কী ঘটতে যাচ্ছে ফিলিস্তিনে!

0

অবশেষে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে পাশে বসিয়ে ‘শতাব্দীর সেরা চুক্তি’ নামের পরিকল্পনা প্রকাশ করেছেন। এ ফর্মুলাকে উল্লসিতভাবে সমর্থন করেছেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী। দেশটির বিরোধী জোটের নেতা বেনি গ্যান্টজও সমর্থন জানিয়েছেন ট্রাম্প ঘোষিত এবং তার ইহুদি জামাতা জারাদ কুশনারের প্রণয়ন করা কথিত শান্তি চুক্তির ফর্মুলাকে। ফিলিস্তিনিরা তাদের প্রতিনিধিত্বহীন, ট্রাম্পের পুরো প্রক্রিয়াকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। ফিলিস্তিনি নেতা মাহমুদ আব্বাস ও অন্যরা ট্রাম্পের ওই ফর্মুলাকে ‘দ্বিতীয় ব্যালফোর ঘোষণা’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। ১৯১৭ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্যালফোরের প্রথম ঘোষণা ইসরাইল রাষ্ট্র তৈরির ভিত্তি বানিয়ে দিয়েছিল। এই দ্বিতীয় ঘোষণার মাধ্যমে ফিলিস্তিনের ওপর ইসরাইলের দখলদারিত্বের চূড়ান্ত স্বীকৃতির ব্যবস্থা করা হলো বলে মন্তব্য পিএলও নেতৃত্বের। পিএলও প্রধান ও ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের স্পষ্ট বক্তব্য হলো- জেরুসালেম, ফিলিস্তিন ও ফিলিস্তিনিদের অধিকার ‘বিক্রি’ করার কোনো বিষয় নয়। চুক্তি ঘোষণার আগে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ট্রাম্প পরিকল্পনা ঘোষণা করার পর ‘অসলো শান্তি চুক্তি’র সব প্রক্রিয়া থেকে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ নিজেদের প্রত্যাহার করে নেবে।

ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়ার দু’টি পক্ষের একটি, ফিলিস্তিনকে বাদ দিয়ে কেবল ইসরাইলি ইহুদি নেতাদের সামনে রেখে তার ‘শতাব্দীর সেরা পরিকল্পনা’ প্রকাশ করলেন। এই পরিকল্পনা প্রণয়নের পুরো প্রক্রিয়ায় ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ বিশেষত কট্টরপন্থী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর ছিল সম্পৃক্ততা।

ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনার প্রধান দিক ছয়টি। প্রথমত, এই শান্তি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে চার বছরের একটি অন্তর্বর্তী সময় থাকবে। এ সময় একটি অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে, যেটি বাহরাইন সম্মেলনে গত জুনে প্রকাশ করা হয়েছে। এই অন্তর্বর্তী সময়ের মধ্যে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ এটা গ্রহণ করে নিলে ফিলিস্তিনসংশ্লিøষ্ট পরবর্তী পদক্ষেপ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু করা হবে। দ্বিতীয়ত, ‘অসলো পরিকল্পনা’ অনুসারে অধিকৃত পশ্চিম তীরকে এ, বি ও সি- এ তিন বিভাগে ভাগ করা হয়েছিল। এর মধ্যে ‘এ’ ক্যাটাগরিতে রাখা হয়েছিল ফিলিস্তিনি শহরগুলোকে। ‘বি’ ক্যাটাগরিতে রাখা হয় ফিলিস্তিনি গ্রামাঞ্চলকে। আর বাকি অঞ্চলকে চিহ্নিত করা হয় ‘সি’ অঞ্চল হিসেবে। ট্রাম্পের পরিকল্পনা অনুসারে, পশ্চিম তীরে যেসব ইহুদি বসতি তৈরি করা হয়েছে; সেগুলোসহ ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ‘সি’ ক্যাটাগরির অঞ্চল হবে ইসরাইলের। এই ক্যাটাগরির ৪০ শতাংশ ভূমি ফিলিস্তিনকে দেয়া হবে। বাকি ২০ থেকে ৩০ শতাংশ কী করা হবে- তা নিয়ে স্পষ্ট কোনো বক্তব্য নেই। অন্য দিকে ‘এ’ ও ‘বি’ ক্যাটাগরির ৩০ শতাংশ ভূমি ইসরাইলের হাতে থাকবে। বাকিটা নিয়ন্ত্রণ করবে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ। তৃতীয়ত, জেরুসালেম হবে ইসরাইলের অখণ্ড রাজধানী। এর নিয়ন্ত্রণে থাকবে ইসরাইল। তবে মসজিদুল আকসাসহ পবিত্র স্থানগুলোতে থাকবে যৌথ ব্যবস্থাপনা।

ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ পূর্ব জেরুসালেমের যেকোনো স্থানে তাদের রাজধানী করতে পারবে। অখণ্ড জেরুসালেম ইসরাইলের রাজধানী হলে পূর্ব জেরুসালেমের কোথায় কিভাবে ফিলিস্তিনির রাজধানী হবে, সেটি স্পষ্ট নয়। চতুর্থত, চার বছর পর যে স্বাধীন ফিলিস্তিন গঠিত হবে; সেটি হবে সীমিত সার্বভৌমত্বের একটি দেশ। দেশটির আকাশসীমা ও স্থলসীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করবে ইসরাইল। ট্রাম্প স্পষ্টভাবেই বলেছেন, পশ্চিম তীরের নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ থাকবে ইসরাইলের হাতে। ফিলিস্তিনের কোনো সামরিক বা আধা সামরিক বাহিনী থাকবে না। অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পুলিশবাহিনী থাকতে পারবে, যাদের হাতে হালকা ধরনের অস্ত্র থাকতে পারে। পঞ্চমত, গাজার নিয়ন্ত্রণ ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের হাতে থাকবে। সেখানকার সব সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগঠনকে বিলুপ্ত করতে হবে। ষষ্ঠত, বিভিন্ন দেশে শরণার্থী হিসেবে বসবাসরত ফিলিস্তিনিরা তাদের স্বদেশে ফিরে আসতে পারবে না। অন্য দিকে বিশ্বের যেকোনো ইহুদির ইসরাইলে অভিবাসন নেয়ার বিদ্যমান অধিকার বহাল থাকবে।

অসলো শান্তি প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ২০০৫ সালে মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রয়াস এগিয়ে নেয়ার জন্য যে চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছিল তাতে ‘দুই রাষ্ট্র ভিত্তিক’ সমাধানের কথা বলা হয়েছিল। এ সমঝোতা অনুসারে ইসরাইল ও ফিলিস্তিন দু’টি স্বাধীন দেশ হিসেবে পাশাপাশি থাকবে এবং এক দেশ অন্য দেশকে স্বীকৃতি দেবে। পরিকল্পনা অনুসারে, ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধ-পূর্ববর্তী পশ্চিম তীর ও গাজা নিয়ে গঠিত হবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র। সেখান থেকে ইহুদি বসতিগুলো প্রত্যাহার করা হবে। কোনো বিশেষ অঞ্চল ইসরাইল নিরাপত্তাগত কারণে নিজ ভূখণ্ডের অন্তর্ভুক্ত করতে চাইলে সমঝোতার ভিত্তিতে এর বিনিময় ভূখণ্ড ফিলিস্তিনকে দেয়া হবে। আলোচনায় নিষ্পত্তির বিষয়ের মধ্যে ছিল জেরুসালেমের অধিকার ও শরণার্থী প্রত্যাবাসনের বিষয়। অসলো চুক্তি স্বাক্ষরের সময়েই পশ্চিম তীরে নতুন কোনো ইহুদি বসতি তৈরি না করার সিদ্ধান্ত ছিল।

