এমপি হয়েই শেখ তাপসের টাকার গাছ

0

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র পদপ্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপসের জন্য ২০০৮ সালে ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য হওয়াটা যেন ছিল টাকা-পয়সা আর সম্পদ বানানোর টিকেট।

গত ১২ বছরে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনে (ইসি) শেখ তাপসের জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক হলফনামাগুলো বিশ্লেষণ করলে তিনি কতটা সম্পদ অর্জন করেছেন সেটা যেমন বোঝা যায়, তেমনই মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে তিনি কিভাবে এই সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলতে পারলেন সেই প্রশ্নও জাগে।

তাপসের নির্বাচনী হলফনামা ও অন্যান্য আর্থিক নথিপত্র বিশ্লেষণ করে সুইডেন ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম। এ সময় একটি নতুন প্রাইভেট ব্যাংকে তার বিনিয়োগ এবং একটি রহস্যজনক মৎস্য খামারে তার মালিকানার বিষয়ে জানতে পারে সংবাদ মাধ্যমটি।

২০০৮ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে শেখ তাপসের সম্পদ বৃদ্ধির হার যে তাক লাগানোর মতো ছিল সেই খবর বাংলাদেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে আগেই প্রকাশিত হয়েছিল। তবে ২০১৩ সালে ব্যবসা শুরু করা মধুমতি ব্যাংকে তার বড় একটি বিনিয়োগের বিষয়ে খুব একটা আলোচনা হয়নি। এই ব্যাংকটির ৩২ মিলিয়ন শেয়ার তাপসের, তিনিই এর সর্ববৃহৎ অংশীদার। ১০ টাকা মূল্যের প্রতিটি শেয়ারের হিসাবে তিনি ৩২ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে এই শেয়ারগুলো কিনেছেন।

২০০৮ সালে যার বার্ষিক আয় ছিল ২২ লক্ষ টাকা আর অস্থাবর সম্পত্তি ছিল ১.৬ কোটি টাকার কিছু বেশি, সেই শেখ ফজলে নূর তাপস কিভাবে একটি প্রাইভেট ব্যাংকের প্রধান উদ্যোক্তা হতে পারলেন, আর সেই সাথে আরও বেশি স্থাবর সম্পত্তির মালিকও হলেন? (২০০৮ সালে তার স্থাবর সম্পত্তি ছিল মাত্র কয়েক কোটি টাকার)।

এর উত্তরটি রয়েছে ২০১৩ সালে ইসিতে দাখিল করা শেখ তাপসের হলফনামার সাথে সংযুক্ত তারই ২০১২/১৩ অর্থবছরের আয়কর সনদটিতে। এই সনদেই তাপস বলছেন যে তিনি টুঙ্গিপাড়া ফিশারিজ নামক একটি প্রতিষ্ঠান থেকে ৩৫ কোটি “প্রত্যাহার” করে নিয়ে সেই টাকা দিয়েই মধুমতি ব্যাংকের শেয়ার কিনেছেন। যদিও এই মৎস্য প্রকল্পটির অস্তিত্ব নিয়েই সন্দেহের অবকাশ আছে।

শেখ তাপসের নির্বাচনী হলফনামাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে তিনি ২০০৮ এবং ২০১৩ সালের মাঝামাঝি কোন এক সময়ে টুঙ্গিপাড়া ফিশারিজের মালিক হোন। ২০১৩ সালের হলফনামা অনুযায়ী এই মৎস্য খামারে তার ভাগ ছিল ১২.৯ কোটি টাকা এবং তার স্ত্রীর ভাগ ছিল ১.৩ কোটি টাকা। আবার ২০১২/১৩ অর্থবছরে তিনি এই খামার থেকেই ৩৫ কোটি টাকা সরিয়ে একটি ব্যাংকে বিনিয়োগ করেছিলেন। এর মানে এই দাঁড়ায় যে কোন এক সময়ে এই মৎস্য খামারটির মোট মূল্য ছিল কমপক্ষে ৪৮ কোটি টাকা। সেক্ষেত্রে এই খামারটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় মৎস্য প্রকল্পগুলোর মধ্যেই স্থান করে নিয়েছিল এমনটিই বলতে হবে। অথচ হলফনামার তথ্যমতে এমন একটি বড় খামার থেকে তাপস ওই বছর কোন আয়ই করেননি। হলফনামায় “ব্যবসা থেকে আয়” কলামটি তিনি খালিই রেখে দিয়েছেন।

