সীমান্তে সব ইউরোপীয় পণ্যে তল্লাশির পরিকল্পনা ব্রিটেনের
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে ভবিষ্যতের আলোচনার জন্য শুরুতেই কঠোর অবস্থান স্পষ্ট করেছে ব্রিটেন। দেশটি বলেছে, বিরোধহীন একটি বাণিজ্যচুক্তি নিশ্চিত করার জন্য এটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিধিনিষেধ মেনে চলার পরিবর্তে নিজস্ব এজেন্ডা নির্ধারণ করবে। গত শুক্রবার ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বেরিয়ে আসার পর বছরের শেষের দিকে মধ্যবর্তী সময়সীমা শেষ হয়ে গেলে বিচ্ছেদ কার্যকর হওয়ার জন্য ব্রিটেনকে এখন অবশ্যই ইইউ ব্লকের সাথে ভবিষ্যতের বাণিজ্য সম্পর্ক আলোচনা করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের সরকার মার্চ মাসে বাণিজ্য আলোচনা শুরুর আগে ব্রাসেলসকে একটি বার্তা প্রেরণে তৎপর হয়ে উঠেছে। ব্রেক্সিট জনসনের কাছে যে অর্থ বহন করে তা হলো- ‘সার্বভৌমত্বই অর্থনীতির চালিকাশক্তি’। এতে বোঝা যাচ্ছে ব্রাসেলসের সাথে বাণিজ্যচুক্তি করার সময় ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের আইন-কানুন গ্রহণ করবে না। আজ সোমবার প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বাণিজ্য আলোচনার আগে তার অবস্থানকে আরো দৃঢ় করার জন্য একটি ভাষণ দেবেন। ইইউর প্রধান আলোচক মিশেল বার্নিয়ারও আলোচনার বিষয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করবেন, যা আগামী মাসে শুরু হতে যাচ্ছে।
আজকের বিস্তারিত ভাষণে জনসন ইউরোপীয় ইউনিয়নকে বলবেন যে, তিনি যদি নিজের চাওয়া মতো একটি বাণিজ্যচুক্তি নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হন তাহলে ব্রিটেনের সীমান্তে সব ইউরোপীয় ইউনিয়নের পণ্যে সম্পূর্ণ শুল্ক ও সীমান্ত পরীক্ষা আরোপে প্রস্তুত তার সরকার। সরকারি এক শীর্ষ কর্মকর্তার বরাত দিয়ে টেলিগ্রাফ জানিয়েছে, ‘আমরা সব ইইউর আমদানি-রফতানি ঘোষণার ওপর সীমান্তে সম্পূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরিকল্পনা করছি।’
গতকাল রোববার স্কাই নিউজকে ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডমিনিক র্যাব বলেন, ‘ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিধিবিধানের সাথে ব্রিটেনের ‘উচ্চ প্রান্তিককরণ’ থাকবে না।’ ‘তিনি বলেন, প্রান্তিককরণের বিষয়টি আলোচনার টেবিলেও আসবে না।’ প্রধানমন্ত্রীর পরিকল্পনার প্রতিক্রিয়ায় ছায়া স্বাস্থ্যমন্ত্রী জোনাথন অশ্বওয়ার্থ বলেছেন, ‘আমরা পরিবেশের মান বা কর্মক্ষেত্রের অধিকারকে কোনোভাবেই তলানিতে দেখতে চাই না।’
এ দিকে ভারপ্রাপ্ত লিবারেল ডেমোক্র্যাট নেতা স্যার অ্যাড ডেভি জনসনকে ‘একটি জ্বলন্ত পৃথিবী নীতি’ অনুসরণ করার জন্য অভিযুক্ত করেছেন। বাণিজ্যচুক্তির ক্ষেত্রে জনসন যে বিকল্পগুলোর পক্ষে সমর্থন করতে পারেন তা হলো- কানাডা পদ্ধতির মুক্ত-বাণিজ্য চুক্তি যা বেশির ভাগ সামগ্রীর জন্য শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা দেবে। তবে ব্রিটেনের প্রভাবশালী পরিষেবা শিল্প এর অন্তর্ভুক্ত থাকবে না।