পরে বিশেষত নেতানিয়াহুর আমলে আন্তর্জাতিক আপত্তিকে উপেক্ষা করেই ইহুদি বসতি পশ্চিম তীরে অব্যাহতভাবে সম্প্রসারণ করা হয়। ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত ‘অসলো চুক্তি’কে সামনে রেখে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের ব্যাপারে আমেরিকা আলোচনায় মধ্যস্থতা করেছে। ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর তিনি ইহুদি জামাতা কুশনারকে মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক উপদেষ্টা নিয়োগ করেন এবং তাকে নতুনভাবে শান্তি প্রক্রিয়া শুরু করার দায়িত্ব দেন। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের কার্যক্রম একতরফা হয়ে যায়। ট্রাম্প শান্তি পরিকল্পনা ঘোষণার তারিখ কয়েক দফা পরিবর্তন করেছেন। তবে শান্তি চুক্তির বিভিন্ন অংশ ইসরাইলি পত্রিকাগুলোর মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। ট্রাম্প চূড়ান্তভাবে যেটি প্রকাশ করেছেন, তার সাথে ফাঁস করা দলিলের প্রায় ৯০ শতাংশ মিল রয়েছে।

বস্তুত ট্রাম্পের পরিকল্পনায় চার বছরের যে অন্তর্বর্তী সময় নেয়া হয়েছে, তার মধ্যে পিএলও নেতৃত্ব, যেমন মাহমুদ আব্বাসসহ জাতীয়তাবাদী নেতাদের বিদায় করে ইসরাইল ও আমিরাতপন্থী নেতাদের বসানো হবে। চেষ্টা করা হবে হামাসের হাত থেকে গাজাকে অধিগ্রহণ করে নতুন পিএলও নেতৃত্বের হাতে গাজার নিয়ন্ত্রণ তুলে দেয়ার। এর মধ্যে সব কাজ সম্পন্ন করা গেলে তখন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ধরনের মৌলিক উপাদানহীন ‘ফিলিস্তিন রাষ্ট্র’ গঠন করা হবে।

সাধারণভাবে রাষ্ট্রের প্রধান উপাদান হলো সার্বভৌমত্ব। ট্রাম্পের পরিকল্পনা অনুসারে চার বছর পর যে ফিলিস্তিন গঠিত হবে, সেটির সীমানা ও আকাশ নিয়ন্ত্রণ করবে ইসরাইল। ফিলিস্তিনের কোনো সামরিক বাহিনী অথবা স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি থাকবে না। প্রকৃতপক্ষে ট্রাম্প যে পরিকল্পনা উপস্থাপন করেছেন, সেটি হলো বৃহত্তর ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য ভূমি গ্রাসের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা। ইসরাইলকে তিনি পশ্চিম তীরের যে ৩০ থেকে ৪০ ভাগ স্থান দেয়ার কথা বলেছেন, সেটিকে ইসরাইল পুরোপুরি কব্জা করবে। সেখানে নামমাত্রও কোনো অধিকার থাকবে না ফিলিস্তিনিদের। শান্তি প্রক্রিয়া ও আলোচনার নামে হামাস ও সহযোগী কয়েকটি দল ছাড়া বাকি সব ফিলিস্তিনি সংগঠন এর মধ্যে সশস্ত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থা পরিত্যাগ করেছে।

