কেন মূল্য বেঁধে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার?
বাংলাদেশের নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু পণ্যের দাম নির্ধারণ করার সিদ্ধান্ত মঙ্গলবারই জানিয়েছিল সরকার। বুধবার ট্যারিফ কমিশন জানিয়েছে, তারা এসব পণ্যের দাম নির্ধারণে সমিতি ও বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে চিঠি পাঠাচ্ছে।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য, সরবরাহ ও বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনার একটি বৈঠক শেষে মঙ্গলবার বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, ‘ট্যারিফ কমিশনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, শুধু তেল নয়, আর সবগুলো (পণ্যের) দাম যুক্তিযুক্ত করা, যথাযথ দাম যা হওয়া হওয়া উচিত, সেটা বের করা, তাদেরকে সাথে নিয়ে, যারা এর সাথে সম্পর্কিত। এটা যারা মানবে না, তাদের বিরুদ্ধে সোজাসুজি আইনি ব্যবস্থা নেয়া।’
যেসব পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেয়ার কথা জানানো হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে চাল, গম (আটা ও ময়দা), ভোজ্যতেল (সয়াবিন ও পাম), পেঁয়াজ, চিনি, মসুর ডাল, এমএস রড ও সিমেন্ট।
কিভাবে বাজারের মূল্য নির্ধারণ করবে সরকার
বেশ কয়েকটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেয়ার কথা জানালেও, তার মধ্যে চিনি ও সয়াবিন তেলের দাম আগে থেকেই সরকারিভাবে নির্ধারণ করা হয়।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মাহফুজা আখতার বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘আমরা এজন্য আজ থেকেই কাজ শুরু করে দিয়েছি। আগে থেকেই আমরা তেল আর চিনির মূল্য নির্ধারণের কাজটা নিয়মিত করতাম। একদম ইমপোর্ট এলসি ওপেনিং, সেটেলমেন্ট, ইনবন্ড, আউটবন্ড থেকে শুরু করে, মিলগেটে দাম কী হবে, বিপণনে কত টাকায় বিক্রি হবে, সব ভাগ ভাগ করা আছে।’
‘এখন আমাদের অন্য পণ্যগুলোর হিসাব বের করতে হবে। অ্যাসোসিয়েশনের কাছে কস্টশিটসহ আর কী কী চাইবো, সেটা নিয়ে আমরা কাজ করছি। তাদের কাছ থেকে হিসাব পাওয়ার পর আমরা সেটা যাচাই করবো। তারপর আবার তাদেরকে নিয়ে, সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ে বসবো। সেখানে আলোচনার ভিত্তিতে একটা ন্যায়সঙ্গত মূল্য নির্ধারণ করা হবে।’
নিয়ম অনুযায়ী, সাধারণত খাত ভিত্তিক ব্যবসায়ীদের অ্যাসোসিয়েশন থেকে পণ্যের খরচের একটি বিবরণী বা কস্টশিট সরকারের কাছে দেয়া হয়। সেটা যাচাই-বাছাই করে সরকার বাজার মূল্য নির্ধারণ করে।
সাধারণত বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উৎপাদক বা পরিবেশকরাই মূল্য নির্ধারণ করে থাকেন। কিন্তু সেটা ন্যায়সঙ্গত না হলে সরকারের হস্তক্ষেপ করার সুযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশে এখন যে ভোজ্যতেল ও চিনির মূল্য নির্ধারণ করা হয়, সেটাও এসব পণ্যের আমদানিকারক-পরিবেশকদের সমিতি থেকে যে হিসাব দেয়া হয়, সেটার ভিত্তিতেই নির্ধারণ করা হয়। ট্যারিফ কমিশন মূলত এই হিসাবে কোনো ফাঁকি রয়েছে কিনা, সেটা যাচাই করে দেখে।
কেন মূল্য বেঁধে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার?
