স্মরণ শক্তি বাড়ানোর সহজ দোয়া ও আমল
স্মৃতিশক্তি মানুষের অমূল্য সম্পদ। সঠিক ব্যবহারে মানুষের স্মৃতিশক্তি অটুট থাকে এবং ধীরে ধীরে তা বাড়তে থাকে। আল্লাহ তাআলা মানুষকে স্মৃতিশক্তি বাড়াতে দোয়া, জিকির বেশ কিছু কাজের প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন। কুরআন-সুন্নাহর আলোকে স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর ১০টি সহজ উপায় তুলে ধরা হলো। যে উপায়গুলো শুধু স্মৃতিশক্তি বাড়িয়ে দেবে এমনই নয় বরং তা মানুষের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতায় যথাযথ কার্যকরী। তাহলো-
১. দোয়া ও জিকির
আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কোনো কাজেই সফলতা অর্জন করা সম্ভব নয়। এজন্য মুমিন মুসলমানের উচিত সর্বদা আল্লাহর কাছে দোয়া ও জিকির করা যাতে তিনি সবার স্মৃতিশক্তি বাড়িয়ে দেন এবং কল্যাণকর জ্ঞান দান করেন। এক্ষেত্রে কুরআনুল কারিমের এ দোয়াটি বেশি বেশি পাঠ করা-
رَّبِّ زِدْنِي عِلْمًا
উচ্চারণ : ‘রাব্বি যিদনি ইলমা’
অর্থ : হে আমার পালনকর্তা! আমার জ্ঞান বাড়িয়ে দিন।’ (সুরা ত্বহা : আয়াত ১১৪)
২. গোনাহ থেকে বিরত থাকা
আলো ও অন্ধকার এক সঙ্গে থাকতে পারে না। জ্ঞান হলো আলো আর গোনাহ হলো অন্ধকার। তাই জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হতে হলে অবশ্যই গোনাহ থেকে দূরে থাকতে হবে। তবেই মানুষের স্মরণ শক্তি লোপ পাবে না। তা দিন দিন বাড়বে।
প্রতিনিয়ত পাপ করে যাওয়ার একটি প্রভাব হচ্ছে স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে যাওয়া। পাপের অন্ধকার ও জ্ঞানের আলো কখনো একসঙ্গে থাকতে পারে না। ইমাম শাফেঈ রাহিমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন-
‘আমি (আমার শাইখ) ওয়াকিকে আমার খারাপ স্মৃতিশক্তির ব্যাপারে অভিযোগ করেছিলাম এবং তিনি শিখিয়েছিলেন আমি যেন পাপকাজ থেকে নিজেকে দূরে রাখি। তিনি বলেন- আল্লাহর জ্ঞান হলো একটি আলো এবং আল্লাহর আলো কোনো পাপচারীকে দান করা হয় না।’
হজরত ইয়াহইয়া বিন ইয়াহইয়া বলেন, ‘এক ব্যক্তি মালিক ইবনে আনাসকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘হে আল্লাহর বান্দা! আমার স্মৃতিশক্তিকে শক্তিশালী করে দিতে পারে এমন কোনো কিছু কি আছে? তিনি বলেন, যদি কোনো কিছু স্মৃতিকে শক্তিশালী করতে পারে তা হলো পাপ করা ছেড়ে দেয়া।’ (আল-খাতিব আল-জামি)
সুতরাং যখন কোনো মানুষ পাপ করে এটা তাকে উদ্বেগ ও দুঃখের দিকে ধাবিত করে। সে তার কৃতকর্মের ব্যাপারে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে ভোঁতা হয়ে যায় তার অনুভূতি এবং জ্ঞান অর্জনের মতো কল্যাণকর আমল থেকে সে দূরে সরে পড়ে। তাই আমাদের উচিত পাপ থেকে দূরে থাকার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা।
৩. ইখলাস বা আন্তরিক
