ভোটাররা কেন্দ্রে গেলেই ‘জয়’ দেখছে বিএনপি
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রচারকালীন বিচ্ছিন্ন কয়েকটি হামলা ও কিছু বাধার ঘটনার পরও ভালোভাবেই মাঠে আছে বিএনপি। দলের নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, এমন পরিস্থিতিতেও মানুষ ভোট দিতে পারলে দল মনোনীত দুই মেয়র প্রার্থীই জয়ী হবেন। তাই ভোটারদের কেন্দ্রমুখী করতেই জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। পাশাপাশি ‘ভয়-ভীতি’ উপেক্ষা করে পোলিং এজেন্টদের কেন্দ্রে রাখাই তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে প্রচার শেষ হওয়ার পর আজ থেকে পরিস্থিতি কী হয়, সে দিকেই তাদের দৃষ্টি বেশি।
বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে একটি শঙ্কার বিষয় ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)। ইভিএমে ‘যান্ত্রিক সূক্ষ্ম’ কারচুপি আছে বলে তাদের ধারণা। তাই ভোটিং মেশিন নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তা কম নয়। কারণ, তারা মনে করেন মেশিনের মাধ্যমে কারচুপি করা হলে তা ঠেকানোর কৌশল তাদের জানা নেই। অবশ্য এর দ্বিমতও আছে সিনিয়র নেতাদের মধ্যে। অনেকে মনে করেন, ব্যালটে সিল মেরে যেভাবে কারচুপি করা যায়, মেশিনে সেভাবে সম্ভব নয়।
দলটির নেতারা বলছেন, শঙ্কা যাই থাকুক ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে গিয়ে স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারলে তা বিএনপির অনুকূলে যাবে। এ জন্য পোলিং এজেন্ট নির্বাচন ও তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, ওয়ার্ডভিত্তিক সমন্বয় কমিটি, কেন্দ্রভিত্তিক কমিটি এবং মনিটরিং সেল গঠনসহ যাবতীয় কার্যক্রম শেষ করেছেন দলটির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা।
বিএনপি নেতারা বলছেন, পরিবেশ এতদিন অনুকূলে থাকলেও আজ থেকে তা ভিন্ন দিকে মোড় নেয় কিনা সেটি দেখার বিষয়। ভোটারদের ভীতি সৃষ্টির জন্য গ্রেপ্তার এবং পোলিং এজেন্টদের কেন্দ্রে যেতে বাধা দিতে ক্ষমতাসীনরা প্রশাসনের সহযোগিতা নিতে পারে। সেজন্য উত্তরে বিএনপি মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়াল এবং দক্ষিণে মেয়র প্রার্থী ইশরাক হোসেন ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে এবং নেতাকর্মীদের সাহস নিয়ে মাঠে থাকার ওপর জোর দিচ্ছেন।
দলের অন্তত দুই নেতার সঙ্গে আলাপকালে তারা বলেন, ১ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের পর রাজনীতিতে নতুন মোড় নিবে। বিএনপি জয়ী হলে যেমন জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব পড়বে, হেরে গেলেও মেরুকরণ হবে। খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলনের গতি পরিবর্তন হতে পারে।
গতকাল বৃহস্পতিবার নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ঢাকাবাসীর কাছে আমাদের উদাত্ত আহ্বান, আপনারা সংবিধানসম্মত অধিকার রক্ষার জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিন, আপনাদের অধিকার নিশ্চিত করুন। আসুন আমরা সব অন্যায়, অবিচার, সন্ত্রাস ও ত্রাস সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিরোধ গড়ে তুলি। ১ ফেব্রুয়ারি ভোটকেন্দ্রে গিয়ে আমাদের মতামত দিই। নিরাপদ ও বাসযোগ্য ঢাকা মহানগরী গড়ে তুলি, অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাত্রা শুরু করি। আমরা নিশ্চিত ঢাকাবাসী যদি ভোট দিতে পারেন তা হলে অবশ্যই আমরা জয়লাভ করব।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, ভোটারদের নিরাপত্তা ও নির্বিঘ্নে যাতে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারে সেই সহযোগিতা করবে বিএনপি গঠিত কেন্দ্রভিত্তিক কমিটি। প্রতিটি ওয়ার্ডে একজন কেন্দ্রীয় নেতা সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করবেন। কোনো কেন্দ্রে বিশৃঙ্খলা হলে সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রীয় মনিটরিং সেলকে জানাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্তদের কেন্দ্রীয় মনিটরিং টিমের ফ্যাক্স ও মোবাইল নাম্বার জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভোটকেন্দ্রের ভেতরে কোনো কারচুপির ঘটনা ঘটলে পোলিং এজেন্টদের সঙ্গে সঙ্গে বাইরে সমন্বয়কের দায়িত্ব পালনকারীকে জানাতে বলা হয়। তারা কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। বিএনপি নেতাকর্মী, সমর্থক ও তাদের আত্মীয়স্বজনকে সকাল সকাল ভোটকেন্দ্রে যেতে নির্দেশ দিয়েছে। এরপর নিজ নিজ এলাকার ভোটাদের ভোট কেন্দ্রে নিতে উৎসাহ দিতে কাজ করতে বলা হয়েছে।