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম এক বছরে আট শতাংশ বাড়লেও দেশের বাজারে খোলা ময়দা ও আটার দাম বেড়েছে ৬৭ শতাংশ।
মসুর ডালের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমলেও দেশের বাজারে ২৯ থেকে ৩৯ শতাংশ বেড়েছে। বিশ্ববাজারে স্টিল স্ক্র্যাপের দাম কলেও দেশের বাজারে রডের দাম বেড়েছে। এই বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়েই সরকার এসব পণ্যর দাম বেঁধে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ফরিদপুরের আলীপুরের বাসিন্দা স্বাতী চৌধুরী বলছেন, ‘বাজারে গিয়ে কোনো কিছুর তো হিসাব মেলাতে পারি না। আজ এক দাম, কালকে আরেক দাম। গত একমাসে অনেক জিনিসের দাম আমার বাজেট ছাড়িয়ে গেছে।’
ঢাকার কড়াইল বস্তির বাসিন্দা তারাবানু যেমন বলেছেন, বাজারে জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বেড়েছে তাতে সংসার চালানোই মুশকিল হয়ে পড়েছে।
তিনি বলছেন, ‘আগে দিনে ১০০ টাকা খরচ হলে খাওয়া হয়ে যাইত, এখন সেইটা ২০০ টাকায়ও কুলায় না। মাছ, মাংস ডিম সবজি সব কিছু দামই বাইড়া গেছে। এক দেড় মাসের মতো হয় ডিম আর সবজি দিয়াই চালাইতেছি খাওয়া-দাওয়া।’
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, ‘আমরা লক্ষ্য করেছি, বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়েছে, যা গ্রহণযোগ্য নয়। বৈশ্বিক অস্থিতিশীলতা ও অভ্যন্তরীণ বাজারে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির সুযোগ নিয়ে এসব পণ্যের মূল্য অতিমাত্রায় বাড়ানো হয়েছে, যা হওয়া উচিত ছিল না।’
তবে রড বা সিমেন্টের মতো পণ্যের বাজার মূল্য ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন এর আগে কখনো নির্ধারণ করে দেয়নি। বাজারের চাহিদা ও যোগানের ভিত্তিতেই এটা ওঠানামা করে।
কমিশনের চেয়ারম্যান মাহফুজা আখতার বলছেন, ‘ট্যারিফ কমিশন আদেশের আওতায় সবগুলো পণ্য পড়ে না। কিন্তু এখন যেহেতু সরকার চাচ্ছে, কিভাবে সেটা করা যায়, আমরা তার পথ খুঁজে দেখছি। যেমন রড সিমেন্ট আমরা কখনো করিনি, চাল আমাদের আওতায় আসেনি। এখন কিভাবে কী করা যায়, আমরা সেটা নিয়ে স্টাডি করছি।’
কবে থেকে নতুন বাজার মূল্য কার্যকর হবে?
বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, আগামী ১৫ দিনের মধ্যে এসব পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিতে বলা হয়েছে। এরপর প্রতি মাসেই ট্যারিফ কমিশন এসব পণ্যের দাম ঘোষণা করবে।
তবে ট্যারিফ কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তারা সবেমাত্র কাজ শুরু করেছেন। যেহেতু আরো কয়েকটি পণ্যের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করতে হবে, সেজন্য তারা কোনো সময়সীমা বলতে রাজি হননি। তবে খুব তাড়াতাড়ি তারা এই কাজ শেষ করবেন বলে আশা প্রকাশ করেছেন।
কিন্তু প্রশ্ন রয়েছে, বাজারে মূল্য নির্ধারণ করে দেয়া হলেও সেটা কার্যকরে সরকার কতটা বাধ্য করতে পারবে?
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, ‘সরকার নির্ধারণ করে দেয়া দামের বাইরে কেউ পণ্য বিক্রি করলে শুধু জরিমানা নয়, এখন থেকে মামলাও করা হবে। এতদিন অভিযানের সময় জরিমানা করা হয়েছে। আমি বলেছি, টাকা জরিমানা বাদ, মামলা করে দেন। অন্যায় যারা করবে তাদের আদালতে পাঠাবো।’
বাজারে নির্ধারিত পণ্যের বেশি আদায় করা হচ্ছে কিনা, সেটা দেখতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসনও নজরদারি করে থাকে।
যদিও ট্যারিফ কমিশনের কর্মকর্তারা স্বীকার করেন, মূল্য নির্ধারণ করে দেয়ার পরেও যদি কোন অসাধু ব্যবসায়ী অতিরিক্ত অর্থ আদায় করে, সেটা ধরা অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে।
এর আগে বাংলাদেশ সিলিন্ডারের এলপিজি গ্যাসের দাম সরকারিভাবে নির্ধারণ করে দেয়া হলেও অনেক স্থানে অতিরিক্ত দাম নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মাহফুজা আখতার আশা করছেন, বাজারে কোনো পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দেয়া হলে ক্রেতারা সচেতন হবে, তাদের মূল্য জানা থাকবে। তখন তারা প্রতিবাদ করতে পারবেন অথবা সরকারি দফতরে অভিযোগ জানাতে পারবেন, ফলে ওই প্রবণতা বন্ধ হবে।
সূত্র : বিবিসি