নদী শুধু নদী নয়
আপাতদৃষ্টিতে দেখা যায়, বয়ে চলা জলরাশি পাহাড় ও উঁচু জায়গা থেকে এক বা একাধিক প্রণালির মাধ্যমে সৃষ্টি হয়ে সমুদ্রে গিয়ে মেশে। এ ধারায় যুক্ত হয় ভূপৃষ্ঠের গড়ানো জল এবং ছোট-বড় ঝরনাধারা। এই বয়ে চলা জলরাশির সঙ্গে আসা পলি অনেক ঘটন-অঘটন ঘটাতে পারে। ঘটাতে পারে নতুন নদির গতিপথের পরিবর্তন।
সৃষ্টি করতে পারে নতুন ডুবন্ত চর, নতুন ভূখণ্ড। এভাবেই জনপদ হয়; হাট-বাজার-গঞ্জ তৈরি হয়। ঘাস-গুল্ম বৃক্ষাদি জন্ম নেয় সেই মাটিতে। জীবন-জীবিকার পুনঃ পুনঃ উৎপাদিত রসদ; উর্বর ভূমি অফুরন্ত পুষ্টির ছোট-বড় উৎস। দূষিত কার্বনের শোষক জীবনের অত্যাবশ্যকীয় চক্র। কার্বন বিষ শুষে নেয়ার এক নিরন্তর আধার। অন্যদিকে লোকালয়, গৃহ, বিদ্যালয়, কৃষি ও শিল্প গড়ে ওঠে।গড়ে ওঠে শহর, বাণিজ্য ও বিশ্ব যোগাযোগ ব্যবস্থা। গড়ে ওঠে দেশ। প্রথমে ভারসাম্যপূর্ণ, পরে ভারসাম্যহীন। ভারসাম্যহীনতা থেকেই দূষণের উৎপত্তি হয়। যখন নদীর জলের ধারণক্ষমতার বেশি আবর্জনা ও দূষিত তরল পদার্থ পড়ে, তখন নদীর জল দূষিত হয়ে পড়ে। এ দূষণ কোথা থেকে আসে? মানুষের প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে তৈরি হয় এই দূষণ। রাজধানীর সহস্রাধিক শিল্পকারখানা প্রতিনিয়ত নিঃসরণ করছে তরল-কঠিন বর্জ্য। হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো থেকে আসছে মেডিকেল বর্জ্য। ঢাকা ওয়াসা, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন থেকে আসছে হরেকরকম বর্জ্য। প্লাস্টিক-পলিথিন বর্জ্য এত বেশি পরিমাণে আসছে যে, কোনো কোনো নদীতে জমে তলদেশে কয়েক ফুট স্তর তৈরি হয়েছে। এগুলো উত্তোলন, নিরাপদ স্থানে প্রেরণ ও পরিবেশসম্মত ব্যবস্থাপনা করার প্রযুক্তি ও দক্ষ লোকবলের অভাব রয়েছে। টন টন বর্জ্যে প্রতিদিন নদীর দেহ ভারি হচ্ছে। হারাচ্ছে নদীর বৈশিষ্ট্য।
নদী দখল : নদী দখল এক ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। যে যেভাবে পারছে নদী ও জলাশয় দখল করে চলেছে। দেশের প্রচলিত আইন-কানুন, ২০০৯ সালে হাইকোর্টের রায়সহ দুই যুগের নদী আন্দোলন তেমন কাজে আসছে না মনে হয়। কারণ নদী দখল অব্যাহত আছে। ঢাকার চারপাশের নদীগুলো, বিশেষ করে তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা, টঙ্গীখাল, ধলেশ্বরী নদীর জায়গা দ্রুতগতিতে দখল হয়ে যায়। সত্তরের দশকে অর্থাৎ স্বাধীনতার সময় ২৪,০০০ কিলোমিটারের বেশি নৌপথ ছিল, যা বর্তমানে ৩,৮০০ কিলোমিটারে নেমে এসেছে। বাকি ২০,০০০ কিলোমিটার নৌপথ গেল কোথায়? সব দখলদাররা দখল করে ফেলেছে। নদী দখলের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে বাঁশের বেড়া বা বেষ্টনী দেয়া হয়। তারপর কঠিন ও তরল বর্জ্য ফেলা হয়। এমনকি সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্যবাহী ট্রাক চুক্তি করা হয় ভরাট কাজের জন্য; তারপর কাঁচা বাড়ি, টিনের ঘর এবং সর্বশেষে অট্টালিকা তৈরি করা হয়। যারা বেপরোয়া তারা এক সঙ্গেই বালি দিয়ে ভরাট করে অট্টালিকা তৈরি করে। এসব অবৈধ স্থাপনা রক্ষা করার জন্য মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ করা হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকারি স্থাপনা গড়তেও দেখা যায়।
দখল উচ্ছেদ : সরকার নদীর বেদখলকৃত ভূমি উদ্ধারের জন্য অভিযানে নামে। বিগত বছরগুলোতে এ অভিযান ছিল লোক দেখানো। কারণ কতটুকু জায়গা উচ্ছেদ করা হবে তার লক্ষ্য ঠিক করে সেই অনুযায়ী লোকবল নিয়োগ করা হয়নি। লাগসই ও যথার্থ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়নি। বছরের পর বছর উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা করা হলেও সফলতা আসেনি। নদী রক্ষা টাস্কফোর্স কতিপয় ভালো সিদ্ধান্ত নিলেও তা প্রয়োগ বা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। এর জন্য সঠিক পরিকল্পনা ও অদৃশ্য হাতের