মিয়ানমারকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করালেন যিনি
গাম্বিয়ার আইন ও বিচারমন্ত্রী আবু বকর তাম্বাদুর কারণেই নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগ শহরে বিশ্ব আদালতে (আইসিজে) উপস্থিত হতে হয়েছে মিয়ানমারের নেতা অং সান সুচিকে। তিনি যদিও বলেছেন যে, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী কোনো গণহত্যা সংঘটন করেনি। কিন্তু অন্তত এটুকু তাকে স্বীকার করতে হয়েছে যে, রোহিঙ্গা বিতাড়ন ও অন্যান্য নৃশংসতার মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকতে পারে। শেষ অবধি জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালত মিয়ানমারকে এই নির্দেশ দিয়েছে যে, ফের যেন পাইকারি হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত না হয়, সেজন্য উদ্যোগ নিতে হবে মিয়ানমারকে। কিন্তু যে লোকটির কারণে বিশ্বের কাছে জবাবদিহি করতে হচ্ছে মিয়ানমারের নেতা ও একজন নোবেল পুরস্কার বিজয়ীকে, সেই ব্যক্তিটি আসলে কে? বিবিসি’র একটি প্রতিবেদনে আলোচনা করা হয়েছে আবু বকর তাম্বাদুকে নিয়ে।
এতে বলা হয়, বেশ অপ্রত্যাশিতভাবেই বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শনে এসেছিলেন তাম্বাদু। ওই সময় শরণার্থীদের কাছ থেকে তিনি এমন সব ভয়াবহ ঘটনার বর্ণনা শুনেছেন যে, তার মনে হয়েছিল সীমান্তের ওপার থেকে গণহত্যার দুর্গন্ধ বয়ে এসেছে বাংলাদেশে। তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘ঠিক তখনই আমি বুঝতে পারি যে, টেলিভিশনের পর্দায় দেখা কয়েকটি ফ্ল্যাশে যা দেখানো হয়, তার চেয়ে আরো অনেক বেশি ভয়াবহ ও গুরুতর এই সংকট। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধভাবে আক্রমণ করেছে সামরিক বাহিনী ও বেসামরিক লোকেরা।
তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। মায়ের কোল থেকে শিশুকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। জীবন্ত আগুনে ফেলে দেয়া হয়েছে। পুরুষদেরকে একত্র করে হত্যা করা হয়েছে। মেয়েদের গণধর্ষণ করা হয়েছে। সব ধরনের যৌন সহিংসতা ঘটেছে।’
এই ভয়ঙ্কর সব বর্ণনা তাম্বাদুকে মনে করিয়ে দেয় ১৯৯৪ সালে সংঘটিত রুয়ান্ডা গণহত্যার ঘটনাবলীর কথা। ওই গণহত্যায় নিহত হয়েছিল প্রায় ৮ লাখ মানুষ। তার ভাষ্য, ‘(রোহিঙ্গাদের বর্ণনা) অনেকটাই রুয়ান্ডায় তুতসিদের বিরুদ্ধে সংঘটিত নৃশংসতার মতোই। ঠিক একই ধরনের ছিল পুরো ঘটনাচক্র। রোহিঙ্গাদের অমানুষ হিসেবে উপস্থাপন করা, তাদের আত্মপরিচয় অস্বীকার করা- সব কিছুই গণহত্যার সাক্ষ্য বহন করছে। আমি তখন এই সিদ্ধান্তে এলাম যে, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণ অর্থে রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীকে ধ্বংস করে দেয়ার প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছিল।’
তবে মিয়ানমার গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করেছে। এই সপ্তাহে রোহিঙ্গা সংকটে সরকারের করা তদন্ত প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে পাইকারি হত্যাযজ্ঞকে আখ্যায়িত করা হয়েছে মুসলিম জঙ্গিদের হামলার প্রতিক্রিয়ায় সামরিক বাহিনীর ‘এলোমেলো’ পদক্ষেপ হিসেবে। প্রসঙ্গত, গণহত্যার অপরাধ প্রমাণের ক্ষেত্রে অভিযুক্তের এই হত্যাযজ্ঞ চালানোর ‘অভিপ্রায়’ ছিল বলে প্রমাণ করতে হয়। এ কারণে, জাতিসংঘ আদালতের রায় দেয়ার কয়েকদিন আগে এই প্রতিবেদন প্রকাশকে অনেকেই মনে করছেন কর্তৃপক্ষকে দায়মুক্তি দেয়ার চেষ্টা হিসেবে। আদালতে অং সান সুচিও এই তদন্ত প্রতিবেদনকে উদ্ধৃত করে যুক্তি দেখিয়েছেন যে, স্থানীয় তদন্তের কারণে আন্তর্জাতিক তদন্তের প্রয়োজনীয়তা আর নেই।
তাম্বাদু যখন রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের বর্ণনা শুনছিলেন, তখন তিনি মনে মনে ঠিক করেন যে, কিছু না করে বসে থাকা যাবে না। ক্ষুব্ধ স্বরে তিনি বলেন, ‘এখানে মানবিকতার প্রশ্ন জড়িত। ব্যক্তিগতভাবে আমি যা শুনেছি ও দেখেছি, তাতে ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম। আমি মনে করলাম, মিয়ানমারকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। আর এ ধরনের একটি উপায় হতে পারে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) মামলা করা।’ আইসিজে শেষ অবধি তার পক্ষেই রায় দিলো। ফের গণহত্যা সংঘটিত যেন না হয়, সেই ব্যবস্থা দেয়ার নির্দেশ দিলো মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। রায়ের প্রতিক্রিয়ায় তাম্বাদু বলেছেন, তিনি অনেক খুশি। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি আন্তর্জাতিক আইন ও বিচারের জন্য এটি একটি বড় বিজয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই রায় দিয়েছে যে, গণহত্যা কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয়।’
