‘সাংবাদিক মারলে কিছু হয় না’
বাংলাদেশে সাংবাদিকদের উপর হামলা দিনদিন বেড়ে চলছে৷ শনিবার সিটি নির্বাচনের দিন কমপক্ষে চারজন সাংবাদিক হামলার শিকার হন। নির্বাচনের পরের দিন রোববার দু’জন সাংবাদিকের ওপর হামলা হয়েছে। এসব ঘটনায় জড়িত কাউকেই এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার বা আইনের আওতায় আনা হয়নি।
গেন্ডারিয়া এলাকায় নির্বাচনের দিন সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে হামলার শিকার হন বাংলাদেশ প্রতিদিনের এক সাংবাদকর্মীসহ তিন সাংবাদিক। মোহাম্মদপুরে আরেক সাংবাদিককে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে দুর্বৃত্তরা। গেন্ডারিয়ার ঘটনায় হামলাকারীরাই থানায় জিডি করেছে। অবশ্য এরইমধ্যে হামলায় নেতৃত্ব দেয়া ছাত্রলীগ নেতা শহীদুল আলম রিয়াদকে ছাত্রলীগ বহিস্কারের কথা জানিয়েছে৷ তবে পুলিশ তাকে এখনো গ্রেপ্তার করেনি।
নির্বাচনের পরের দিন রোববার বাড্ডার বেরাইদ এলাকায় নির্বাচনী সহিংসতার খবর সংগ্রহ করতে যান মাছরাঙা টেলিভিশনের প্রতিবেদক ও ক্যামেরাপার্সন৷ এসময় সেখানে তাদের ওপর হামলা হয়। নব নির্বাচিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর আইউব আনছারের সমর্থকরা এর সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে।
সাংবাদিকদের ওপর এমন হামলা এবং প্রতিকার না পাওয়া বাংলাদেশে এখন সাধারণ ঘটনায় পরিনত হরেছে। মাছরাঙা টেলিভিশনের হেড অব নিউজ রেজোয়ানুল হক বলেন, ‘‘সাংবাদিকদের ওপর শুধু হামলা নয়, তাদের বিভিন্ন সময় হত্যাও করা হয়েছে। কোনো অপরাধী চক্র বা দুর্নীতিবাজ চক্রের বিরুদ্ধে যখনই কেউ কাজ করতে গিয়েছে, হয় তারা লাঞ্ছিত হয়েছেন নয়তো জীবন দিতে হয়েছে। এইসব ঘটনার কখনই কোনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি। ফলে অন্যরাও সাংবাদিক নির্যাতনে উৎসাহিত হয়েছে। আজকেও (মঙ্গলবার) আওয়ামী লীগের ওবায়দুল কাদের সাহেব বলেছেন, ইলেকশনের দিন যা ঘটেছে তা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। তাহলেতো অন্যরা উৎসাহিত হবে, ভাববে এর কোনো বিচার হবে না।”
তিনি বলেন, ‘‘অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এইসব হামলার সঙ্গে যারা জড়িত তারা সরকারের বা সরকারি দলের মদদপুষ্ট। আর এর বিচার হয় না বলেই সাংবাদিকদের ওপর হামলা নির্যাতন থামছে না।”
এসব নির্যাতনে জোরালো কোনো প্রতিবাদ হয় না৷ সাংবাদিকদের নিজেদের মধ্যেই রয়েছে নানা বিভক্তি। কিছু সাংবাদিকদের দলীয় আচরণ এবং অসততাও এই পেশাকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে বলেও মনে করা হয়৷ এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নঈম নিজাম বলেন, ‘‘এটা একটা দুঃখজনক পরিস্থিতি। বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ওপর হামলা হলে, নির্যাতন হলে কোনো বিচার হবে না। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নিরব ভূমিকা পালন করবে। সাংবাদিকরাও কোনো প্রতিবাদ করবে না। এইরকম একটা আস্কারা থেকেই একটার পর একটা সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে।”
তিনি বলেন, ‘‘বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে প্রভাবশালী বলেন অথবা পাড়ার মাস্তান বলেন, তারা মনে করে সাংবাদিক মারলে কিছু হয় না।”
‘বাংলাদেশে ধারণা জন্মেছে যে সাংবাদিকদের ধরা যায়, মারা যায়’
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসেবে, ২০১৯ সালে ১৪২ জন সাংবাদিক, হামলা, মামলা বা গ্রেপ্তারের শিকার হয়েছেন। এরমধ্যে ২৩টি ঘটনায় সরাসরি সরকারি দলের লোকজন জড়িত। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী জড়িত ছয়টি ঘটনায়। পাশাপাশি ৫৭টি মামলা হয়েছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে।
মুক্ত গণমাধ্যমের বৈশ্বিক সূচকেও বাংলাদেশ রয়েছে তলানীতে৷ আরএসএফ-এর প্রেস ফ্রিডম ইনডেস্কে বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫০তম।
সংবাদমাধ্যম ও বাক স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করে ‘আর্টিক্যাল নাইনটিন’ । প্রতিষ্ঠানটির বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুক ফয়সাল বলেন, ‘‘আমি এখন জামালপুরে আছি। একজন সাংবাদিক তার ওপর হামলা হওয়ায় মামলা করেছিলেন। এখন সেই মামলার একজন সাক্ষিকে মেরে তার দুই পা ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে যাতে তিনি সাক্ষি দিতে যেতে না পারেন। তিনি এখন ঢাকার একটি হাসপাতালে ভর্তি আছেন। এখানকার ৪৩ জন সাংবাদিক একসঙ্গে জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে থানায় জিডি করেছেন। সিলেটেও ৬৫ জন সাংবাদিক জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে জিডি করেছেন। সরকারি দলের সঙ্গে জড়িত মাফিয়া এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুলিশ, প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সফট টার্গেটে (সহজ লক্ষ্যে) পরিণত হয়েছেন সাংবাদিকরা। তারা মনে করেন সাংবাদিকদের ধরে পিটিয়ে মারলে কিছু হয় না।”
তিনি এর কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন, বাংলাদেশে বিচারহীনতার একটা সংস্কৃতি চলছে। এতে ধারণা জন্মেছে যে সাংবাদিকদের ধরা যায়, মারা যায়। প্রশাসনের মধ্যেও এই ধারণা হয়তো।