গোপালগঞ্জ জেলায় মৎস্য ব্যবসার সাথে জড়িতরা জানান, তাদের কেউই অতীতে বা বর্তমানে টুঙ্গিপাড়া উপজেলায় এমন কোন মৎস্য খামারের অস্তিত্বের সন্ধান দিতে পারেননি যেটি তাপসের বর্ণনার মৎস্য ব্যবসার সাথে মিলে। স্থানীয় একটি মৎস্য খামারের একজন অংশীদার জানান, “[পার্শ্ববর্তী] কোটালীপাডায় উন্নতমানের কিছু মৎস্য খামার রয়েছে যেগুলো বছরপ্রতি ১ থেকে ২ কোটি টাকার যোগান দিতে পারে, আমার জানা মতে টুঙ্গিপাড়ায় এমন কিছু নেই”। বাংলাদেশের ব্যবসায়িক নিবন্ধন তালিকাতেও টুঙ্গিপাড়া ফিশারিজ নামক কোন কোম্পানি নেই, তবে টুঙ্গিপাড়া অ্যাগ্রো ফিশারিজ এন্ড হ্যাচারি (প্রাইভেট) লিমিটেড নামক একটি কোম্পানি আছে।

বেশ কয়েক বছর আগে শেখ তাপসের মৎস্য ব্যবসা নিয়ে আরেকটি অনুসন্ধান করেছিল প্রথম আলো। ২০১৩ সালের ২৩শে ডিসেম্বর পত্রিকাটি ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে ২১জন প্রার্থীর মৎস্য ব্যবসা নিয়ে বিস্তারিত একটি প্রতিবেদন ছাপে। সেই সময় শেখ তাপসের ব্যাক্তিগত সহকারী তারেক শিকদার তাপসের বরাতে প্রথম আলোর প্রতিবেদকদের জানিয়েছিলেন যে তাপস এবং তার স্ত্রী টুঙ্গিপাড়ায় একটি মৎস্য খামারের মালিক। তবে “টুঙ্গিপাড়ার কোন স্থানে বা কি পরিমাণ জমিতে এই খামার রয়েছে” সে বিষয়ে তারেক শিকদার কিছুই বলতে পারেননি।

গোপালগঞ্জ জেলার মৎস্য কার্যালয়ের একজন কর্মকতার সাথেও কথা বলেছিলেন প্রথম আলোর সাংবাদিকরা, যিনি তাদের জানিয়েছিলেন যে বড় কোন হ্যাচারি টুঙ্গিপাড়ায় নেই। মৎস্য কার্যালয়ের কাছে শেখ ফজলে নূর তাপসের মৎস্যচাষে ব্যক্তিগত বিনিয়োগের কোন তথ্যও ছিলোনা। মৎস্য কর্মকর্তা সাংবাদিকদের আরও বলেছিলেন যে ১ কোটি টাকা বার্ষিক আয় আসে এমন কোন মৎস্য খামারের অস্তিত্ব টুঙ্গিপাড়ায় থাকাটাই অসম্ভব।

প্রথম আলোর প্রতিবেদনটিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সূত্র, কর আইনজীবী ও মৎস্য খাতে সংশ্লিষ্টদের বরাতে বলা হয়েছিল যে মৎস্য খাতে বিনিয়োগ আসলে একটি কৌশল মাত্র, যার মাধ্যমে মাত্র ৩% কর দিয়েই অবৈধ অর্থ সাদা করা যায়।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “করফাঁকি এবং বৈধ আয়ের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পদ অর্জনের ক্ষেত্রে মৎস্য ব্যবসা দীর্ঘকাল ধরেই একটি সুবিধাজনক মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ইচ্ছে করেই আইনের এই ফাঁকটি রাখা হয়েছে এবং অনেকেই এই সুযোগটি নিয়ে থাকেন।”

শেখ তাপসের মৎস্য ব্যবসার একটি ব্যাখ্যা এমন হতে পারে যে এর মাধ্যমে তিনি মধুমতি ব্যাংকের শেয়ার কেনার জন্য ব্যবহৃত তহবিলের একটি বৈধ উৎস দেখাতে সক্ষম হয়েছিলেন। এমনটি দেখানো প্রয়োজন ছিল কারণ বাংলাদেশে কোন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গাইডলাইন অনুযায়ী ব্যাংকটির ইকুইটি ক্যাপিটালে বিনিয়োগের অর্থ “কর কর্তৃপক্ষের কাছে ঘোষিত [উদ্যোক্তাদের] নেট সম্পদ থেকে” পরিশোধ করতে হবে এবং “ব্যাংক বা অন্য কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে” এই অর্থ পরিশোধ করা যাবেনা এমন একটি বিধান মানতে তাপস বাধ্য ছিলেন। এর অর্থ হলো মধুমতি ব্যাংকের উদ্যোক্তা-বিনিয়োগকারী হওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে তাপসকে দেখাতে হয়েছিল যে তার ৩২ কোটি টাকা আপাত বৈধ ব্যবসা থেকেই এসেছে। রহস্যময় টুঙ্গিপাডা ফিশারিজের মাধ্যমে এই উদ্দেশ্যটিই তখন সাধিত হয়েছিল এমনটিই মনে হয়। সর্বশেষ ২০১৮ ও ২০২০ সালে ইসিতে তাপসের দেওয়া হলফনামায় সেই ফিশারিজের আর কোন উল্লেখ নেই।