তবে রুয়ান্ডা গণহত্যার বিচারে জাতিসংঘের করা ট্রাইব্যুনালে কৌঁসুলির দায়িত্ব পালন করা তাম্বাদুর ভাষ্য স্রেফ ভাগ্যবশতই তিনি রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শনে গিয়েছিলেন।
মানবাধিকার সংস্থা গ্লোবাল সেন্টার ফর রেসপন্সিবিলিটি টু প্রোটেক্ট-এর প্রধান সাইমন অ্যাডামস বলেন, মাত্র একজন ব্যক্তিই সাহস, দক্ষতা ও মানবিকতা নিয়ে মিয়ানমারকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। তার মতে, ‘অনেকেই তখন চীনের প্রতিশোধের ভয়ে ছিলেন। অনেকে বলছিল যে, সময় এখন ভালো নয়। রাজনৈতিকভাবে খুব ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে। কিন্তু তাম্বাদু যে অকুতোভয় ভূমিকা রেখেছেন, আমি তাতে মুগ্ধ। তিনি জানতেন, কী ধরনের চাপ আসবে। কিন্তু তিনি ওই চাপ সামলানোর জন্যও কৌশল ঠিক করছিলেন।’
এই গুণ তাম্বাদু রপ্ত করেছেন নিজের তরুণ বয়সে। ১৯৭২ সালে জন্ম নেয়া তাম্বাদু বড় হয়েছেন ক্ষুদ্র রাষ্ট্র গাম্বিয়ার রাজধানী বনজুলে। ১৮ ভাইবোন ছিল তার। তার পিতার ছিল তিন স্ত্রী। তরুণ বয়সে তিনি ফুটবল খেলতেন। জাতীয় দলের জার্সিও পরার সৌভাগ্য হয়েছিল। তবে বিনয় নিয়েই হয়তো বললেন, ‘আমি অত খারাপ খেলোয়াড় ছিলাম না।’
শৈশব নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি সৌভাগ্যবান।’ তার মধ্যবিত্ত পরিবার তাকে বাসায় মাধ্যমিক শিক্ষা দিতে পেরেছিল। পেরেছিল বৃটিশ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে। তবে তিনি সবসময় আতঙ্কে থাকতেন এই বুঝি পিতার প্রত্যাশা পূরণে তিনি ব্যর্থ হবেন। এ কারণে খেলাধুলা ছেড়ে পড়াশুনার দিকেই মনোযোগী হয়েছিলেন। তার ভাষ্য, ‘আমি কখনই কল্পনা করিনি যে, আইন নিয়ে পড়বো। কিন্তু প্রথম যে বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাই, সেখানে আমাকে আইন নিয়ে পড়ার সুযোগ দেয়া হয়। তখনই আমার ক্যারিয়ারের বাঁক পরিবর্তন হয়।’
পড়াশুনা শেষে তিনি দেশে ফিরেন। প্রথম দিকে সরকারি কৌঁসুলি হিসেবে কাজ করেন। গাম্বিয়ায় তখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভালো ছিল না। তিনি ও তার বন্ধুবান্ধব তখন মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে সোচ্চার হতে থাকেন। ২০০০ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াইয়া জামের কুখ্যাত নিরাপত্তা বাহিনী শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালায়। নিহত হয় ১৪ শিক্ষার্থী, ১ সাংবাদিক ও রেডক্রস স্বেচ্ছাসেবক। তখন তাম্বাদুর অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে সাজা দেয়া হয়। নির্যাতন করা হয়। তখন তার নিরাপত্তা নিয়ে পরিবারের চাপেই দেশ ছেড়ে বিদেশে যান তাম্বাদু। এরপরই আন্তর্জাতিক আইন ও বিচার নিয়ে শুরু হয় তার ক্যারিয়ার। স্বেচ্ছানির্বাসনে থাকা অবস্থাতেই তিনি জাতিসংঘের আদালতে কাজ করেন। চেষ্টা করেন রুয়ান্ডা গণহত্যার পালের গোদাদের আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর। তিনি সাবেক রুয়ান্ডান সেনা প্রধান মেজর জেনারেল অগাস্টিন বিজিমুঙ্গুর বিচারকার্যে কৌঁসুলি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তখন তাম্বাদুর মনে হয়েছিল যে তিনি শুধু রুয়ান্ডান গণহত্যার জন্য দায়ীদেরই বিচারের কাঠগড়ায় আনছেন না। তার ভাষ্য, ‘এর মাধ্যমে আমরা আফ্রিকানরা আমাদের নেতাদেরও বার্তা দিচ্ছিলাম। আমি এই বিচারকে যতটা না ন্যায়বিচারের জন্য রুয়ান্ডার সংগ্রাম হিসেবে দেখছিলাম, তার চেয়েও বেশি দেখছিলাম আফ্রিকান সংগ্রাম হিসেবে।’ ২০১৭ সালে ইয়াহিয়ার পতন হয় জাম্বিয়ায়। দেশে ফিরেন তাম্বাদু। এরপর ২৩ বছরে গাম্বিয়ার প্রথম নির্বাচিত নেতা প্রেসিডেন্ট আডামা ব্যারোর মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন।
আইনমন্ত্রী হিসেবেই তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে নিউ ইয়র্কে সফর করেছিলেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী উসাইনু ডারবুর আসার কথা ছিল বাংলাদেশ সফরে। কিন্তু ডারবু যেতে পারছিলেন না। তার বদলে সফরে যেতে বলা হয় তাম্বাদুকে। নিজের ডায়েরি দেখে তাম্বাদু জবাবে বলেন, ‘কেন নয়?’ বাকিটা ইতিহাস।