কারসাজি ছিল বলে পরিবেশবাদীরা মনে করেন। এবার বছরের শুরুতে ২৯ জানুয়ারি থেকে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করা হলেও জুলাই পর্যন্ত ৫০ দিন অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। এবারের একটি বিশেষ দিক হল, অনেক রাঘববোয়ালের বেআইনি স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করা হয়েছে। মামলা-মোকদ্দমা ও গ্রেফতার করতে হয়েছে। এতে সরকারের নীতিতে দৃঢ়তা পরিলক্ষিত হয়েছে। জানা যাচ্ছে, সরকার কয়েকটি দফতরের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করে একটি মহাপরিকল্পনা করেছে, যা স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচির মাধ্যমে বাস্তবায়নের কথা রয়েছে। এখন দেখার বিষয় এ মহাপরিকল্পনা কার্যকর করতে সরকার কতটুকু সফল হয় এবং কত দ্রুত সময়ে তা শেষ করতে পারে।
নদী রক্ষায় বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ : জৌলুসপূর্ণ দীর্ঘমেয়াদি বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদে পাস হয়। এটি জাতীয় পর্যায়ে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা, যার পক্ষে-বিপক্ষে অনেক আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে। তবে এটা ঠিক যে, নদী রক্ষা করতে হবে এ বিষয়ে সবাই ঐকমত্য পোষণ করেছেন। এই পরিকল্পনায় আটটি হাইড্রোলজিক্যাল জোন বা অঞ্চলভিত্তিক নদী ব্যবস্থাপনা এবং ছয়টি পরিবেশগত ঝুঁকিপূর্ণ হটস্পট অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। হটস্পটগুলো হচ্ছে- ১. উপকূলীয় অঞ্চল, ২. বরেন্দ্র ও খরাপ্রবণ অঞ্চল, ৩. হাওর ও আকস্মিক বন্যা প্রবণ অঞ্চল, ৪. চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চল, ৫. নদী অঞ্চল ও মোহনা, ৬. নগর এলাকা। দেখা যায়, মোটাদাগে কিছু অংশ বাদ দিয়ে পুরো দেশটাই পরিবেশগত ঝুঁকিপূর্ণ বা হটস্পট। পরিবেশ সংরক্ষণের মূলনীতি হচ্ছে প্রকৃতিকে তার মতো করে থাকতে দাও। কিন্তু এ নীতি কতটুকু প্রতিপালিত হবে? প্রতিবেশ প্রভাবগত সমীক্ষা দায়সারা গোছের হলে ভবিষ্যৎ বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী হবে। তাই কীভাবে বাস্তবায়িত হবে এটি একটি হাজার কোটি টাকার প্রশ্ন।
নদী রক্ষায় আদি আইন-নীতিমালা : স্বাধীনতার পর থেকেই পরিবেশ বিপর্যয়ের সূচনা হয়েছিল। প্রথম তিন বছর যুদ্ধবিধ্বস্ত পরিবেশ বিরাজ করেছিল। পরবর্তীকালে পরিবেশ ও নদী রক্ষার কোনো দিকনির্দেশনা বা পরিকল্পনা ছিল না। বেড়িবাঁধ বা পোল্ডার নির্মাণ ছিল স্বপ্ন বাস্তবায়নের মতো। কালভার্ট ও নদীশাসন ছিল অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্প। কালান্তরে এসব এখন নদী মরার কারণ হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। দখল রোধ করার জন্য এবং প্রবহমানতা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য বেঙ্গল ক্যানাল অ্যাক্ট ১৮৬৪; বেঙ্গল ট্যানেন্সি অ্যাক্ট, বেঙ্গল ট্যাংক ইমপ্রুভমেন্ট অর্ডিন্যান্স ১৯৩৯ (সংশোধন ১৯৮৬) এবং বন্দর পরিচালনা নিয়ন্ত্রণ ও নৌযান চলাচলের প্রতিবন্ধকতা রহিতকরণের জন্য পোর্ট অ্যাক্ট ১৯০৮ (যা এখনও বলবৎ আছে) যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হয়নি। ব্রিটিশ আমল থেকে এই আইনগুলো প্রয়োগ করা হলে নদীর অবস্থা এমন মৃতপ্রায় হতো না।
নদী নিয়ে শেষ কথা নেই। নদী শুধু নদী নয়। জীবন যদি বাঁচাতে হয়, পরিবেশ যদি রক্ষা করতে হয়, উর্বরতা যদি বাড়াতে হয়, উৎপাদনশীলতা যদি বজায় রাখতে হয়, প্রাকৃতিক ভারসাম্য যদি রক্ষা করতে হয়, তাহলে নদী সংরক্ষণের বিকল্প নেই। এ ব্যাপারে শতভাগ রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে। নদী উন্নয়নই সব উন্নয়নের, বিশেষ করে, টেকসই পরিবেশ উন্নয়নের চাবিকাঠি। নদী সংরক্ষণই উন্নয়নের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।