রির অপবাদে ৩ মাদরাসাশিক্ষার্থীকে মারধর আওয়ামী লীগ নেতার
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে পাওয়ারলুম কারখানার লোহার শিকল, নাট-বল্টু চুরির অভিযোগে তিন মাদরাসারশিক্ষার্থীর হাত বেঁধে মারধর করে এলাকায় ঘোরানোর পর জনসমক্ষে দুই শিশুর চুল কেটে দিয়েছেন পৌরসভার এক মেয়র। অভিযুক্ত ব্যক্তি উপজেলার গোপালদী পৌরসভার মেয়র এম এ হালিম সিকদার উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক।
গতকাল সোমবার সকাল ১০টার দিকে উপজেলার গোপালদী পৌরসভার রামচন্দ্রদী এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে বেশ ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। ঘটনার পর ওই শিশুদের পরিবারের সদস্যরা লজ্জায় গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ভাবছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, রামচন্দ্রদী গ্রামের জাহাঙ্গীরের ছেলে ও গোপালদী মাদরাসার ষষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থী বায়েজিদ (১০), হাসানের ছেলে ও রামচন্দ্রদী মাদরাসার হেফজ্ বিভাগের ছাত্র সিয়াম (৮) এবং জজ মিয়ার ছেলে একই মাদরাসার শিক্ষার্থী আফরীদ (৮) সকালে মক্তব থেকে যাওয়ার পথে গোপালদী পৌর মেয়র হালিম সিকদারের মালিকাধীন সিকদার পাওয়ারলুম কারখানার সামনে পড়ে থাকা কয়েকটি নাট-বল্টু, লোহার শিকল কুড়িয়ে নিয়ে খেলা করছিল। এ সময় মেয়র তার লোকজন নিয়ে কুড়িয়ে পাওয়া ওই নাট-বল্টু চুরির অভিযোগ দিয়ে তাদের ধরে এনে হাত বেঁধে দুই ঘণ্টা আটক রেখে মারধর করেন। একপর্যায়ে বায়েজিদের চাচা কালাম ও আলামিন শিশুদের পক্ষে করজোড়ে আকুতি মিনতি করেও তাদের নির্যাতন থেকে রক্ষা করতে পারেনি। আশপাশে অনেক লোক জড়ো হয়। পরে রামচন্দ্রদী বাসস্ট্যান্ডে এনে তাদের মাথার চুল কেটে ভয়ভীতি দেখিয়ে ছেড়ে দেয়।
অভিভাবক ও প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, সকালে মক্তবে পড়ালেখা শেষে ৮ ও ১১ বছর বয়সী দুই শিশু মেয়রের ভেঙে ফেলা পাওয়ারলুম কারখানার কাছে ক্রিকেট খেলতে যায়। এ সময় আট বছর বয়সী শিশু একটি লোহার শিকল কুড়িয়ে এনে ১১ বছর বয়সী শিশুর কাছে তা রাখতে দেয়। বিষয়টি মেয়র হালিম সিকদার দেখতে পেয়ে তাদের আটক করেন। পরে রশি দিয়ে দুই শিশুর হাত বেঁধে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তাদের কথার সূত্র ধরে সাত বছর বয়সী শিশুটিকেও বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে আসেন মেয়র।
তিনজনেরই হাত বেঁধে ঘটনাস্থল থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে একটি নরসুন্দরের দোকানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ১১ ও ৮ বছর বয়সী শিশুর চুল কেটে দেয়া হয়।
অপর শিশুর পরিবারের সদস্যরা ক্ষমা চেয়ে তাদের সন্তানকে বাড়ি নিয়ে যান। প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে এই শিশুদের শাস্তি দেয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় একজন শিশুর অভিভাবক তাদের ছেড়ে দেয়ার জন্য মেয়রের পা পর্যন্ত ধরেন। কিন্তু তিনি ওই অভিভাবকের সাথে মারমুখী আচরণ করেন।
বায়েজিদের পিতা জাহাঙ্গীর বলেন, কোনো কারণ ছাড়াই আমার ছেলেসহ তিন শিশুকে নির্যাতন করেছে আমি এ ঘটনার বিচার দাবি করছি।
১১ বছর বয়সী শিশুটির বাবা উপজেলার একটি মসজিদের ইমাম ও স্থানীয় মাদরাসার শিক্ষক। তিনি বলেন, ‘ছেলেটার মুখের দিকে তাকাইতে পারি না। ও লজ্জায়, ভয়ে কান্না করতেও ভুলে গেছে। ওরা তিনজনই শিশু। কোনো অন্যায় করলে অভিভাবক ডেকে নিয়ে বিচার সালিস করতে পারত; কিন্তু অভিভাবকদের না জানাইয়া তিনি (মেয়র) চোর অপবাদ দিয়া এই শিশুদের মারধর করেছেন। অপমান করেছেন। আমি আমার ছেলেটার মানসিক অবস্থা নিয়া খুবই ভয়ে আছি।’ ঘটনার পর লজ্জায় এলাকায় মুখ দেখানো যাচ্ছে না উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ‘এ ঘটনার পর আমার স্ত্রী আর এলাকায় থাকতে চাচ্ছে না। সে ভেঙে পড়েছে। ছেলেটার কথা ভেবে আমাদের বুক ভেঙে যাচ্ছে। কী করব, কার কাছে যাবো কিছুই বুঝতেছি না।’
সাত বছর বয়সী ওই শিশুর বাবা পেশায় দিনমজুর। ওই শিশুর পরিবারের এক সদস্যের সাথে কথা বলতে চাইলে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, ‘কারো বিরুদ্ধে আমাদের কোনো অভিযোগ নেই। আমরা গ্রাম ছাইড়া চইলা যামু।’
এ ব্যাপারে গোপালদী পৌরসভার মেয়র এম এ হালিম সিকদার ঘটনার কথা স্বীকার করে জানান, এরা পেশাদার চোর। অতীতেও তারা চুরি করেছে তাই তাদের চুল কেটে দিয়েছি। তার দাবি, শিশু তিনটি চুরির সঙ্গে জড়িত। তাদের শিক্ষা দেয়ার জন্য এমনটা করেছেন।
মেয়র আরো বলেন, ‘ছোডো মানুষ দেইখা বেশি কড়া শাসন করি নাই। হালকা কইরা হাত বানছি। পরে ওরা জানাইলো আরো দুই দিন চুরি করসে। ওদের কথামতো আরেকটা চোরেরে ধইরা আনছি বাড়ি থেইকা (সাত বছরের শিশু)। পরে একটা শিক্ষা দেওয়ার লাইগা বাজারে দুইজনের মাথার চুল কাইটা দিসি।’ আড়াইহাজার থানার ওসি আজিজুল হক হাওলাদার জানান, এ ব্যাপারে অভিযোগ পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
আড়াইহাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইশতিয়াক আহমেদ বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা ছিল না। আমি খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি।’সূত্র: নয়া দিগন্ত