ট্রাম্পের পরিকল্পনার বিশেষ দিকটি হলো, তিনি যা প্রকাশ করেছেন তা বাস্তবায়নের কাজ আগেভাগেই শুরু করেছেন। পরিকল্পনা প্রকাশ করে তিনি বলেছেন, জেরুসালেম ইসরাইলের অখণ্ড রাজধানী হবে। এর মধ্যেই জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইসরাইলের দূতাবাস তিনি সরিয়ে নিয়েছেন সেখানে। ট্রাম্প প্রশাসন পশ্চিম তীরে ইহুদি পুনর্বাসনের কার্যক্রমকেও বৈধ হিসেবে আগেই স্বীকৃতি দিয়েছেন। এখন বলছেন, পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতিগুলো (অধিকৃত পশ্চিম তীর ভূখণ্ডের শতকরা ৩০ থেকে ৪০ ভাগ) ইসরাইলের অংশ হবে। পরিকল্পনায় চার বছরের অন্তর্বর্তী সময় শেষে কথিত ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর আগে বাহরাইনে যে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রকাশ করা হয়েছে তাতেই স্পষ্ট করা হয় যে, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র এখন নয়, তার আগে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। এখন ট্রাম্পের পরিকল্পনায় বলা হচ্ছে, ফিলিস্তিনিরা নিজ দেশে ফেরার অধিকার পাবে না। আর আগে থেকেই ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের সহায়তাকারী জাতিসঙ্ঘ অফিসকে অর্থনৈতিক সহায়তা দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বলেছেন। তিনি ইসরাইলের নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে যেসব বিষয় উত্থাপন করেছেন, ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনায় সেগুলোকে স্থান দেয়া হয়েছে। ট্রাম্প দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের মৌলিক নীতিগুলো থেকে ব্যাপকভাবে বিচ্যুত হলেও মুখে বলেছেন, তিনি দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের পরিকল্পনাই পেশ করেছেন, যার ভিত্তি হলো জাতিসঙ্ঘের বিভিন্ন সময় নেয়া প্রস্তাব এবং আন্তর্জাতিক আইনগুলো। অথচ ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার আগে ওবামা প্রশাসনের সময় জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে সর্বশেষ যে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়, তার সাথে ট্রাম্প পরিকল্পনার মৌলিক ক্ষেত্রে কোনো মিল নেই।

ট্রাম্পের ফর্মুলায় মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আনা সম্ভব না হলেও ইসরাইলের পরিকল্পনা এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে এটি সহায়ক হবে শেষ পর্যন্ত। দৃশ্যত মনে হয়, ইমপিচমেন্ট এবং আরেক দফা নির্বাচনের সম্মুখীন ট্রাম্প এবং এক বছরের কম সময়ের মধ্যে তৃতীয় দফা নির্বাচনের মুখে থাকা নেতানিয়াহুর বিশেষ সুবিধার জন্য এই পরিকল্পনা প্রকাশ করা হয়েছে। তবে ইসরাইল রাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি একটি লক্ষ্যও এই পরিকল্পনার সাথে যুক্ত থাকতে পারে।

নেতানিয়াহুর তৃতীয় দফা নির্বাচনে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই কম বলে মনে হচ্ছে। দুর্নীতি মামলার প্রক্রিয়া থেকে দায়মুক্তি লাভের জন্য নেতানিয়াহু আইন করতে চেয়েছিলেন পার্লামেন্টে। নেসেটে এর তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখে তিনি সেটি প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। হয়তো এ কারণেই ট্রাম্প তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য নীল-সাদা জোট প্রধান বেনি গ্যান্টজকে ওয়াশিংটনে ডেকে নিয়েছেন। নেতানিয়াহুর বিরোধী বেনি গ্যান্টজ মার্চের নির্বাচনের আগে ট্রাম্প শান্তি পরিকল্পনা প্রকাশের বিষয়ে তার সমর্থন জানিয়েছিলেন এবং তিনি যদি নির্বাচিত হন তবে জর্দান উপত্যকায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে সমন্বয় করে ইসরাইলের সার্বভৌমত্ব বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এখন তিনি সে সমন্বয়ের বক্তব্য থেকে সরে এসেছেন। শেষ পর্যন্ত তিনি ট্রাম্পের পরিকল্পনার প্রতি পূর্ণ সমর্থনই জানিয়েছেন।

ট্রাম্প তার কথিত ‘শতকের সেরা চুক্তি’টি প্রকাশের অনুষ্ঠানে বাহরাইন, ওমান এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রদূতদের হোয়াইট হাউজে উপস্থিত করেছেন। তাদের মন্তব্যে মনে হয়েছে, ট্রাম্পের পরিকল্পনাকে এসব দেশ ইতিবাচকভাবে দেখে। মিসরের প্রতিক্রিয়াও এর কাছাকাছি। দেশটির নেতারা ট্রাম্পের পরিকল্পনাকে গভীরভাবে অধ্যয়নের কথা বলেছেন। সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান এর আগে এই চুক্তির প্রতি ইতিবাচক মত প্রকাশ করলেও বাদশাহ সালমান জেরুসালেমকে ইসরাইলের অখণ্ড রাজধানী করার বিরোধিতা করেছেন। তবে চুক্তি প্রকাশের বিতর্কিত অনুষ্ঠানে সৌদি মিত্র দুই দেশ ইউএই এবং বাইরাইনের প্রতিনিধি থাকার অর্থ, রিয়াদ ট্রাম্পের এই পরিকল্পনাকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করতে পারে।

ট্রাম্প আলোচনার পক্ষ হিসেবে ফিলিস্তিনকে বাদ দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে তার নীতির প্রতি অনুগত কয়েকটি আরব দেশকে স্থান দিয়েছেন। হোয়াইট হাউজের বক্তব্য অনুসারে, এই পরিকল্পনার মূল বিষয় নিয়ে নির্বাচিত আরব নেতা বিশেষত আমিরাতের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন জায়েদ ও সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সাথে কথা বলেছেন। ইসরাইলি পত্রিকার তথ্য অনুসারে, পরিকল্পনা প্রকাশের আগে ট্রাম্প মূল আরব শাসকদের অগ্রিম সম্মতি নিয়েছেন। জানুয়ারিতে হোয়াইট হাউজ সফরকারী সৌদি ডেপুটি প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রিন্স খালিদ বিন সালমানের সাথে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে কথাবার্তা হয়েছে। সৌদি প্রিন্স এ সময় ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনা প্রকাশে অনাপত্তির কথা জানান। মিসরের রাষ্ট্রপতি আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি এবং আমিরাতের শাসক শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদও এতে একমত হয়েছেন। অন্য দিকে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ ও জর্দানকেও এর বিষয়বস্তু সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে। ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে ট্রাম্পের এই শান্তি পরিকল্পনাকে। পাশ্চাত্যের অর্থনৈতিক সাহায্য সহযোগিতার ওপর নির্ভরশীল জর্দানও এই পরিকল্পনাকে গ্রহণ করেনি।

ফিলিস্তিনিদের অধিকার প্রতিষ্ঠার পথে সবচেয়ে শঙ্কার বিষয় হলো প্রভাবশালী আরব দেশগুলো ইসরাইল ও জায়নিজম সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে ফেলেছেন। জায়নিজম কোনো ধর্ম নয়, অনেক অ-ইহুদি জায়নবাদীও রয়েছেন; যারা অধিকৃত ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা বা প্রস্তাবকে সমর্থন করেন। জায়নিজমের সংজ্ঞায় তার সমর্থকদের ধর্ম সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়নি। ইসরাইলি লেখক শেরি ওজ জোর দিয়েছিলেন যে অ-ইহুদিরা ‘জায়নিস্ট’ হতে পারেন। এই বিবেচনায় প্রভাবশালী অনেক আরব শাসক এখন জায়নবাদে বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন।