সাম্প্রতিক দিনগুলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধানরা ব্রিটেনকে মান এবং রাষ্ট্রীয় ভর্তুকির বিষয়ে ব্রাসেলসের তৈরি বিধিমালা অনুসরণ করা অব্যাহত রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। পাশাপাশি যেকোনো বাণিজ্য বিরোধের ক্ষেত্রে ইউরোপীয় আদালতের রায়কে মেনে নেয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন।
প্রত্যাহার চুক্তির অংশ হিসেবে অক্টোবরে অনুষ্ঠিত চুক্তিতে ফিরে যাওয়ার ব্রাসেলসের অনুভূত প্রচেষ্টা সম্পর্কে সরকার ক্ষুব্ধ বলে বোঝা গেছে। আশা করা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে ইইউকে বলবেন যে, মার্চ মাসে শুরু হতে যাওয়া আলোচনায় তিনি কোনো প্রান্তিককরণ বা জোটবদ্ধ হওয়া, ইউরোপীয় আদালতের কোনো এখতিয়ার এবং কোনো ব্রাসেলসের দাবিতেই ছাড় দেবেন না। তিনি শ্রমিকদের অধিকার, খাদ্য স্বাস্থ্যবিধি মান এবং পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়ে শিথিল নিয়মগুলোও বাতিল করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের মতো দেশগুলোর সাথে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি করার ক্ষেত্রেও সরকার অগ্রগতি অর্জন করতে চায়। ব্রিটেনের সাথে বাণিজ্যচুক্তি নিয়ে আলোচনায় ইইউর নিজস্ব পদ্ধতিকে ২৭ সদস্য রাষ্ট্রের সবার দ্বারা সম্মত হওয়া আবশ্যক, যা ফেব্রুয়ারির শেষ নাগাদ না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
শুক্রবার চূড়ান্ত ব্রেক্সিট কার্যকর হলেও এখনো সব কিছু আগের মতোই থাকবে, অন্তত এ বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ব্রিটেন চাইলে এই অন্তর্বর্তীকালীন মেয়াদ বাড়ানোর অনুরোধ করতে পারে, তবে জনসন আগেই বলেছেন যে তিনি তা করবেন না। ব্রেক্সিট সমর্থকদের ভাষায়- ব্রিটেন ‘স্বাধীন’ দেশ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের অংশ নয়, ইউরোপের মূলভূমি থেকে নিয়ন্ত্রণহীন অভিবাসন আর হবে না, ইইউর তহবিলে ব্রিটেনকে শত শত কোটি পাউন্ড চাঁদা দিতে হবে না, ব্রিটেন কোন দেশের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করবে তার ওপর ব্রাসেলসের খবরদারি থাকবে না, ব্রিটেনের আইনের ওপর থাকবে না ইউরোপীয় কোর্ট অব জাস্টিসের কর্তৃত্ব, ব্রিটিশ জেলেরা তাদের সমুদ্রসীমায় ইচ্ছামতো মাছ ধরতে পারবে- ইত্যাদি। ওপরে বিষয়গুলো কার্যকর হবে ২০২১ সাল থেকে, যদি তার আগে ব্রিটেনের সাথে ইউরোপের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক কী হবে তার চূড়ান্ত চুক্তি হয়ে যায়- তবেই।
সাতচল্লিশ বছর ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার পর ব্রিটেনের এই বিদায়- যা আনন্দ-উল্লাসের মধ্যে দিয়ে উদযাপন করেছেন ব্রেক্সিট-সমর্থকরা। আর যারা ছিলেন ‘রিমেইনার’ অর্থাৎ ইইউতে থাকার পক্ষে- তাদের কাছে শুক্রবার ছিল এক শোকের দিন।