সফলতা অর্জনে যেমন ইখলাস বা আন্তরিকতার বিকল্প নেই। তেমনি স্মৃতিশক্তি ভালো রাখতেও ইখলাসের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। আর ইখলাসের মূল উপাদানই হচ্ছে বিশুদ্ধ নিয়ত। আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘তাদেরকে এছাড়া কোরো নির্দেশ করা হয়নি যে, তারা খাঁটি মনে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে, নামাজ কায়েম করবে এবং জাকাত দেবে। এটাই সঠিক ধর্ম।’ (সুরা আল-বায়্যিনাহ : আয়াত ৫)
এ জন্যই স্মরণশক্তি ধরে রাখা কিংবা বাড়ানোর মূলমন্ত্রও কাজের প্রতি নিয়তের বিশুদ্ধতা, ইখলাস তথা যথাযথ আন্তরিকতা রাখা। এ সম্পর্কে বিশ্বনবি বলেন, ‘ব্যক্তির সব আমলই নিয়তের উপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ যার নিয়ত যত পরিশুদ্ধ ও ইখলাসপূর্ণ হবে তার কাজ তত মজুবত হবে।
ইসলামিক স্কলার খুররাম মুরাদ বলেন, ‘উদ্দেশ্য বা নিয়ত হল আমাদের আত্মার মত অথবা বীজের ভিতরে থাকা প্রাণশক্তির মত। বেশীরভাগ বীজই দেখতে মোটামুটি একইরকম, কিন্তু লাগানোর পর বীজগুলো যখন চারাগাছ হয়ে বেড়ে উঠে আর ফল দেয়া শুরু করে তখন মানুষের কাছে বীজের আসল পার্থক্যটা পরিস্কার হয়ে যায়। একইভাবে নিয়ত যত বিশুদ্ধ হবে আমাদের কাজের ফলও তত ভালো হবে।’
সুতরাং মুমিন মুসলমানের নিয়ত এমন হতে হবে যে, আল্লাহ আমাদের স্মৃতিশক্তি যেনো একমাত্র ইসলামের কল্যাণের জন্যই বাড়িয়ে দেন।
৪. স্মরণ রাখার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখ
সবার মুখস্থ করার পদ্ধতি বা স্মৃরণ রাখার শক্তি এক নয়। কারো শুয়ে পড়লে তাড়াতাড়ি মুখস্থ হয়, কারো আবার হেঁটে হেঁটে পড়লে তাড়াতাড়ি মুখস্থ হয়। কেউ নীরবে পড়তে ভালোবাসে, কেউবা আবার আওয়াজ করে পড়ে। কারো ক্ষেত্রে ভোরে তাড়াতাড়ি মুখস্থ হয়, কেউবা আবার গভীর রাতে ভালো মুখস্থ করতে পারে। তাই আমাদের প্রত্যেকের উচিত নিজ নিজ উপযুক্ত সময় ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ঠিক করে তার যথাযথ ব্যবহার করা। আর কুর’আন মুখস্থ করার সময় একটি নির্দিষ্ট মুসহাফ (কুর’আনের আরবি কপি) ব্যবহার করা। কারণ বিভিন্ন ধরনের মুসহাফে পৃষ্ঠা ও আয়াতের বিন্যাস বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। একটি নির্দিষ্ট মুসহাফ নিয়মিত ব্যবহারের ফলে মস্তিষ্কের মধ্যে তার একটি ছাপ পড়ে যায় এবং মুখস্থকৃত অংশটি অন্তরে গভীরভাবে গেঁথে যায়।
৫. নিয়মিত আমল করা
স্মৃতিতে থাকা বিষয়গুলোর উপর আমল করা। পড়ার জিনিস হলে তা বার বার পড়া। কাজের বিষয় হলে সংশ্লিষ্ট কাজে নিয়োজিত থাকা। কাজের বিষয়ে যতবেশি আমল বা বাস্তব প্রয়োগ হবে স্মৃতিশক্তি তত ঠিক থাকবে। এমনকি স্মৃতিশক্তি বেড়ে যাবে। মস্তিষ্কে বিষয়গুলো স্থায়ীভাবে জমে যাবে।
৬. অন্যকে শেখানোর দায়িত্ব পালন করা
স্মৃতিশক্তি ঠিক রাখার অন্যতম মাধ্যম নিজের শেখা জিনিসগুলো অন্যকে শেখানো। অন্যকে শেখানোর মাধ্যমে নিজের স্মৃতিশক্তি ঠিক থাকবে। একই বিষয় বারবার করলে তা স্মৃতিতে থাকবে অমলিন ও স্থায়ী। তাই জানা জিনিসগুলো বারবার