গত সপ্তাহে, সাবেক সৌদি বিচারমন্ত্রী ও মুসলিম ওয়ার্ল্ড লিগ প্রধান ড. মোহাম্মদ আব্দুল করিম আল-ঈসা, পোল্যান্ডের ইহুদি গণহত্যার ৭৫তম বার্ষিকী উদযাপনের জন্য পোল্যান্ডের নাৎসি হলোকাস্টের স্মৃতি হিসেবে পরিচিত অশউইৎজ শিবির পরিদর্শন করেছেন। আল-ঈসা সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের (এমবিএস) একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী। তার এই সফরটি অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক অভিব্যক্তি বহন করে। বিশ্লেষকদের পর্যবেক্ষণ অনুসারে, এই শিবিরে আল-ঈসাকে পাঠিয়ে বিন সালমান ইসরাইলের পক্ষে তার সমর্থন প্রকাশের ইঙ্গিতই দিতে চেয়েছেন, যার সাথে ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনার ভূ-রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের যোগসূত্র থাকতে পারে।
যারা সৌদি আরবের সাম্প্রতিক সামাজিক ও রাষ্ট্রিক ব্যবস্থার রূপান্তরের প্রতি নজর রাখেন তারা মনে করছেন, পোল্যান্ড সফরকারী মোহাম্মদ বিন আবদুল-করিম ঈসার একটি ঘোষণাও তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেছেন, তারা দেশ-বিদেশে মসজিদে অর্থায়ন বন্ধ করে দেবেন, অ্যারাবি ২১ ডটকম এ তথ্যটি জানিয়েছে।

শীর্ষ আরব দেশগুলোর মৌলিক চেতনাগত দৃষ্টিভঙ্গির এই পরিবর্তনের শিকার হতে পারে ফিলিস্তিনিরা। ফলে নিশ্চিত করে বলা মুশকিল, ফিলিস্তিনিরা এবং তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল রাষ্ট্র ও জনগণ তাদের ন্যায়ানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠায় কতটা সামনে এগোতে পারে। তবে এর উল্টো একটি দিকও রয়েছে। ট্রাম্পের ঘোষণার পর তেলআবিব থেকে ইউসি মেলমান মিডল ইস্ট আইয়ে লিখেছেন, নিরাপত্তার দিক থেকে ইসরাইল, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (পিএ) এবং কার্যত সব আরব সরকারের অভিন্ন ধারণা, ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্যের পরিকল্পনা এতটা খারাপ এবং বিপজ্জনক হতে পারে যে এটি পুরো অঞ্চলকে অগ্নিশিখায় পরিণত করতে পারে।

এক সপ্তাহ ধরে ইসরাইলের নিরাপত্তা প্রধানরা ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, নেতানিয়াহুর ডানপন্থী সরকার যদি জর্দান উপত্যকা এবং ইহুদি জনবসতিগুলো সংযুক্ত করার জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্প সমর্থিত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে যায়, তবে পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকা বিস্ফোরিত হতে পারে। গোপন বৈঠকে শিন বেটের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা ও সেনাবাহিনীর ইসরাইল নিরাপত্তা কর্মকর্তারা তাদের ফিলিস্তিনি সহযোগীদের শান্ত করার চেষ্টা করছিলেন এবং তাদের একতরফা সিদ্ধান্তে যাওয়ার আগে অপেক্ষা করার আহ্বান জানান।

ইসরাইলের বৃহত্তম নিরাপত্তা উদ্বেগ হলো ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ দখলদার ইসরাইলি বাহিনীর সাথে তার নিরাপত্তা সহযোগিতা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেবে। যে বিষয়ে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের প্রধানমন্ত্রী অসলো চুক্তি থেকে সরে আসার কথা বলে। এটি হলে পশ্চিম তীরের নিরাপত্তা যে দায়িত্ব পিএ পালন করছে সেটি আর করবে না। ইসরাইলকে সরাসরি সেখানকার নিরাপত্তা বিধান করতে হবে। সেই সাথে অস্ত্র সমর্পণ করা গ্রুপগুলো আবার সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করতে পারে। এ পরিস্থিতি মোকাবেলা করা বেশ কঠিন ইসরাইলের জন্য।

এর মধ্যে আরো আশার আলো হলো জায়নবাদের কাছে আত্মসমর্পণকারী শাসকদের থেকে স্ব স্ব দেশের জনগণ ব্যাপকভাবে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করছে এবং মুসলিম বিশ্বে নতুন শক্তির উদয় হচ্ছে।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com