বিএনপির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা জানান, অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে মামলা-হামলার ভয়ে আগ্রহ দেখাননি তাদের কাউকেই পোলিং এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। শুধু সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রের ভোটার, স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী, সাহসী এবং শিক্ষিতদের পোলিং এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা যায়, উত্তরে ৫৪টি ওয়ার্ডে ১ হাজার ৩১৮ ভোট কেন্দ্রে ৭ হাজার ৮৪৬ কক্ষে ভোটগ্রহণ হবে। দক্ষিণে ৭৫টি ওয়ার্ডে ১ হাজার ১৫০ কেন্দ্রে ৬ হাজার ৫৮৮ কক্ষে ভোট গ্রহণ হবে।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির প্রশিক্ষণবিষয়ক সম্পাদক এবিএম মোশাররফ হোসেন বলেন, আমাদের প্রতিটি বুথে একজন করে পোলিং এজেন্ট নিশ্চিত করতে কাজ করছি। বিগত সময়ের মতো কোনো পোলিং এজেন্ট গ্রেপ্তার অথবা নিখোঁজ থাকলে তাৎক্ষণিক বিকল্প পোলিং এজেন্ট প্রস্তুত রাখা হবে। ইতোমধ্যে সম্ভাব্য পোলিং এজেন্টদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, শুধু দুই সিটিতে মেয়রপ্রার্থীর জন্য তারা ২০ হাজার পোলিং এজেন্ট প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবারই উত্তর ও দক্ষিণের মেয়র প্রার্থীদের প্রশিক্ষণ শেষ করা হয়েছে। এবার পোলিং এজেন্টদের তালিকা ভোটের দিন সকালে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি।
বিএনপি নেতারা অভিযোগ করেন, ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের প্রতিনিয়ত নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন, ধানের শীষের মেয়র ও কাউন্সিল প্রার্থীদের ওপর হামলা, তাদের পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা, নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি পুলিশি তল্লাশি ও মামলা- গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। দুই সিটিতে ক্ষমতাসীনদের ১৫/১৬‘শ নির্বাচনী বিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে কোনো রকমের ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
বিএনপি নেতারা বলছেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নেতাকর্মীরা মাঠে নেমেছে। মানুষের কাছাকাছি যেতে পেরেছেন। এটা একটি বড় অর্জন। মহানগর রাজনীতির বিভেদ ভুলে সবাই এক হয়ে কাজ করেছেন। স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস প্রয়াত নেতা সাদেক হোসেন খোকার ছেলে ইশরাকের জন্য যেভাবে মাঠে নেমেছেন, তাও প্রশংসা পাচ্ছে। তাছাড়া নেতাকর্মীরা অনেকটা আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছেন।
আওয়ামী লীগের মেয়রপ্রার্থী ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস অভিযোগ করেছেন ১৭০টি কেন্দ্রে দখল করার জন্য বাইরে থেকে সন্ত্রাসী ভাড়া করে নিয়ে এসেছেন- এ নিয়ে বিএনপিতে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। তাপস আগাম এ ধরনের ‘অপপ্রচার’ কেন ছড়াল তা নিয়ে গতকাল রাত থেকে নানা কথা হচ্ছে।
এ বিষয় জানতে চাইলে তাবিথ আউয়াল বলেন, তারা অপপ্রচার ও গুজব ছড়াতে পারে এমন আশঙ্কার কথা আগেই বলেছি। তারা ভোটারদের কেন্দ্রবিমুখ করতে নানা ধরনের বক্তব্য রেখে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। এতে লাভ হবে না, জনগণ জেগে উঠেছে।
প্রকৌশলী ইশরাক হোসেন বলেন, এটা একেবারে অবাস্তব কথা। আমার কাছে তথ্য আছে, আওয়ামী লীগ সারাদেশে জেলা কমিটি করে লঞ্চ ভরে ঢাকায় লোক আনতেছে। তারা পুরো ঢাকা শহরে এ কাজটি করছে। আমি খুব শঙ্কিত, তারা ভোটের দিন কি করতে চাচ্ছে। গতকাল বুধবার রাতে আমাদের দক্ষিণের যুবদলের সভাপতির বাসায় পুলিশ অভিযান চালিয়েছে। আমাদের নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিযান চালানো হচ্ছে। গত কয়েকদিন আগে আমাদের প্রচারে হামলায় যারা আহত হয়েছেন তাদের বাড়িতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন অভিযান চালাচ্ছে।
এ বিষয়ে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, নিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতি সৃষ্টি করে আওয়ামী লীগ ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জয় পেতে চায়। তিনি গতকাল প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের বলেন, নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের সঙ্গে কিছু সংস্থার লোক কাজ করছে। যারা নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত, তাদের পক্ষ থেকে অনেক কিছু করানো হচ্ছে।