৭. পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করা
স্মৃতিশক্তি বাড়াতে উপযুক্ত খাদ্যাভ্যাসের বিকল্প নেই। মস্তিষ্কের গঠন ও উন্নতির জন্য উপযোগী খাবার গ্রহণ করা। স্মৃতি শক্তি বাড়াতে পরিমাণ মতো আমিষ, চর্বি ও শর্করা, শব্জি ও শক্তিবর্ধক খাদ্য মধু, যয়তুন, দুধ ইত্যাদি পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার খাদ্য তালিকায় রাখা স্মৃতিশক্তি ও মস্তিষ্কের কার্যকারিতায় জরুরি।
ইমাম জুহরি রাহমাতুল্লাহি আলাইহির মতে, স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধিতে মধু ও কিসমিস খাওয়া উচিত। এ সম্পর্কে তিনি বলেন-
> ‘তোমাদের মধু পান করা উচিত; কারণ এটি স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধির জন্য উপকারী।’ মধুতে রয়েছে মুক্ত চিনিকোষ যা মস্তিষ্কের গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মধু পান করার পর সাত মিনিটের মধ্যেই রক্তে মিশে গিয়ে কাজ শুরু করে দেয়।
> যে ব্যক্তি হাদিস মুখস্থ করতে চায়; তার উচিত কিসমিস খাওয়া।’
৮. যথাযথ বিশ্রাম নেওয়া
স্মৃতিশক্তি বাড়াতে মস্তিষ্ককে বিশ্রাম দেয়ার বিকল্প নেই। মস্তিষ্ককে বিশ্রাম দিতে হলে অবশ্যই নিরিবিলি কোলাহল মুক্ত পরিবেশে সময় কাটানো। কাজের ফাঁকে ফাঁকে সময় ও ক্ষণ অনুযায়ী সামান্য সময় হলেও বিশ্রাম নেয়া জরুরি। এ বিশ্রাম মানুষের ক্লান্তি ও অবসাদকে দূর করে দেয়। স্মৃতিশক্তি বাড়াতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। এটি বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাতও বটে।
৯. অপ্রয়োজনীয় কাজ ছেড়ে দেওয়া
প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো স্মৃতিতে জমা রাখতে অপ্রয়োজনীয় বিষয় ও কাজ ছেড়ে দেয়া জরুরি। অনেক সময় দেখা যায়, নামাজ পড়ার সময় কত আয়াত নামাজ পড়া হলো তাই স্মরণ করা কষ্ট হয়ে যায়। সে কারণে অপ্রয়োজনীয় কাজে মন ও স্মৃতিকে ব্যস্ততায় নিমজ্জিত না করা। অযথা আড্ডা-গান, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সময় ব্যয় না করা।
১০. আল্লাহর ওপর ভরসা করা
স্মরণ রাখা কষ্টসাধ্য কাজ। কোনো কিছুই মনে রাখতে পারছেন না! তাই হতাশ হওয়ার কিছু নেই। স্মরণ রাখার প্রচেষ্টাই স্মৃতিশক্তি বাড়িয়ে দেবে। আশাহত না হয়ে যে কোনো কাজে নিয়মিত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ায়। স্মৃতিশক্তি বাড়াতে মহান আল্লাহর ওপর প্রচণ্ড আস্থা ও বিশ্বাস রেখে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার বিকল্প নেই।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে উল্লেখিত বিষয়গুলোর প্রতি যথাযথ যত্নবান হওয়ার তাওফিক দান করুন। গোনাহমুক্ত জীবন গড়ার মাধ্যমে নিজেদের স্মৃতিশক্তি অটুট রাখাসহ তা আরও বাড়ানোর তাওফিক দান করুন। আমিন।