‘সম্পাদক পরিষদ’ ও দায়িত্ববোধ
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সাংবাদিক নিপীড়নের ঘটনার আলামত মোটেও শুভ নয়। কারণ, গণতন্ত্র ও সংবাদমাধ্যম একটি অপরটির পরিপূরক। সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠকে রুদ্ধ করে কোনো গণতান্ত্রিক দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা যায় না। বাকস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা মানুষের একটি মৌলিক অধিকার। অথচ অনেক দেশেই শাসকরা সেই অধিকার দিতে নারাজ। সংবাদমাধ্যম কিংবা গণমাধ্যমের ভূমিকা ক্ষমতাসীনদের মনঃপূত হলে কোনো অসুবিধা নেই। সমস্যা হলো, সত্য কথা বলার ক্ষেত্রে। শাসকরা অনেকসময় সত্য হজম করতে পারেন না। বাংলাদেশে এর দৃষ্টান্ত দিগন্ত টিভি, ইসলামিক টিভি, ‘আমার দেশ’ পত্রিকা।
দুঃখের বিষয় দেশের গণমাধ্যমের বাকস্বাধীনতার ওপর একের পর আঘাত এলেও একশ্রেণীর গণমাধ্যম প্রতিবাদ না করে উল্টো সরকারের সুরে কোরাস গাইছে। ওই সব মিডিয়ার কাছ থেকে জাতি বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ আশা করলেও তারা বাস্তবে সরকারি সম্প্রচারমাধ্যম বিটিভির সমানতালেই সক্রিয় রয়েছে। এসব কারণে বাকি দু-চারটি গণমাধ্যমকে একপ্রকার যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হচ্ছে। সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে দেশের সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। তবে অনেকের ভাগ্যে সমান আশ্রয় লাভের সুযোগ মেলে না। যেমনটি সম্প্রতি হয়নি প্রবীণ সাংবাদিক আবুল আসাদের ক্ষেত্রে। আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে প্রকাশ্য দিবালোকে এই সম্পাদকের ওপর হামলা করা হলো। নিয়ম অনুযায়ী, পুলিশের উচিত ছিল আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করা। কিন্তু পুলিশ সে মামলা করেনি। বরং আক্রান্ত সম্পাদকের বিরুদ্ধেই মামলা দায়ের করেছে।
আমরা জেনেছি, দৈনিক সংগ্রাম কর্তৃপক্ষ মামলা করতে চেয়েছিল। কিন্তু স্থানীয় থানা তা বারবার প্রত্যাখ্যান করেছে। অন্য দিকে, দৈনিক পত্রিকাগুলোর দায়িত্বশীল সংগঠন ‘সম্পাদক পরিষদ’ ছিল নিশ্চুপ। তারা একটি সভাও করেননি কিংবা একটি বিবৃতিও দেননি। আবুল আসাদ এ দেশের অন্যতম জ্যেষ্ঠ সম্পাদক যার লেখা অনেক বই রয়েছে। সম্প্রতি দৈনিক প্রথম আলোর সম্পাদকের বিরুদ্ধে একটি ওয়ারেন্ট ইস্যু হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সম্পাদক পরিষদ সভা করে এর নিন্দা করে। সংবাদমাধ্যম ফলাও করে এ খবর প্রকাশ করেছে। অপর দিকে, আবুল আসাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা ছিল না। তার সাথে অপরাধের ছিল না সংশ্লিষ্টতা। সম্পাদক পরিষদের পক্ষ থেকে এ সময় একটি বিবৃতি প্রদান করা কোনো অন্যায্য ব্যাপার ছিল না।
এ সম্পর্কে প্রথম আলোতে প্রকাশিত সংবাদটির কিছু অংশ তুলে ধরছি- প্রথম আলো সম্পাদক ও প্রকাশক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সম্পাদক পরিষদ। গত সোমবার পরিষদের সভাপতি মাহফুজ আনাম ও সাধারণ সম্পাদক নঈম নিজাম স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে এই উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। মতিউর রহমানকে জামিনের আদেশ দেয়ায় বিবৃতির শুরুতেই উচ্চ আদালতকে ধন্যবাদ জানানো হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে স্কুলছাত্র নাইমুল আবরার রাহাতের দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুকে ঘিরে প্রথম আলো সম্পাদক, সহযোগী সম্পাদক এবং চার কর্মীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি ও তাদের বাসায় পুলিশি তল্লাশির ঘটনায় সম্পাদক পরিষদ গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। বিবৃতিতে আরো বলা হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও তথ্যপ্রযুক্তি আইন প্রভৃতিসহ মানহানি মামলার আইনগুলোর ক্রমবর্ধমান অপব্যবহার বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে একটি নিবর্তনমূলক পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দিয়েছে এবং গণমাধ্যমকে প্রতিনিয়ত হয়রানি ও স্ব-আরোপিত নিয়ন্ত্রণের মুখে পড়তে হচ্ছে। এসব তৎপরতা বর্তমান পরিস্থিতির সাথে নতুন নেতিবাচক মাত্রা যোগ করবে। আমরা আশঙ্কা প্রকাশ করতে বাধ্য হচ্ছি, এ অবস্থায় স্বাধীনভাবে সাংবিধানিক নিশ্চয়তাপ্রাপ্ত ভূমিকা পালন করা গণমাধ্যমের জন্য উত্তরোত্তর কঠিন হয়ে পড়ছে। (প্রথম আলো, ২১ জানুয়ারি, ২০২০)
সম্পাদক আবুল আসাদের নানা সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে। মত ও পথ নিয়ে তার পছন্দ-অপছন্দের সমালোচনা হতে পারে। প্রকাশ্যে যখন এই ৭৮ বছর বয়সী, বর্ষীয়ান সাংবাদিককে প্রথমে লাঞ্ছনা এবং পরে নির্দয়তা দেখানো হলো, সম্পাদক পরিষদ তখন নিশ্চুপ ছিল। চোখ বন্ধ করা ছাড়া কোনোভাবে এমন অন্যায়কে সমীচীন মনে করা যায় না। প্রথম আলোর সম্পাদকের বেলায় আইনি ব্যবস্থা যখন দ্রুত সামনে এলো, সম্পাদক পরিষদ দ্রুততার সাথে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। সম্পাদক পরিষদ সাংবাদিকতার অধিকার রক্ষায় দ্রততার সাথে দায়িত্ব পালন করবে- এটাই সাংবাদিক সমাজ প্রত্যাশা করে। দৈনিক সংগ্রামের সম্পাদক আবুল আসাদের পরিষদের পক্ষ থেকে একই ধরনের আচরণ পাওয়াই ছিল সঙ্গত। এতে করে সম্পাদক পরিষদের গ্রহণযোগ্যতা জাতির কাছে আরো বেড়ে যাওয়া ছাড়া কমত না।
যে অজুহাতে আবুল আসাদকে গ্রেফতার করে কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়েছে, তা কি স্বাধীন গণমাধ্যমের জন্য হুমকির বার্তা নয়? আসাদ প্রতিভাবান এবং সত্যিকারের একজন ভালো মানুষ, সে কথা সবাই জানেন। ‘সংগ্রাম’ পত্রিকা নিয়ে যাদের আপত্তি আছে, তারাও এর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি। সংগ্রামের সাথে মতের পার্থক্য থাকতে পারে কিংবা এর প্রতি ক্ষোভ থাকতে পারে, কিন্তু দেশের স্বার্থে এবং বাংলাদেশের মানুষের মতপ্রকাশের অধিকারের স্বার্থে আবুল আসাদের অধিকার নিয়ে কথা বলা উচিত ছিল। দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, সম্পাদক পরিষদ তা করতে পারেনি।
প্রবীণ সাংবাদিক আবুল আসাদ শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। শরীরের হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ অস্বাভাবিক পরিমাণে কমে যাওয়ায় ডাক্তার চিকিৎসার সাথে সাথে বিশ্রামে থাকতে বলেছেন। কিন্তু সেটি তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। গত ১০ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তরে তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘বর্তমান সরকারের সময়ে সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করছে’। তিনি আরো বলেছেন, ‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার স্বাধীনভাবে সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে সরকার কোনো রকম হস্তক্ষেপ করছে না।’ অথচ আবুল আসাদের মতো প্রবীণ সম্পাদককে কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে। ২০১৩ সালে ‘হেফাজতে ইসলামে’র একটি সমাবেশকে কেন্দ্র করে সরকার এক নির্বাহী আদেশে ইসলামিক টিভি ও দিগন্ত টেলিভিশন বন্ধ করে দিয়েছে। তখনো আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, নতজানু একশ্রেণীর গণমাধ্যম সরকারের পক্ষে ভূমিকা রেখেছে। এমন বিভক্ত সাংবাদিক সমাজ বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের সুস্থ বিকাশের ক্ষেত্রে বড় বাধা। এমন অবস্থান থেকে সাংবাদিক সমাজ যত দ্রুত সরে আসবে, ততই সবার জন্য মঙ্গল।
লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার