ষমতাসীন দলের দুই মেয়র প্রার্থী মাত্র ১৫-১৭ শতাংশ জনসমর্থন মেয়র হয়েছেন। ঐক্যফন্টের প্রধান শরিক বিএনপি নির্বাচনের এ ফল প্রত্যাখ্যান করে হরতালও করেছে।
ঐক্যফন্টের আহ্বায়ক ড. কামাল আরও বলেন, ‘সিটি নির্বাচনে দেশের জনগণ ও যুবসমাজ সরকার, নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন প্রক্রিয়ার ওপর অনাস্থা প্রকাশ করেছে। জনগণ ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার অর্থ তারা মনে করে তাদের ভোটেই এই সরকারের পরিবর্তন হবে না। এটা দেশ ও জাতির জন্য একটি অশনিসংকেত।’
ঢাকার সদ্য নির্বাচিত দুই মেয়রকে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের মেয়র বলা যাবে কি না এমন প্রশ্নে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘তাদের এটা মোটেই বলা যাবে না, এটা মোটেই বলা যাবে না।’
৮ ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদ সমাবেশ: সংবাদ সম্মেলনে ড. কামালের পক্ষে লিখিত বক্তব্যে গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট মহসীন রশীদ আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার দুই বছর কারাবাসের প্রতিবাদে ও তার মুক্তির দাবিতে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে প্রতিবাদ সমাবেশ করার ঘোষণা দেন। ওদিন বেলা ১১টায় এই সমাবেশ হবে।
প্রশ্নবাণে জর্জরিত ফ্রন্ট নেতারা : সংবাদ সম্মেলন শেষে প্রশ্নোত্তর পর্বে সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের মুখে পড়েন ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির নেতারা। শুরুতে এক সাংবাদিক বলেন, সভা, সংবাদ সম্মেলন ছাড়া রাজনৈতিক দলের কর্মসূচির মতো কোনো কর্মসূচিতে ঐক্যফ্রন্টের দেখা পাওয়া যায় না। জোট কি ব্যর্থ? এমন প্রশ্নের জবাবে ঐক্যফ্রন্ট নেতারা বলেন, জনগণই এগিয়ে আসবে।
রাজনৈতিক দলের যে সভা, সমাবেশ তা এই জোটের দেখা যায় না। শুধু সচেতনতা তৈরি করে যাচ্ছেন। জনগণের ওপরেই কেন সব দায়িত্ব ছেড়ে দিচ্ছেন? রাজনৈতিক দল হিসেবে তো নেতাদেরও মাঠে থাকার কথা। এ প্রশ্নের জবাবে কামাল হোসেন বলেন, ‘জনগণের ওপর ভর করেই রাজনীতি। শক্তি জনগণের। তাদের উৎসাহী করতে আমাদের করণীয় অবশ্যই করে যাব। সভা, মিছিল, মিটিং সবই হবে।’ তিনি বলেন, ‘জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের লক্ষ্য অর্জন করেছে, পরিবর্তন এনেছে। তার ব্যতিক্রম হবে না। জনগণের মধ্যে একটা ঐকমত্য গড়ে উঠেছে। জনগণ এগিয়ে আসবে। সরকার যা চাইছে, তা করতে পারবে না।’ একই প্রশ্নের জবাবে ড. কামাল হোসেনকে সহায়তায় এগিয়ে যান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান। বলেন, ‘আমরা জনগণের ওপর দায়িত্ব ছেড়ে দেইনি। জনগণ সব ক্ষমতার মালিক। সে কারণেই আমরা জনগণের ওপর আস্থা রেখেছি। কিন্তু সরকার জনগণের আস্থা কেড়ে নিয়েছে, ভোট কেড়ে নিয়েছে। আমরা জনগণকে দায়িত্ব দিয়েছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা জনগণের কাতারে আছি। বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে বিশ্বাস করে।’ ‘২০১৮ সাল থেকেই জনগণের কথা বলে আসছে ঐক্যফ্রন্ট। এই জোটের প্রতি মানুষের আশার জায়গা কোনটা এই প্রশ্নের জবাবে ফ্রন্টের আহ্বায়ক বলেন, ‘জনগণের ওপর আমরা পুরোপুরি ভরসা রাখি। ঐক্যবদ্ধ হয়ে জনগণ নিজের পরিবর্তন এনেছে। ঐতিহাসিক ৬ দফা, স্বাধীনতা আন্দোলন ও ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় জনগণই এগিয়ে এসেছে। এ দেশের মানুষ সচেতন, তারা স্বৈরতন্ত্রকে কোনো দিন গ্রহণ করেনি, এখনো করবে না।’
‘মানুষের মুক্তির জন্য ঐক্যফ্রন্ট কী করছে; এমন প্রশ্নে কামাল হোসেন বলেন, ‘আমরা মানুষের কাছে যাচ্ছি। আমরা বলে যাচ্ছি। সরকার দায়িত্বহীনভাবে সংবিধানের পরিপন্থী কাজ করে নির্বাচনের প্রক্রিয়া ধ্বংস করেছে। এর ফলেই আজকে ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।’ তবে তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘মানুষ একদিন অসহ্য হয়ে এর পরিবর্তন আনবে।’
জনগণ আপনাদের সঙ্গে আছে কি না এমন প্রশ্নে মঈন খান বলেন, ‘জনগণ পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সঙ্গে ছিল।’
‘ঐক্যফ্রন্ট দুই প্রার্থীকে সমর্থন দিল, কিন্তু সেই নির্বাচনে মাঠে থাকতে তারা ব্যর্থ কি না? এতে সাংগঠনিক দুর্বলতা প্রকাশ পায় কি না? এ ছাড়া চারটি পথসভার ঘোষণা দিলেও তা হয়নি? এসব কি ব্যর্থতা না? এসব প্রশ্নে ড. কামাল বলেন, ‘আমাদের কাজগুলোকে জোরদার করতে হবে। জনগণকে নিয়ে পরিবর্তন আনতে আমরা বাধ্য। এভাবে দেশ চলতে পারে না।’ সাংবাদিকদের এসব প্রশ্নে জর্জরিত কামাল হোসেন ও মঈন খানকে সহযোগিতা করতে এগিয়ে যান ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি বলেন, এখন থেকে মাঠে দেখা যাবে। খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলন ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে কি যথাযথ কর্মসূচি দিতে পেরেছে ঐক্যফ্রন্ট- এ প্রশ্নে জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেন, ‘রাজনৈতিক দলের কাজ হচ্ছে নির্দেশনা দেওয়া। কার্যকর করবে জনগণ।’
বৈঠকে আর ছিলেন গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য মোহসীন রশীদ, নাগরিক ঐক্যের সমন্বয়কারী শহিদুল্লাহ কায়সার, বিকল্পধারা বাংলাদেশের একাংশের চেয়ারম্যান নুরুল আমিন বেপারী প্রমুখ।