‘ডলার সঙ্কটের পরিস্থিতি উন্নতির কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না’
বাংলাদেশে গত বছর থেকে যে ডলার সঙ্কট শুরু হয়েছিল, নতুন বছরের শুরুতেও পরিস্থিতি উন্নতির কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এখনো ডলারের অভাবে তারা ব্যাংকে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছেন না। আমদানি মূল্য মেটাতে না পারায় পণ্য নিয়ে বন্দরে আটকে রয়েছে জাহাজ। সরকারি অনেক উদ্যোগও ডলার সঙ্কটের কারণে জটিলতায় ভুগছে।
যদিও এর আগে একাধিকবার বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তারা আভাস দিয়েছিলেন, নতুন বছরে ডলার সঙ্কট মিটে যাবে।
সঙ্কটের কোনো সমাধান তো দেখা যাচ্ছেই না, উল্টা পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা।
আমদানি সঙ্কট কাটছে না
রোজা সামনে রেখে সাতটি পণ্য জরুরি ভিত্তিতে আমদানিতে সহায়তা করার জন্য ডিসেম্বর মাসের শুরুতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
’অগ্রাধিকার ভিত্তিতে’ এসব পণ্য আমদানিতে সহায়তা করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দিয়েছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এসব পণ্য আমদানিতে প্রায় ২৫০ কোটি ডলার দরকার হবে। ওই সময় ব্যবসায়ীদের এলসি সমস্যা মেটাতে একটা ’ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেল’ খোলার কথাও জানিয়েছিল সরকার।
কিন্তু জানুয়ারি মাসের শেষদিকে এসেও ব্যবসায়ীরা বলছেন, পরিস্থিতির কোনো বদল হয়নি। ফলে সোমবার আরেকদফা চিঠি পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ডলার সঙ্কটে আমদানি মূল্য পরিশোধ করতে না পারায় চিনি ও সয়াবিন তেল নিয়ে নিত্যপণ্য বহনকারী পাঁচটি জাহাজ বন্দরে আটকে রয়েছে।
বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা বলছেন, পাঁচ-ছয় মাস আগে থেকে পণ্য আমদানিতে ঋণপত্র খোলা নিয়ে যে সঙ্কট তৈরি হয়েছিল, ওই পরিস্থিতির এখনো খুব একটা উন্নতি হয়নি।
খাদ্য পণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বাশার চৌধুরী জানান, ‘পরিস্থিতির আসলে খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। ব্যাংকগুলো এখনো ক্যাশ এলসি খুলতে রাজি হচ্ছে না। কোনো কোনো ব্যাংক দীর্ঘমেয়াদি এলসি খুলতে বলছে। কিন্তু সেটা করলে অনেক অনিশ্চয়তা আছে। আমদানি করা পণ্যের কি দাম ধরব, ভবিষ্যতে ডলারের দাম কেমন হবে ইত্যাদি ঝুঁকি রয়ে যায়।’
দীর্ঘমেয়াদি এলসির ক্ষেত্রে সুদে তিন মাস বা ছয় মাস মেয়াদি হয়ে থাকে। তৃতীয় কোনো ব্যাংক এলসির মূল্য পরিশোধ করে দেয়। মেয়াদ উত্তীর্ণের সময় ডলারের যে দাম থাকে, ওই দাম ব্যবসায়ীকে পরিশোধ করতে হয়।
বর্তমানে ডলারের সঙ্কট থাকায় ব্যাংকগুলো এই পথ বেছে নিয়েছে। কিন্তু সুদের অতিরিক্ত হার ও ভবিষ্যৎ ঝুঁকি বিবেচনায় অনেক ব্যবসায়ী তাতে রাজি হচ্ছেন না।
ডলার সঙ্কটের সমাধান কতদূর
ডলারের বাজার স্থিতিশীল রাখতে অর্থবছরের প্রথম ছয়মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর ২০২২) ৭৮০ কোটি ডলার সরবরাহ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
তবে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ’আমাদের ধারণা, এই পরিস্থিতি সহসা উন্নতি হবে না। বরং সঙ্কট আরো বাড়বে সামনের দিনগুলোতে। এর কারণ হল, এই মুহূর্তে আমরা রেমিট্যান্স ও রফতানির কিছুটা ইতিবাচক ধারা দেখছি। কিন্তু চাহিদার বিপরীতে যে সরবরাহ আসছে, তা যথেষ্ট নয়। জ্বালানি, খাদ্যপণ্য ও সারের জন্য বিপুল ডলার ব্যবহার করতে হচ্ছে, শিল্পকারখানার কাঁচামাল, সরকারি প্রকল্প তো রয়েছেই।’
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করবে, কিন্তু পুরোপুরি স্থিতিশীল করতে পারবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মোহাম্মদ মেজবাউল হক বলেন, ‘সমস্যা সমাধানে সব রকম পদক্ষেপ নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলোকেও এলসি নিয়ে কোনো সমস্যা থাকলে আমাদের জানাতে বলেছি। রেমিট্যান্স আসছে, রফতানি আয়েও ইতিবাচক ধারা রয়েছে। আশা করছি সমস্যা খুব তাড়াতাড়ি মিটে যাবে।’
বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে সঙ্কট শুরু হওয়ার পর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কাছে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চেয়েছে বাংলাদেশ, যা এখন অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। পাশাপাশি আমদানিখাতে বেশ কিছু কড়া পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার।
বাংলাদেশে ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, জুলাই ২০২২ থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বৈদেশিক লেনদেনে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৬৩৮ কোটি ডলার।
তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সাবেক সভাপতি আনোয়ারুল আলম চৌধুরী বলেন, ‘রফতানি এখন কিছুটা ভালোর দিকে। তবে আমদানি কমেছে। যদিও বিশ্ববাজারে মন্দা আছে, যতটা রফতানি অর্ডার পাওয়ার কথা, ততটা আসছে না। কিন্তু অর্ডার আসতে শুরু করছে, কিন্তু মূল্য নির্ধারণ করা কঠিন। এই পরিস্থিতি ভালো হয়ে যাবে বলে আমরা আশা করছি। তখন রফতানি আয় আরো বাড়বে।’
তবে তিনি স্বীকার করেন, বিশ্ববাজারে মন্দা থাকার কারণে তৈরি পণ্যের দাম যেমন ভালো পাওয়া যাচ্ছে না, তেমনি ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে তাদের উৎপাদন খরচও বেড়ে যাচ্ছে।
রিজার্ভের কী অবস্থা?