শেখ তাপসের অর্থ সংক্রান্ত এসব তথ্যের ব্যাপারে জানতে চাইলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুর্নীতি-বিরোধী সংস্থাগুলোর উচিত এর তদন্ত করা, ‘‘লব্ধ ও জ্ঞাত সম্পদের সাথে বৈধ উৎস থেকে আসা আয়ের কোনো অসামঞ্জস্য থাকলে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষের ওপর এর তদন্তের দায় বর্তায়।’’

বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৩ সালে যে নয়টি ব্যাংকের অনুমোদন দেয়, মধুমতি তার একটি। এই নয়টি ব্যাংকের প্রায় সবগুলোর সাথেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বেশ শক্ত সম্পর্ক ছিল, এবং ব্যাংকগুলোর উদ্যোক্তা হিসেবে কয়েকজন সংসদ সদস্যও ছিলেন। সেই সময়ে বেশিরভাগ অর্থনৈতিক ভাষ্যকার বা অর্থনীতিবিদই নতুন কোন ব্যাংকের প্রয়োজন আছে বলে মনে করতেন না। অনেকে এমনটিও বলেছিলেন যে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রভাবশালীদের পুরস্কার হিসেবে এই ব্যাংকগুলোর অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন এ বিষয়ে মন্তব্য করেছিলেন যে এসব ব্যাংক “জনগণের অর্থ আত্মসাতের মাধ্যম হয়ে উঠেছে।”

মধুমতি ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৩ সালের জুন মাসে। শেখ ফজলে নূর তাপস এই ব্যাংকটির প্রধান উদ্যোক্তা। প্রকৃতপক্ষে, মধুমতি ব্যাংকের শেয়ার কেনার পরেই শেখ হসিনার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় তাপস বাংলাদেশের অতি ধনী ব্যক্তিদের কাতারে উঠে যান। ২০১২/১৩ সালে ব্যাংকের যে শেয়ার তিনি কিনেছিলেন তা থেকেই এখন তার বার্ষিক আয় প্রায় ৭.৮ কোটি টাকা, যা অন্যান্য খাতে তার আয় থেকে অনেক বেশি। তিনি বছরে আইনজীবী হিসেবে ১.৪ কোটি টাকা, বাড়ি ভাড়া বাবদ ৪২ লক্ষ টাকা এবং সংসদ সদস্যের বেতন বাবদ ৬.৬ লক্ষ টাকা আয় করেন।

মধুমতি ব্যাংকের শেয়ার কেনার জন্য ব্যবহৃত তহবিলের প্রকৃত উৎসের ব্যাপারে জানতে চেয়ে শেখ ফজলে নূর তাপসকে ইমেইলের মাধ্যমে কিছু প্রশ্ন পাঠানো হয়েছিল। ফোনে ও এসএমএসেও তার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছিল। তবে তার কাছ থেকে কোন সাড়া পাওয়া যায়নি।

দুর্নীতি দমন কমিশনকেও (দুদক) ইমেইল করে জানতে চাওয়া হয়েছিল যে মধুমতি ব্যাংকের সবচেয়ে বেশি শেয়ার কেনার জন্য ব্যবহৃত তহবিলটি বৈধ উৎস থেকে ছিল কিনা এই বিষয়ে তারা কোন তদন্ত করবেন কিনা? এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ হওয়ার সময় পর্যন্ত দুদকের কোন জবাব আমরা পাইনি।

ঢাকা দক্ষিণে আওয়ামী লীগের মেয়র পদপ্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপসের কাছে এখন নগদ আছে ২৬ কোটি টাকা, ২০০৮ সালে এর পরিমাণ ছিল ৯৮ লক্ষ টাকা। তার এখন ব্যাংকে আছে ১.৫ কোটি টাকা, ২০০৮ সালে এটি ছিল ২ লক্ষ টাকা। এখন ব্যাংকে তাপসের স্থায়ী আমানত ৩৫.২ কোটি টাকা, ২০০৮ সালে এর পরিমাণ ছিল ৩১ লক্ষ টাকা। এখন তার স্বর্ণালংকার আছে ১ কোটি টাকার, ২০০৮ সালে এর পরিমাণ ছিল ৬ লক্ষ টাকা। তার অর্জিত নতুন স্থাবর সম্পদগুলোর মধ্যে রয়েছে বনানীতে ৩ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা মূল্যের একটি পাঁচতলা বাড়ি।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com