ইউরোপে মানবাপাচারের নতুন রুট হিসেবে নেপালকে ব্যবহার করছে পাচারকারী চক্র
ভ্রমণ করার জন্য নেপাল যেতে আগে থেকে ভিসা নিতে হয় না। অন অ্যারাইভাল ভিসা নিয়ে নেপালে যাওয়া যায় সহজেই। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ইউরোপে মানবাপাচারের নতুন রুট হিসেবে নেপালকে ব্যবহার করছে পাচারকারী একাধিক চক্র। সম্প্রতি এই প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে কাঠমুন্ডুর বাংলাদেশ দূতাবাস। দূতাবাসের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এ সংক্রান্ত একটি চিঠির প্রেক্ষিতে নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। মন্ত্রণালয় থেকে মানবপাচারের এই রুট বন্ধ ও মানবপাচারকারীদের ধরতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, একটি সংঘবদ্ধ দালালচক্রের কাছে বাংলাদেশি নাগরিকরা প্রতারণার শিকার হয়ে সর্বস্বান্ত হবার ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। বাংলাদেশের কুমিল্লা ও নোয়াখালী অঞ্চলে সক্রিয় এই সংঘবদ্ধ চক্রটি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে ভিসা দেওয়ার নাম করে টুরিস্ট হিসেবে নেপালে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের আটকে রেখে পাসপোর্ট ছিনিয়ে নিয়ে বন্দি করে রাখার ঘটনাও ঘটছে। বন্দি অবস্থায় ভিকটিমদের নির্যাতন করে পরিবারের কাছ থেকে অর্থ আদায়ও করে তারা।
সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ এ বিষয়ে বৈঠকও করেছে। ওই বৈঠকে সুরক্ষা সেবা বিভাগের উপ-সচিব (বহিরাগমন-১) জানান, গত বছরের ১৪ ও ২৮ নভেম্বর দুই দফায় ১১ জন বাংলাদেশিকে রোমানিয়া নিয়ে যাওয়ার কথা বলে কাঠমুন্ডুতে নেওয়া হয়। তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে দালালচক্রের সদস্যরা অগ্রীম ৫ লাখ টাকা করে নেয়। পরে তাদেরকে একটি হোটেলে আটকে রেখে অস্ত্রের মুখে ভয়ভীতি ও নির্যাতন করে আরও ৩ লাখ টাকা করে হাতিয়ে নেয় পাচারকারীরা। জোবায়ের নামে এক ব্যক্তি এই চক্রের মূল হোতা বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই সভায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে নেপালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সালাউদ্দিন নোমান চৌধুরী বলেন, ‘এই প্রক্রিয়ায় ভিসা সংগ্রহ করে ইউরোপে যাওয়া সম্ভব হলেও পরিণামে তা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তাছাড়া এটা দেশের ভাবমূর্তির জন্যও অবমাননাকর। নেপালে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের ভিসার জন্য একধরনের লোক আসে, যারা পরবর্তীকালে আফ্রিকা হয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রবেশের চেষ্টা করে। দালালচক্রের সদস্যরা ভিসা প্রত্যাশীদের ট্যুরিস্ট ভিসায় নেপালে আনার পর ৩-৪ মাস আটকে রাখে। পরবর্তী সময়ে ৫-৭ লাখ টাকা খরচ করে কিছু কিছু ক্ষেত্রে কিছু এজেন্সির যোগসাজশে তাদের ক্রোয়েশিয়ায় পাঠায়। সেখানে কাজ করার সুযোগ সীমিত হওয়ায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রবেশের চেষ্টা করে চাকরি প্রত্যাশীরা। এতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি নাগরিকদের প্রবেশাধিকার খর্ব হচ্ছে।’
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব শাহানারা খাতুনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই সভায় দালালচক্রের মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নিরীহ নাগরিকদের পাচারের অপচেষ্টা ও ঝুঁকির বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সবাইকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। বাংলাদেশ ও নেপালসহ অন্যান্য দেশে অবৈধ অভিবাসনের সঙ্গে জড়িত দালালচক্রকে দ্রুত গ্রেফতার এবং তাদের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে জরুরি আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। একইসঙ্গে নেপালে ভ্রমণকারী সংশ্লিষ্ট সবার উদ্দেশ্য ও ডকুমেন্টস সতর্কতার সঙ্গে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য ইমিগ্রেশন বিভাগকে নির্দেশনা দেওয়া হয়। তবে এজন্য সাধারণ যাত্রীরা যাতে হয়রানির শিকার না হন, সেজন্যও সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তা জানান, ইতোমধ্যে নেপালকে রুট হিসেবে ব্যবহার করা মানবপাচারকারী চক্রের হোতাদের শনাক্ত করতে নজরদারি করা হচ্ছে। একইসঙ্গে ইমিগ্রেশন পুলিশ নেপালে ভ্রমণ ভিসায় যারা যাচ্ছেন, তাদের বিষয়েও সতর্কভাবে গমনাগমনের বিষয়গুলো দেখভাল করা হচ্ছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, ইউরোপে মানবপাচারকারী চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রুট ব্যবহার করে মানবপাচার করে আসছে। নেপাল ছাড়াও দুবাইয়ে ভ্রমণ ভিসায় নিয়ে লিবিয়া হয়ে সাগর পথে পাচার করা হচ্ছে নিয়মিত। বিভিন্ন সময়ে এসব চক্রের সদস্যদের গ্রেফতারও করা হচ্ছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ সবেচতন না হলে মানবপাচার পুরোপুরি বন্ধ করা যাবে না।