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমান দেশের রিজার্ভের পরিমাণ তিনি হাজার ২৪৮ কোটি ডলার।
সেখান থেকে বিভিন্ন তহবিলে বিনিয়োগ ও ঋণ হিসেবে দেয়া ৭২০ কোটি ডলার কমানো হলে বর্তমান রিজার্ভের পরিমাণ আড়াই হাজার কোটি ডলারের কিছু বেশি হয়।
২০২১ সালের এই সময়েও বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের আকার ছিল সাড়ে চার হাজার কোটি ডলারের বেশি।
রফতানি আয়, রেমিট্যান্স, বৈদেশিক বিনিয়োগ ও ঋণ বাংলাদেশের রিজার্ভের প্রধান উৎস। অন্যদিকে আমদানি ব্যয়, বৈদেশিক ঋণ ও সুদ পরিশোধ, বিদেশিকর্মীদের বেতন-ভাতা ইত্যাদি খাতে ডলার খরচ হয়। বাংলাদেশে ডলারের ঊর্ধ্বগতি শুরু হয়েছিল গত বছরের মে মাস নাগাদ। রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স কম আসায় ব্যালেন্স অব পেমেন্ট বা লেনদেনের বড় ঘাটতি তৈরি হয়। ফলে ব্যাংকগুলোতে বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্কট দেখা যাওয়ায় জুলাই-আগস্ট মাসে ডলারের বিনিময় মূল্য রেকর্ড ছুঁয়ে যায়।
ডলার সঙ্কটের কারণে কয়লা আমদানি করতে না পেরে বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ উদ্যোগের রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া পার্টনারশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আকরাম উল্লাহ এর আগে বলেছিলেন, ডলারের সঙ্কটের জন্য কয়লা আমদানি করা যাচ্ছে না। যার কারণে উৎপাদন বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে জরুরি ভিত্তিতে এলসি সমস্যা সমাধান করে কয়লা আমদানির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে স্বল্প সুদে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ সুবিধার রফতানি উন্নয়ন তহবিলের আকার ১০০ কোটি ডলার কমিয়ে এনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে ব্যাংক খাতে বৈদেশিক মুদ্রা সঙ্কট আরেকটু তীব্র হবে। কারণ ব্যাংকগুলো এই তহবিলের আকারে এলসি খোলা কমিয়েছে।
সোমবার এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের উপ-প্রধান মাহমুদুল হাসান বলেছেন, ’ডলারের অ্যাডজাস্টমেন্টের কারণে আমদানি করা পণ্যের মূল্য ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যাবে।’
আমদানি নির্ভর দেশ হওয়ার কারণে বাংলাদেশে বরাবরই ব্যালেন্স অব পেমেন্ট বা লেনদেনে হিসাবে ঘাটতি থাকে। কিন্তু গত বছর রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ের তুলনায় আমদানি ব্যয় বেশি হওয়ায় এই ঘাটতি অনেক বড় হয়েছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি ও খাদ্য পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়াতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করছে বাংলাদেশের সরকার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, ফেব্রুয়ারি মাস নাগাদ ডলারের সঙ্কট অনেকটাই মিটে যাবে। কিন্তু বাস্তবে সেই পরিস্থিতি দেখছে না অর্থনীতিবিদরা।
অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ’দেশে আসলে ব্যবহারযোগ্য ডলার কি পরিমাণ রয়েছে, তা নিয়ে এই মুহূর্তে একটি সন্দেহ তৈরি হয়েছে। আমরা বিভিন্ন রকম হিসাব পাচ্ছি, সেটা কাগজে কলমে। কিন্তু বাস্তবে এলসি পেমেন্ট দেয়া যাচ্ছে না, নতুন এলসি খোলা যাচ্ছে না। সবকিছু মিলিয়ে আশঙ্কা হচ্ছে বাজারে অ্যাভেইলেবল ডলারের সরবরাহ হিসাবের চেয়ে অনেক কম।’
অর্থনীতিবিদরা পরামর্শ দিচ্ছেন, ডলারের সঙ্কটকে পুরোপুরি স্বীকার করে উপযুক্তভাবে ও বিভিন্ন খাতকে অগ্রাধিকার দেয়ার মাধ্যমে ব্যবহার নিশ্চিত করা দরকার। সরকারের দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প, গাড়ির মতো বিলাসী পণ্য, জরুরি নয় এমন পণ্য আমদানিতে নিরুৎসাহিত করা, বিদেশি ঋণ পাওয়া যাবে এমন প্রকল্প গুরুত্ব দেয়া উচিত।
সূত্র : বিবিসি